ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

কর্মসংস্থান ৬০ লাখ ;###;ডিম-মাংসে দেশ স্বাবলম্বী

২৫ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ ॥ পোল্ট্রি শিল্প- বাধা বিপত্তি পেরিয়ে সাফল্যের শিখরে

প্রকাশিত: ০৫:২৪, ৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

২৫ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ ॥ পোল্ট্রি শিল্প- বাধা বিপত্তি পেরিয়ে সাফল্যের শিখরে

হামিদ-উজ-জামান মামুন ॥ দেশে যে কয়েকটি শিল্পের নীরব বিপ্লব ঘটেছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে পোল্ট্রি শিল্প। নানা ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে সরকারী সহযোগিতা এবং উদ্যোক্তাদের জ্ঞান, পরিশ্রম, বিনিয়োগে উচ্চ ঝুঁকি গ্রহণের মানসিকতা এবং আন্তরিক প্রচেষ্টায় এ শিল্প এখন একটি উদাহরণ। তৈরি হয়েছে লাখ লাখ কর্মসংস্থান। সেই সাথে মেধাবী ভবিষ্যত প্রজন্ম গড়তে পুষ্টির ঘাটতি পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলছে। শুধু তাই নয়, দেশ এখন মুরগির ডিম ও মাংসে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। এ শিল্প যে দেশের ডিম ও মাংসের শতভাগ চাহিদা পূরণ করার পাশাপাশি, কোন কোন সময় অতিরিক্ত উৎপাদন হচ্ছে। দেশীয় চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রফতানির জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিচ্ছে দেশীয় কোম্পানিগুলো। এ বিষয়ে কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী সম্প্রতি বলেন, নিরাপদ মুরগি ও ডিম উৎপাদনের মাধ্যমে দেশের পুষ্টি চাহিদা পূরণের পাশাপাশি বিদেশে রফতানি বাড়াতে হবে। এজন্য সরকারের পক্ষ থেকে এ শিল্পের উন্নয়নে সর্বাত্মক সহযোগিতা দেয়া হবে। মন্ত্রী বলেন, ট্যানারির বর্জ্য দিয়ে একটি অসাধু চক্র অনিরাপদ পোল্ট্রি খাদ্য তৈরি করছে। এ বিষয়ে সরকার সজাগ রয়েছে। সরকারের হস্তক্ষেপের কারণে এ ধরনের অসাধু প্রবণতা বিলুপ্ত হওয়ার পথে। ফলে ভোক্তারা নিঃসন্দেহে ডিম ও মাংস খেতে পারছেন। তিনি বলেন, পোল্ট্রি শিল্পের উৎপাদন আরও বাড়াতে এবং মান উন্নয়ন করতে উদ্যোক্তা ও বিজ্ঞানীদের মেধার সমন্বয় ঘটাতে হবে। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেমের সম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রায় এক শতাংশ আসে পোল্ট্রি শিল্প থেকে। গার্মেন্টসের পর এটিই দ্বিতীয় বৃহত্তম কর্মসংস্থান সৃষ্টিকারী খাত। এ খাতে প্রায় ৬০ লাখ মানুষ জড়িত। কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জনে তিনি পোল্ট্রি বোর্ড গঠনের যৌক্তিকতা তুলে ধরেন তার গবেষণায়। ব্রিডার্স এ্যাসোসিয়েশনের ২০১৪ সালের হিসাব অনুযায়ী মুরগির মাংসের দৈনিক চাহিদা ১ হাজার ৪০০ মেট্রিক টন অথচ উৎপাদিত হয় এক হাজার ৫০০ মেট্রিক টন। ডিমের দৈনিক চাহিদা এক কোটি ৫০ লাখ পিস, সেখানে দৈনিক উৎপাদন হয় এক কোটি ৬০ লাখ পিস। একদিন বয়সী মুরগির বাচ্চার সাপ্তাহিক চাহিদা ৮৫ লাখ পিস, উৎপাদন ৯৫ লাখ পিস। ভোক্তা একটি ডিম কিনছেন সাত টাকায় যেখানে উৎপাদন খরচ প্রায় ছয় দশমিক ৫০ টাকা। খামারিরা প্রতিটি ডিম বিক্রি করছে মাত্র পাঁচ দশমিক ৫০ থেকে পাঁচ দশমিক ৭৫ টাকায়। সূত্র জানায়, বাংলাদেশে পোল্ট্রি শিল্পের শুরুটা মোটেও আশাব্যঞ্জক