ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

চট্টগ্রামে প্রকাশ্যে বেচাকেনা হলেও তৎপরতা নেই কর্তৃপক্ষের

নোট গাইডের রমরমা ব্যবসা

প্রকাশিত: ০৭:১২, ৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

নোট গাইডের রমরমা ব্যবসা

স্টাফ রিপোর্টার, চট্টগ্রাম অফিস ॥ নিষেধাজ্ঞা থাকলেও চট্টগ্রামে বইয়ের বাজারে চলছে নিষিদ্ধ নোট ও গাইডের রমরমা ব্যবসা। চলতি শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীদের টার্গেটে রেখে নতুন বছরের শুরুতে নগরীর বইয়ের দোকানে অবৈধ নোট গাইডে সয়লাব হয়ে গেছে। চকবাজার, আন্দরকিল্লা, নিউমার্কেটসহ নগরীর বিভিন্ন এলাকার বইয়ের দোকানে প্রকাশ্যে বেচাকেনা চলছে নিষিদ্ধ এসব নোট বুক। জেলা প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখের সামনে প্রকাশ্যে বেচাকেনা হলেও কোন তৎপরতা নেই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের। হাইকোর্ট থেকে জেলা প্রশাসনকে নিষিদ্ধ নোট গাইড বিক্রি তদারকি করার নির্দেশনা দেয়া হলেও কর্তৃপক্ষ নির্বিকার রয়েছেন। তবে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ম্যাজিস্ট্রেট স্বল্পতায় অবৈধ নোট গাইডের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা যাচ্ছে না। তবে খুব শীঘ্রই নিষিদ্ধ নোট গাইডের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করবে জেলা প্রশাসন। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) দেবময় দেওয়ান বলেন, ‘আমি এই পদে নতুন যোগদান করেছি। নিষিদ্ধ নোট গাইড বিক্রির বিষয়টি আপনার কাছে জানলাম। খুব দ্রুত মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে ওইগুলো বাজেয়াপ্ত করব।’ এদিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নোট বুক ও গাইড নিয়ে কঠোর হওয়ার আগে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে সৃজনশীল শিক্ষক এবং আধুনিক ও উন্নত সৃজনশীল পাঠ্যবই প্রস্তুত করা প্রয়োজন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক মাহবুবুল হক বলেন, ‘নোট বুক ও গাইডের চাহিদা তখনই কমবে, যখন পাঠ্যবইগুলো অভিজ্ঞদের দিয়ে সম্পাদনা করে আধুনিক উপায়ে প্রণয়ন করা হবে। আইনের বাস্তবায়নে তখনই কঠোর হওয়া উচিত হবে, যখন স্কুলের সকল শিক্ষক সৃজনশীল পদ্ধতিতে পুরোপুরি প্রশিক্ষিত হবে।’ অপরদিকে অভিযোগ রয়েছে আইন করে নোট বুক নিষিদ্ধ করা হলেও এখন ও নগরীর বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের নোট বুক কিনতে উদ্বুদ্ধ করছেন। ক্লাসে নির্দিষ্ট প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের নোট গাইড কিনতে শিক্ষার্থীদের নির্দেশনা দিচ্ছেন। নগরীর হিলভিউ আবাসিক এলাকার বাসিন্দা রশিদ আহমেদ জানান, তার ভাতিজা নগরীর নাছিরাবাদ বালক উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়ে। তাকে শ্রেণী শিক্ষক বলেছেন পাঞ্জেরী নোট গাইড ভাল। পাঞ্জেরী প্রকাশনের নোট গাইড কিনতে ওই শিক্ষক নির্দেশনা দিয়েছেন। জানা গেছে, চট্টগ্রাম প্রাথমিক, নিম্ন