ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ডিইউজের দ্বিবার্ষিক সম্মেলনে রাষ্ট্রপতি

পে স্কেলের সঙ্গে মিল রেখে বেতনবৈষম্য দূর করতে হবে

প্রকাশিত: ০৫:২৪, ৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

পে স্কেলের সঙ্গে মিল রেখে বেতনবৈষম্য দূর করতে হবে

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ঘোষিত নতুন জাতীয় বেতন স্কেলের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সাংবাদিকদের বেতনবৈষম্য দূর করতে সরকারকে উদ্যোগ নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ। তিনি বলেছেন, সম্প্রতি সরকার ঘোষিত অষ্টম পে স্কেলের ফলে সাংবাদিকরা বৈষম্যবোধ করছেন। আমি আশা করি, সরকার এ ব্যাপারে যথাযথ মনোযোগ দেবে। সমস্যাটির অচিরেই সমাধান করবে। বুধবার দুপুরে রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) দ্বিবার্ষিক সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে রাষ্ট্রপতি এসব কথা বলেন। অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের উদ্দেশে আবদুল হামিদ বলেন, রাষ্ট্রপতি হিসেবে আমি আপনাদের আশ্বস্ত করতে পারি। আমার দুয়ার সব সময় আপনাদের জন্য উন্মুক্ত। আর আমার পক্ষে যতটুকু সম্ভব, তা আমি অবশ্যই করব। উল্লেখ্য, স্বাধীনতার পর এই প্রথম কোন রাষ্ট্রপতি ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) কোন সম্মেলনের উদ্বোধন করলেন। এর আগে ১৯৭২ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রধান অতিথি হিসেবে ডিইউজের প্রথম বার্ষিক সাধারণ সভার উদ্বোধন করেন। গণমাধ্যমের প্রভাব সম্পর্কে সাংবাদিকদের উদ্দেশ করে রাষ্ট্রপতি আরও বলেন, সাংবাদিকতা একটি মহান পেশা। সমাজ পরিবর্তনে ব্যক্তি, পরিবার ও অন্য যে কোন পেশাজীবী সংগঠনের চেয়ে আপনাদের ভূমিকা অনেক বেশি কার্যকর। ব্যক্তি, পারিবারিক, সামাজিক ও জাতীয় জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গণমাধ্যম দ্বারা প্রভাবিত হয়। এমনকি আমার রাজনীতিতে আসার পেছনেও গণমাধ্যমের কম ভূমিকা ছিল না। তিনি বলেন, আমাদের শৈশব, কৈশোর আজকের যুগের তুলনায় অনেকটাই অন্ধকার যুগ ছিল। তখন ইন্টারনেট ছিল না, টেলিভিশন ছিল না; তবে রেডিও ছিল। আর রেডিও এতটাই শক্তিশালী মাধ্যম ছিল যে, সরকার তা কবজা করে রেখেছিল। আমরা রেডিও শুনতাম মূলত বিনোদনের জন্য, তাও গান শোনার জন্য। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা রেডিওকে ভিন্ন মাত্রায় আবিষ্কার করলাম। যখন সারাদেশ পাকিস্তানীরা গণহত্যা চালাচ্ছে তখন স্বাধীন বাংলা বেতার জাতিকে অনুপ্রাণিত করেছিল, ঐক্যবদ্ধ রেখেছিল। মিত্র দেশের আকাশবাণীও যথেষ্ট ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছিল। এ প্রসঙ্গে রাষ্ট্রপতি মুক্তিযুদ্ধের সংবাদ প্রচারের ক্ষেত্রে বিবিসি ও এদেশে বিবিসির তৎকালীন সংবাদদাতা শহীদ নিজামউদ্দিনের সাহসী ভূমিকার কথা স্মরণ করেন। এ সময় রাষ্ট্রপতি শহীদ সাংবাদিক চিশতি শাহ, মিজানুর রহমান, শহীদুল্লাহ কায়সার, সেলিনা হোসেন, সিরাজুদ্দীন হোসেনসহ মুক্তিযুদ্ধের সময় শহীদ হওয়া সাংবাদিকদের স্মরণ করেন। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার ঘোষণাটিও ঘাতকরা রেডিওয়ের মাধ্যমে জাতিকে জানিয়েছিল। পঁচাত্তরের শেষ ভাগে কয়েক মাস মনে হয়েছিল- যারা বেতার কেন্দ্র দখল করতে পারে, তারাই রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করতে পারে। কিন্তু সাংবাদিক ও গণমাধ্যমের সংগ্রাম কখনই থেমে ছিল না। স্বৈরচারবিরোধী সংগ্রামসহ বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলনে গণমাধ্যম সবসময়ই অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। বর্তমান যুগকে ‘তথ্য বিপ্লবের যুগ’ আখ্যায়িত করে রাষ্ট্রপতি বলেন, বিদগ্ধজনরা বলেন, এই যুগের আশীর্বাদে অভিশাপও আছে। তাই আজকের যুগের চ্যালেঞ্জ হচ্ছে এই সর্বব্যাপী প্রযুক্তিকে মানুষের কল্যাণে দায়িত্বের সঙ্গে ব্যবহার করা। এ ব্যাপারে গণমাধ্যম কর্মীদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নতুন প্রেক্ষাপটে সাংবাদিকদের ভূমিকা সম্পর্কে রাষ্ট্রপতি বলেন, তথ্য মানচিত্রের সঙ্গে সঙ্গে সাংবাদিকদের ভূমিকাও