ছিল না। সাধারণ মানুষ পোল্ট্রির ডিম কিংবা ব্রয়লার মুরগির মাংস খেতেই চাইত না। পোল্ট্রির মাংস যে কতটা সুস্বাদু, নরম এবং স্বাস্থ্যসম্মত তা বোঝাতে শুরুর দিকের উদ্যোক্তাদের অতিথি ডেকে এনে রান্না করা মাংস পরিবেশনও করতে হয়েছে। আশির দশকে এ শিল্পে বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল মাত্র ১ হাজার ৫শ’ কোটি টাকা। আর বর্তমানে এ শিল্পে বিনিয়োগের পরিমান ২৫ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। পোল্ট্রি উদ্যোক্তা ও খামারিদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও ত্যাগ এবং সরকারের আন্তরিক সহযোগিতার কারণেই এ অসাধ্য অর্জন সম্ভব হয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। মাত্র তিন যুগের ব্যবধানে সম্পূর্ণ আমদানি-নির্ভর খাতটি এখন অনেকটাই আত্ম-নির্ভরশীল। বর্তমানে পোল্ট্রি মাংস, ডিম, একদিন বয়সী বাচ্চা এবং ফিডের শতভাগ চাহিদা মেটাচ্ছে বাংলাদেশের পোল্ট্রি শিল্প। এখানে যেসব মানুষের জীবন-জীবিকা জড়িত, তার প্রায় ৪০ শতাংশই নারী। গ্রামীণ অর্থনীতিতে, নারীর ক্ষমতায়নে কৃষির পরই সবচেয়ে বড় অবদান রাখছে বাংলাদেশের পোল্ট্রি শিল্প। বর্তমানে সারাদেশে প্রায় ৬৫-৭০ হাজার ছোট-বড় খামার রয়েছে। এছাড়াও আছে ব্রিডার ফার্ম, হ্যাচারি, মুরগির খাবার তৈরির কারখানা। পোল্ট্রি শিল্পকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে লিংকেজ শিল্প, কাঁচামাল ও ওষুধ প্রস্তুতকারক এবং সরবরাহকারি প্রতিষ্ঠান। জাতীয় অর্থনীতিতে পোল্ট্রি শিল্পের অবদান প্রায় ২ দশমিক ৪ শতাংশ। তবে এ পরিমাণ ক্রমশই বাড়ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর দেয়া তথ্য অনুযায়ী আগামী ২০২০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের জনসংখ্যা দাঁড়াবে প্রায় ১৬ কোটি ৭৩ লাখ। খাত সংশ্লিষ্টদের মতে, বর্ধিত জনসংখ্যার খাদ্য ও পুষ্টি চাহিদা পূরণ করতে হলে পোল্ট্রি শিল্পের আকার আরও বাড়াতে হবে। কারণ এটিই একমাত্র খাত যা ভার্টিক্যালি (উপর দিকে) বাড়ানো সম্ভব। বাংলাদেশ পোল্টি শিল্প সমন্বয় কমিটির (বিপিআইসিসি) আহ্বায়ক মসিউর রহমান জানান, গুরুত্ব বিবেচনায় এ শিল্পটি এখনও তার যথাযথ আসন পায়নি। নীরবে নিভৃতেই পোল্ট্রি শিল্প বড় হচ্ছে। বর্তমানে বাংলাদেশের মোট মাংসের চাহিদার ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশই এ শিল্প থেকে আসছে। বর্তমান বাজারে যে পরিমাণ ডিম, মুরগি, বাচ্চা এবং ফিডের প্রয়োজন তার শতভাগ এখন দেশীয়ভাবেই উৎপাদিত হচ্ছে। খামার ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন, পোল্ট্রি পণ্যের গুণগত মান বাড়ানো, নিরাপদ পোল্ট্রিজাত পণ্য উৎপাদন, ভোক্তার অধিকার সংরক্ষণ, খামারি ও উদ্যোক্তার অধিকার সংরক্ষণ, পোল্ট্রি শিল্পের সমস্যা চিহ্নিতকরণ, এ খাতের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষ জনশক্তি তৈরি, সাধারণ মানুষের মাঝে ডিম ও মুরগির মাংস সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানো, ডিম ও মুরগির মাংসের কনজাম্পশন বাড়ানো, বিনিয়োগকে উৎসাহিত করা প্রভৃতি বিষয়কে মাথায় নিয়ে আমরা এ শিল্পের পরিপূর্ণ বিকাশে কাজ করে যাচ্ছি। