ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সমৃদ্ধ সুনির্বাচিত গ্রন্থের বিপুল সম্ভার নিয়ে বাংলা একাডেমি

প্রকাশিত: ০৫:৩৩, ৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

সমৃদ্ধ সুনির্বাচিত গ্রন্থের বিপুল সম্ভার নিয়ে বাংলা একাডেমি

মোরসালিন মিজান অসংখ্য বই। নানা বিষয়ে লেখা। বিপুল সম্ভার এখন মোটামুটি দৃশ্যমান। অমর একুশে গ্রন্থমেলার প্রায় প্রত্যেকটি স্টলে চলছে প্রদর্শনী। পাঠকও নেহায়েত কম নয়। বাংলা একাডেমি চত্বর ঘুরে বেড়াচ্ছেন। সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানেও ভাল সমাগম। অমর একুশে গ্রন্থমেলার দ্বিতীয় দিনেও মূলত স্টল দেখে, খোঁজ করে কেটেছে। বেচা বিক্রি কম। তবে হচ্ছে না বলা যাবে না। বিশেষ করে বাংলা একাডেমির বই বিক্রি জমে উঠেছে। এই একাডেমির বিশেষ উচ্চতা। মান-মর্যাদায় স্বতন্ত্র অবস্থানে। বাঙালীর মেধা মননের প্রতীক প্রতিষ্ঠানটিতে সারা বছরই চলে গবেষণা। প্রকাশিত হয় গুরুত্বপূর্ণ সব গ্রন্থ। এবারের মেলায় এক শ’র বেশি বই আসার কথা রয়েছে। এরই মাঝে চলে এসেছে অর্ধশতাধিক গ্রন্থ। অনেক স্টল ও প্যাভিলিয়ন থেকে গ্রন্থ প্রদর্শন ও বিক্রয় করা হচ্ছে। মেলা ঘুরে দেখা যায়, বাংলা একাডেমির অভ্যন্তরেই প্রতিষ্ঠানটির একাধিক প্যাভিলিয়ন ও স্টল। ড. এনামুল হক ভবনের পাশে বিশাল আয়তনের প্যাভিলিয়ন। নজরুল মঞ্চের উল্টো দিকে নতুন একটি স্টল। উভয় স্টলে একাডেমির নতুন পুরনো বই প্রদর্শন ও বিক্রি করা হচ্ছে। একটি স্টল নেয়া হয়েছে শুধু একাডেমির সাহিত্য পত্রিকা ‘উত্তরাধিকার’ প্রদর্শন ও বিক্রির জন্য। বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত সংখ্যা দিয়ে সাজানো হয়েছে এই স্টল। সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে বর্ধমান হাউসের আদলে গড়া হয়েছে আরেকটি প্যাভিলিয়ন। এখানেও অনেক জায়গা। একাডেমির বই খুঁটিয়ে দেখার পক্ষে অনুকূল পরিবেশ। কাছাকাছি দূরত্বে শিশু-কিশোরদের উপযোগী বইয়ের স্বতন্ত্র স্টল। সবটিতেই অপেক্ষাকৃত মনোযোগী পাঠক। পছন্দের বই সংগ্রহ করছেন। বাংলা একাডেমির গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোর একটি অভিধান প্রকাশ। গত কয়েক বছরে এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ কাজ হয়েছে। সে ধারাবাহিকতায় এবারের মেলায় প্রকাশিত হয়েছে আধুনিক বাংলা অভিধান। এতে ৬৫ হাজার ভুক্তি। প্রতিটি ভুক্তিই মূল ভুক্তি। আছে শব্দের ব্যাখ্যামূলক সজ্ঞার্থ। প্রতিটি ভুক্তির উচ্চারণ ও ব্যুৎপত্তি উল্লেখ করা হয়েছে। অভিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে বহুল ব্যবহৃত বিদেশী শব্দ। ১৪৩৪ পৃষ্ঠার অভিধানের মূল্য ৪০০ টাকা। একাডেমির অত্যন্ত প্রশংসনীয় উদ্যোগ ‘বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতি গ্রন্থমালা’। দেশের ৬৪ জেলার লোকজ সংস্কৃতির নানা দিক তুলে ধরার লক্ষ্য নিয়ে এই সিরিজ গ্রন্থ প্রকাশিত হচ্ছে। গত বছর কয়েকটি জেলার ওপর কাজ সম্পন্ন হয়েছিল। এবারের মেলায় এসেছে আরও বেশকিছু বই। একাডেমি এরই মাঝে ৩৭ জেলার লোকজ সংস্কৃতির ইতিহাস গ্রন্থের তালিকা প্রকাশ করেছে। ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ, বগুড়াসহ বিভিন্ন জেলার বই হাতে নিয়ে দেখা যায়, যথেষ্ট সমৃদ্ধ প্রকাশনা। তৃণমূল পর্যায় থেকে মাঠপর্যায়ে কাজের মাধ্যমে উপাদান সংগ্রহ করে সেগুলো গ্রন্থগুলোতে সন্নিবেশিত করা হয়েছে। পাঠ করলে সংশ্লিষ্ট জেলাগুলোর সামাজিক সাংস্কৃতিক রূপান্তরের ধারায় লোকজ সংস্কৃতির ইতিহাসের একটি রূপরেখা পাওয়া যায়। ধ্রুপদী সাহিত্য নিয়েও কাজ চলছিল। মেলার দ্বিতীয় দিনেই স্টলে চলে এসেছে হুমায়ূন কবিরের ‘বাঙলার কাব্য’। আরও ১৫টির মতো ধ্রুপদী গ্রন্থ আসার কথা রয়েছে। সুফিয়া কামাল, আবুল হোসেন, আহসান হাবিব, সৈয়দ আলী আহসান, ফররুখ আহমেদের নির্বাচিত কবিতাগ্রন্থ প্রকাশের কাজও এগিয়ে চলেছে। মেলায় এসেছে নূহ উল আলম লেনিনের বই ‘বাঙালি সমাজ ও সাহিত্যে সাম্প্রদায়িকতা এবং মৌলবাদ।’ লেখকের এটি পিএইচডির থিসিস। সমৃদ্ধ রচনা। হায়দার আকবর খান রনোর লেখা ‘মানুষের কবি রবীন্দ্রনাথ’ প্রদর্শিত হচ্ছে স্টলে। লেখক চন্দন লিখেছেন, ‘হাসান আজিজুল হকের কথাসাহিত্য বিষয়বিন্যাস ও নির্মাণকৌশল’। নতুন আসা বইগুলোর মধ্যে এটিও উল্লেখযোগ্য। একাডেমির নতুন বইয়ের তালিকায় পাওয়া যায় বহুবিধ বিষয়ের বই। উদাহরণ হতে পারেÑ বাংলাদেশের স্বাধীনতা কূটনৈতিক যুদ্ধ, পাকিস্তানের আঞ্চলিক বৈষম্য : পার্লামেন্টে বিতর্ক, বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী বক্তৃতা, স্টাডিজ ইন সাউথ এশিয়ান হেরিটেজ, বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী পুতুল নাট্য, বিশ্বমানব : ভলতেয়ার, ফয়েজ আহমদ স্মারকগ্রন্থ, আবদুল মান্নান সৈয়দ রচনাবলী, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী পরিচয়, প্রাচ্যের রহস্য নগরী, আবদুল্লাহ আল মামুনের নাটক : বিষয় ও পরিচর্যা, বাংলাদেশের কোচ জনগোষ্ঠীর সমাজ ও সংস্কৃতি। অনেকে মনে করেন, বাংলা একাডেমির সিরিয়াস গ্রন্থ কেনার লোকের খুব অভাব। আদতে উল্টো গল্প। সব সময়ই বাংলা একাডেমি প্রকাশিত বইয়ের বাড়তি কদর। প্রচুর বিক্রি হয়। মেলা পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব ড. জালাল আহমেদ তো চমকপ্রদ তথ্য দেন। তিনি জানান, প্রথম দিন সোমবার অল্প সময় খোলা ছিল স্টল। এর পরও মাত্র কয়েক ঘণ্টায় বিক্রি হয়েছে ৫৪ হাজার টাকার বই। গত বছর পুরো মেলায় একাডেমির বই বিক্রি হয় ১ কোটি ৬০ লাখ টাকার বই! সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানের প্যাভিলিয়ন থেকে বই কিনে ফিরছিলেন আবু হাশেম নামের এক পাঠক। বয়সে তরুণ। বললেন, বাংলা একাডেমির বই সুনির্বাচিত। বহু গবেষণার ফল। দেশের প্রথিতযশা লেখকরা এসব গ্রন্থ রচনার সঙ্গে যুক্ত থাকেন। এসব কারণে সিরিয়াস পাঠক বাংলা একাডেমির বই কিনতে সময় নেন না। আফসানা নামের আরেক পাঠক এই বক্তব্যের সঙ্গে যোগ করে বললেন, একাডেমির বইয়ের দামটা অপেক্ষাকৃত কম হয়। এটা সীমিত সাধ্যের পাঠকের জন্য সহায়ক। নতুন বই পুরনো বইয়ের কোন ব্যাপার নেই জানিয়ে তিনি বলেন, আমি যে বই পড়িনি