মাধ্যমিক ও মাধ্যমিক স্তরে প্রায় ৫০ লাখ শিক্ষার্থী চলতি বছরের শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করেছে। কোমলমতি এসব শিক্ষার্থীর শিক্ষাগ্রহণ ও শিক্ষা কার্যক্রমকে ব্যাহত করার জন্য অসাধু চক্র মুনাফা ও কমিশনের বিনিময়ে গড়ে তুলেছে নিষিদ্ধ নোট ও গাইড বইয়ের বিশাল বাজার। বিভিন্ন শ্রেণীর নোট গাইড বই প্রকাশক, লেখক, বিক্রেতা, শিক্ষকদের মাধ্যমে তৈরি হয়েছে নিষিদ্ধ নোট ও গাইড বইয়ের রমরমা বাণিজ্য। একদিকে এসব প্রতিষ্ঠানগুলো প্রচলিত আইনের লঙ্ঘন করছে প্রতিনিয়ত, অন্যদিকে তদারকি সংস্থাগুলো পালন করছে নিষ্ক্রিয় ভূমিকা। নগরীর আন্দরকিল্লার মোড়ে পাঠক বুকস লাইব্রেরি, বুক সেন্টার, পিপলস লাইব্রেরি, সিটি লাইব্রেরি, জম জম প্রকাশনসহ আরও কয়েকটি দোকান ঘুরে দেখা যায়, প্রথম হতে অষ্টম শ্রেণীর নিষিদ্ধ বিভিন্ন নোট-গাইড প্রকাশ্যে বিক্রয় করছে অনেক বই বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান। অষ্টম শ্রেণীর পাঞ্জেরী প্রকাশনীর এক সেট সৃজনশীল গাইডের দাম ৮০০ টাকা, জুপিটার ৭০০, লেকচার সিরিজের এক সেট ৮৮০, অনুপম এক সেট ৭৮০ টাকা। এসব প্রতিষ্ঠানে চলছে নিষিদ্ধ নোট গাইড বিক্রয় উৎসব। এসব দোকানে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের অনেক ভিড়। আবু নাছের নামে একজন অভিভাবক অষ্টম শ্রেণীর সন্তানের জন্য সৃজনশীল পদ্ধতির নোট বুক কিনতে পিপলস লাইব্রেরিতে এসেছেন। কথা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সন্তানের ভাল ফলাফলের জন্য সহায়ক হিসেবে এসব বই কিনতে হয়। এছাড়া সবাই তো কিনেন এবং শিক্ষকরা পরামর্শ দেন কিনতে। জম জম প্রকাশনের বিক্রয় প্রতিনিধি জানান, ‘নোট বুক নিয়ে মাঝে মাঝে সমস্যায় পড়ি। তাই এগুলো রাখতে চাই না। কিন্তু বাজারের চাহিদা আছে বলে আমাদের এসব বই বিক্রি করতে হয়। প্রতিদিন কয়েকশ’ অভিভাবক নোট বুক কিনতে দোকানে আসেন বলে তিনি জানান। বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি চট্টগ্রাম জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক কাজী সাবের আহমদ বলেন, ‘আমরা কোন নোট ও গাইড বই বিক্রি করছি না। আমরা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ধারণাপত্র প্রকাশ করছি ও বিক্রি করছি। যা শিক্ষার্থীদের প্রতিটি বিষয়ে সৃজনশীল ধারণা পেতে সাহায্য করছে।’ উল্লেখ্য, সরকার ১৯৮০ সালে নোট ও গাইড প্রকাশনা নিষিদ্ধ করে। পরে ২০০৭ সালে ১০ ডিসেম্বর হাইকোর্ট পুনরায় জেলা প্রশাসকদের নোট গাইড বই বাজারজাত বন্ধের জন্য নির্দেশ দেন। এরপর বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রয় সমিতি করা রিটে শুনানিতে ২০০৯ সালে নবেম্বর হাইকোর্ট প্রথম শ্রেণী হতে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত নোট গাইড মুদ্রণ, প্রকাশনা, বিক্রয় ও বাজারজাতকরণ পুরোপুরিভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। তাছাড়া খসড়া শিক্ষা আইনে ২০১৩ তে এসব নোট ও গাইডকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
×