ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

খালিদ বিন ওয়ালিদ

বিশ্বযুদ্ধে জাপানী সৈন্যদের নারী নিগ্রহ ॥ সিউলের কাছে টোকিওর ক্ষমা

প্রকাশিত: ০৬:৫৩, ৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

বিশ্বযুদ্ধে জাপানী সৈন্যদের নারী নিগ্রহ ॥ সিউলের কাছে টোকিওর ক্ষমা

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে কোরীয় নারীদের যৌনদাসী হিসেবে জাপানী সেনাবাহিনীর সেবায় নিয়োজিত হতে বাধ্য হওয়াকে কেন্দ্র করে এই দুই দেশের মধ্যে যে তিক্ততা সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল তার অবসানের পথে তাৎপর্যপূর্ণ অগ্রগতি ঘটেছে। সম্প্রতি দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীররা এক চুক্তিতে উপনীত হয়েছেন যার অধীনে জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে এই ঘটনার জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করেছেন এবং সাবেক যৌনদাসী বর্ষীয়ান মহিলাদের জন্য টোকিওর তরফ থেকে ৮৩ লাখ ডলারের সাহায্য দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এই চুক্তির ফলে দুই দেশের মধ্যে কয়েক দশকের বৈরিতা ও অবিশ্বাস দূর হতে পারে। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিউলে জাপানী দূতাবাসের ঠিক বিপরীত দিকে এক কিশোরী যৌনদাসীর প্রতীকী ব্রোঞ্জমূর্তি উৎকীর্ণ আছে যার উদ্দেশ্য এই ঘটনার জন্য প্রতিদিন ঘৃণা প্রকাশ ও বর্ৎসনা করা। ২৮ ডিসেম্বরের ঐতিহাসিক চুক্তির পর এখন ঐ ব্রোঞ্জ মূর্তিটি অন্য কোথাও সরিয়ে নেয়ার কথা ভাবা হচ্ছে। সাবেক যৌনদাসীদের মধ্যে যারা জাপান থেকে দক্ষিণ কোরিয়ায় ফিরে এসেছিল তাদের মাত্র ৪৬ জন এখন বেঁচে আছে। এদের চিকিৎসা ও পরিচর্যার জন্য জাপান যে ৮৩ লাখ ডলার দেবে তা দিয়ে দক্ষিণ কোরিয়া একটা তহবিল গড়ে তুলবে। বলাবাহুল্য, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সেই দিনগুলোতে দক্ষিণ কোরিয়া থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হাজার হাজার নারীর অনেকেই জাপানী সৈনিকদের দ্বারা দিন কয়েকডজন বার ধর্ষিত হতো। তাদের নিয়মিত প্রহার করা হতো। তারা বিভিন্ন যৌনরোগে আক্রান্ত হয়েছিল। এই চুক্তির মধ্য দিয়ে জাপানীদের মনোভাবের ক্ষেত্রে এক বিরাট পরিবর্তন ঘটল। এই মহিলাদের ওপর আগে বলপ্রয়োগ করা হয়েছিল কিনা প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে এ নিয়ে প্রশ্ন তুলতেন। এখন তিনি আশা করছেন যে, এই চুক্তির মধ্য দিয়ে দু’দেশের সম্পর্কে তিক্ততা সৃষ্টিকারী একটা ইস্যুর চিরসমাপ্তি ঘটবে। এশিয়ার এই দুই নিকটতম প্রতিবেশীর তিক্ততা দূর হওয়ার উপকরণ হওয়ায় মার্কিন প্রশাসনও বেশ প্রসন্ন। কারণ এই দুটি দেশের উন্নত সম্পর্ক চীনের উত্থান ঠেকাতে আমেরিকার অনুসৃত স্ট্যাটেজির সহায়ক হবে। এর আগে টোকিও-সিউল সম্পর্ক খাদের কিনারায় এসে দাঁড়ানোয় দক্ষিণ কোরিয়ার নীতি নির্ধারকদের কেউ কেউ অস্বস্তি বোধ করছিলেন। তাদের অস্বস্তির আরও একটা কারণ ছিল এই যে প্রেসিডেন্ট পার্ক গিউন-হাই মাঝে মাঝে একটু বেশি মাত্রায় চীনের দিকে ঝুঁকছিলেন। এখন জাপানও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দক্ষিণ কোরিয়ার একটা শক্তিশালী ত্রিপক্ষীয় সম্পর্ক গড়ে উঠলে বিপজ্জনক উত্তর কোরিয়াকে মোকাবেলা করা সিউলের জন্য সহজতর হবে। প্রশ্ন হচ্ছেÑ যুক্তিটি শেষ পর্যন্ত টিকবে কিনা। শিনজোর এই পদক্ষেপে জাপানের কিছু কিছু উগ্র জাতীয়তাবাদী চটবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। তারা এটাকে শিনজোর বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে দেখবে। তবে শিনজোর এতে উদ্বিগ্ন হবার কারণ নেই এজন্য যে, এ মুহূর্তে জাপানে রাজনীতিতে তার যথেষ্ট প্রাধান্য আছে। তাছাড়া তিনি বলতে পারেন যে, দুঃখ প্রকাশ বা ক্ষমা প্রার্থনার মধ্যে তো কোন আইনগত দায়দায়িত্ব নেই। ১৯৬৫ সালে জাপান দক্ষিণ কোরিয়া সম্পর্ক স্বাভাবিককরণ চুক্তির মধ্যেই তো এই ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল। কাজেই ক্ষমা চাওয়ার মধ্য দিয়ে তো এক ইঞ্চি ছাড় দেয়া হয়নি। ১৯৯৩ সালের ঐতিহাসিক কোন বিবৃতিতেও জাপান প্রথমবারের মতো সরকারীভাবে স্বীকার করেছিল যে যুদ্ধের সময় জবরদস্তি বা বলপ্রয়োগের ঘটনা ঘটেছিল। তবে সেক্ষেত্রে গণিকাবৃত্তির কাজে নারী সংগ্রহে শুধুমাত্র সেনাবাহিনীর সংশ্লিষ্টতার কথাই বলা হয়েছে। ছলচাতুরি বা বলপ্রয়োগের কথাটা এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। অবশ্য এই চুক্তি নিয়ে বেশি সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা আছে দক্ষিণ কোরিয়ায়। সে সময়কার যারা আজও বেঁচে আছেন তাদের প্রতিনিধিত্বকারী গ্রুপগুলোর কেউ কেউ এই চুক্তিকে বিশ্বাসঘাতকতা আখ্যা দিয়েছে। অনেকে আবার জাপান দূতাবাসের সামনে স্থাপিত প্রতীকী মূর্তিটি সরিয়ে ফেলার বিরোধী। এমন দাবিও উঠতে পারে যে, প্রেসিডেন্ট পার্কের কাছে ক্ষমা চাওয়ার পরিবর্তে শিনজোকে সশরীরে এসে জীবিত সেই নারীদের কাছে ব্যক্তিগতভাবে ক্ষমা চাইতে হবে। শিনজো এতে রাজি হবেন কি না তা পরিষ্কার নয়। তবে বুঝাই যাচ্ছে এ এক নাজুক ধরনের চুক্তি যা কূটনৈতিক প্রয়োজন থেকে উদ্ভূত হয়েছে। যে প্রয়োজন থেকেই হোক না কেন দুপক্ষ এই চুক্তিতে অটল থাকলে সামরিক ও অন্যান্য ক্ষেত্রে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নতি হওয়ারসমূহ সম্ভাবনা আছে। সূত্র : দি ইকোনমিস্ট
×