সেটাই নতুন। তাই গত বছরের বই বেশি কেনা হয়েছে। লোকজ সংস্কৃতি গ্রন্থমালা সিরিজ থেকে একটি বই কিনেছিলেন তিনি। একাডেমির এই উদ্যোগটির প্রশংসা করে তিনি বলেন, বাংলা একাডেমির এমন বড় কাজগুলোই করা উচিত। নতুন বই অমর একুশে গ্রন্থমেলার দ্বিতীয় দিনে যথারীতি অনেক নতুন বই এসেছে। সব বইয়ের খোঁজ নেয়া কঠিন কাজ। তবে, একাডেমিতে এদিন নতুন বই জমা পড়েছে ৭টি। মেলা মঞ্চের আয়োজন বিকেলে গ্রন্থমেলার মূল মঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘বাংলা একাডেমির হীরকজয়ন্তী : বাংলা একাডেমিকে ফিরে দেখা’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন শফিউল ইসলাম। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন ফজলে রাব্বি, আজিজুর রহমান আজিজ, বেগম আকতার কামাল এবং মোহিত কামাল। সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক মোহাম্মদ আবদুল কাইউম। প্রাবন্ধিক বলেন, বাংলা একাডেমি আজ বাঙালী জাতির হৃদস্পন্দনে রূপ নিয়েছে। মহান ভাষা আন্দোলনের স্মারক এই প্রতিষ্ঠান বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের গবেষণা দিয়ে যাত্রা শুরু করে। পাঁচ হাজারেরও বেশি বইয়ের প্রকাশক-সংস্থার বাংলা একাডেমি। আমাদের পাঠকদের মাঝে অভিধান-মনস্কতা তৈরি বাংলা একাডেমির এক অবিস্মরণীয় কাজ। পাশাপাশি প্রাচীন ও মধ্যযুগের পুঁথি সম্পাদনা, বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চা, প্রথম প্রমিত বাংলা ব্যাকরণ রচনা, বিভিন্ন বিষয়ে স্মারক প্রকাশনা, বিজ্ঞানভিত্তিক ফোকলরচর্চা, বাংলা সাহিত্যের বহুমাত্রিক অনুবাদ এবং বিশ্বের দীর্ঘকাল স্থায়ী বইমেলার আয়োজক প্রতিষ্ঠান হিসেবে একাডেমি আজ প্রকৃতার্থেই বাঙালী জাতিসত্তা ও বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষের প্রতীক-প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। আলোচকরা বলেন, গোটা বাংলা অঞ্চলের বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক জগতের ইতিহাস লিখতে গেলেও বাংলা একাডেমির প্রসঙ্গ আসবে। বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার এই মহৎ প্রতিষ্ঠানে এদেশের সেরা লেখকবৃন্দ যে পারিবারিক আবহে কাজ করেছেন, আড্ডা দিয়েছেন আজ তা আমাদের জাতীয় সাহিত্য-সংস্কৃতির ইতিহাসের অংশ। তারা বলেন, বাংলা একাডেমি ঐতিহ্য ও আধুনিকতার সমন্বয় সাধন করে সম্প্রতি যে নতুন অভিযাত্রা শুরু করেছে তা দেশের ভবিষ্যত প্রজন্মকে বুদ্ধিবৃত্তিকচর্চা এবং আলোকিত আগামী বিনির্মাণে সহায়তা করবে। সভাপতির বক্তব্যে মোহাম্মদ আবদুল কাইউম বলেন, বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠাকালীন সীমিত পরিধি ছাপিয়ে আজ এক বৃহৎ প্রতিষ্ঠানে রূপ নিয়েছে। একাডেমি শুরুতে গবেষণামূলক কার্যক্রমের ওপর জোর দিলেও একই সঙ্গে সমকালীন নাট্যচর্চা এবং সাংস্কৃতিক আন্দোলনেও যুক্ত হয়েছে। সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সঙ্গীত পরিবেশন করেন শিল্পী রথীন্দ্রনাথ রায়, সুবীর নন্দী, সুজিত মোস্তফা, ইফফাত আরা নার্গিস, আঞ্জুমান আরা শিমুল।
×