বদলেছে। তাদের আগের ভূমিকার সঙ্গে যোগ হয়েছে গণমাধ্যমের অপব্যবহার রোধ করা। জাতির বিবেক হিসেবে তারা যদি জাতির আলোচ্য সূচীগুলো যথাযথভাবে জাতির সামনে তুলে ধরতে পারে তবে দেশ ও জাতি উপকৃত হবে। তিনি আশাপ্রকাশ করেন, সাংবাদিকরা এই দায়িত্ব পালনে সক্ষম হবেন। রাষ্ট্রে গণমাধ্যমের গুরুত্ব তুলে ধরে আবদুল হামিদ বলেন, গণমাধ্যম রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ। এর মাধ্যমে জাতি তার প্রকৃত আশা, আকাক্সক্ষা ও অভিপ্রায় ব্যক্ত করে থাকে। রাষ্ট্রের নির্বাহী ও অন্যান্য বিভাগ যা ভুলে যায় কিংবা পর্যাপ্তভাবে দৃষ্টিক্ষেপণ করে না, সেটা বলার দায়িত্ব তারা পূরণ করে। রাষ্ট্রপতি বলেন, গণমাধ্যম ছাড়া জাতি ও গণতন্ত্র অপূর্ণাঙ্গ থাকে। জাতি গঠনে গণমাধ্যমের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গণমাধ্যম ও গণতন্ত্র একে অপরের পরিপূরক। গণতন্ত্র বিকশিত হলেই গণমাধ্যম প্রসারিত হয়। তাই গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে আপনাদের নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে হবে। মনে রাখতে হবে, আপনার দেয়া একটি সংবাদ বা রিপোর্টের কারণে ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা জাতি যেন অহেতুক কোন হয়রানির শিকার না হয়। সংবাদ প্রচার ও প্রকাশের ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেয়ার আহ্বান জানিয়ে রাষ্ট্রপতি বলেন, এক্ষেত্রে পত্রিকা বা চ্যানেলের প্রচার ও প্রসারের বিষয়টিকে প্রাধান্য দিলে চলবে না। মুক্তিযুদ্ধসহ দেশের প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে গণমাধ্যমের ভূমিকা খুবই প্রশংসনীয়। কিছু লোকের ভূমিকার কারণে আপনাদের এই সুনাম যাতে ক্ষুণœ না হয় সেই ব্যাপারে সজাগ থাকতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সমুন্নত রাখতে সম্মিলিত উদ্যোগ নিতে হবে। রাষ্ট্রপতি বলেন, গণমাধ্যমের কাজকে আরও সহজ করতে সরকার ইতোমধ্যে তথ্য কমিশন, মানবাধিকার কমিশন, প্রেস কাউন্সিল ও সাম্প্রতিককালে জাতীয় সম্প্রচার কমিশন গঠন করেছে। এ সকল প্রতিষ্ঠান সাংবাদিকদের কাজ যেমন সহজ করেছে, তেমনি তাদের কাজে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতাও এনেছে। অন্য সব নাগরিকের মতে সাংবাদিকদেরও গৃহায়ন ও স্বাস্থ্যসেবাসহ অন্যান্য সমস্যা আছে। এসব সমস্যা সমাধানে সম্মিলিত উদ্যোগ নিতে হবে। সরকার ইতোমধ্যে একটি ট্রাস্ট গঠন করেছে। সাংবাদিকদের অংশগ্রহণ ও নেতৃত্বে এই প্রতিষ্ঠানটি তাদের অনেক সমস্যা সমাধান করতে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখবে বলে তিনি আশাপ্রকাশ করেন। এর আগে বক্তব্যের শুরুতে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) সভাপতি আলতাফ মাহমুদের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেন রাষ্ট্রপতি। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেন, আইন দ্বারা সাংবাদিকদের দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা যায় না। মুক্তিযুদ্ধ, গণতন্ত্র, সমাজ, নারীর সম্ভ্রম রক্ষার্থে নিজের বিবেকের প্রতিই সাংবাদিকদের দায়বদ্ধ থাকতে হবে। নিরপেক্ষতার নামে মুক্তিযোদ্ধা ও রাজাকারকে এক পাল্লায় মাপা যাবে না। তিনি নিরপেক্ষতার পরিবর্তে বস্তুনিষ্ঠতা চর্চার জন্য সাংবাদিকদের আহ্বান জানান। সাংবাদিকদের বিভিন্ন দাবি-দাওয়া সম্পর্কে মন্ত্রী বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এসব সমস্যা সমাধানে সরকার সংবেদনশীলভাবে কাজ করছে। সাংবাদিকদের সঙ্গে পরামর্শ করেই এসব সমস্যা অচিরেই সমাধান করা হবে। ডিইউজের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আতিকুর রহমান চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা ও ডেইলি অবজারভার সম্পাদক ইকবাল সোবহান চৌধুরী, জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি মুহম্মদ শফিকুর রহমান। অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) ভারপ্রাপ্ত সভাপতি জাফর ওয়াজেদ সাংবাদিকদের জন্য নবম ওয়েজ বোর্ড চালুসহ বিভিন্ন দাবি-দাওয়া তুলে ধরেন। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন ডিইউজে সাধারণ সম্পাদক কুদ্দুস আফ্রাদ।
×