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত করার জন্য সর্বাত্মক কাজ করছেন। আমরা একাজে সহযোগী হতে চাই। পোল্ট্রি শিল্পে ২০২১ সাল নাগাদ ৫৫ থেকে ৬০ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ হবে, যদি সরকারের সহযোগিতা আমাদের সাথে থাকে। আমরা আশাবাদী এ লক্ষ্য আমরা সম্মিলিত প্রচেষ্টায় অর্জন করতে পারব। ব্রিডার্স এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি ফজলে রহিম খান শাহরিয়ার জানান, দেশে বর্তমানে মুরগির মাংসের দৈনিক উৎপাদন প্রায় ১ হাজার ৭০০ মেট্রিক টন। প্রতিদিন ডিম উৎপাদিত হচ্ছে প্রায় দুই থেকে সোয়া দুই কোটি। একদিন বয়সী মুরগির বাচ্চার সাপ্তাহিক উৎপাদন প্রায় এক কোটি। ফিড ইন্ডাস্ট্রিজ এ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মনসুর হোসেন বলেন, পোল্ট্রি ফিডের বার্ষিক উৎপাদন ২৭ লাখ মেট্রিক টন। এর মধ্যে বাণিজ্যিক ফিড মিলে উৎপাদিত হচ্ছে প্রায় ২৫ দশমিক ৫০ লাখ মেট্রিক টন এবং লোকাল উৎপাদন প্রায় ১ দশমিক ৫০ লাখ মেট্রিক। তিনি বলেন, বর্তমান বাজারে মুরগির মাংস ও ডিম সবচেয়ে নিরাপদ খাবার। মুরগির বিষ্টা দিয়ে এখন বায়োগ্যাস ছাড়াও তৈরি হচ্ছে জৈব সার। সূত্র জানায়, দেশের পোল্ট্রি শিল্প বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। পোল্ট্রি শিল্প সংশ্লিষ্টদের কথা থেকেই বেরিয়ে এসেছে এসব তথ্য। পোল্ট্রি শিল্পের সাতটি সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত বিপিআইসিসি’র আহ্বায়ক মসিউর রহমান বলেন, মাত্র তিন দশক আগেও পোল্ট্রি একটি শতভাগ আমদানি নির্ভর খাত ছিল। কয়েক বছর আগে সরকার এ শিল্পখাতটিকে কর অব্যাহতি সুবিধা প্রদান করে। সরকার প্রদত্ত এ সুবিধার কারণেই ২০০৭, ২০০৯ এবং ২০১১ সালে বার্ড ফ্লু’র ভয়াবহ সংক্রমণে এ শিল্পের প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি এবং প্রায় ৫০ শতাংশ খামার বন্ধ হওয়ার পরও এ শিল্পের অগ্রগতি থেমে থাকেনি। ২০১৪-১৫ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণায় পোল্ট্রি শিল্পের কর অব্যাহতি সুবিধা ২০১৯ সাল পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়, যদিও আমাদের দাবি ছিল ২০২৫ সাল পর্যন্ত। কিন্তু চলতি অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় কর অব্যাহতির কোন ঘোষণা আসেনি বরং বেশ কিছু অত্যাবশ্যকীয় খাতে কর আরোপ করা হয়েছে, যা পোল্ট্রি শিল্পের অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করছে এবং স্পর্শকাতর এ শিল্পে বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত করবে। তিনি বলেন, বার্ড ফ্লু’র কারণে অর্ধেকের বেশি খামারি এ পেশা ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। খামারের সংখ্যা এক লাখ ২০ হাজার থেকে কমে দাঁড়িয়েছিল মাত্র ৪০ থেকে ৫০ হাজারে। বর্তমানে অনেক প্রচেষ্টার পর তা প্রায় ৭০ হাজারে উন্নীত করা সম্ভব হয়েছে। নতুনভাবে কর আরোপ এ শিল্পে আবারও বিপর্যয় নেমে আসবে। পোল্ট্রি খাতে আর একটি চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, চলতি অর্থবছর থেকে পোল্ট্রি শিল্পের উপর আয়কর, বেশকিছু কাঁচামাল আমদানির ক্ষেত্রে শুল্ক, অগ্রিম আয়করসহ (এআইটি) আরও বেশকিছু রেগুলেশনস নতুন করে আরোপিত হয়েছে। বিপিআইসিসি’র যুগ্ম-আহ্বায়ক শামসুল আরেফিন খালেদ বলেন, মূল চ্যালেঞ্জটা হচ্ছে পোল্ট্রি পণ্যের দাম ক্রেতার জন্য সহনীয় রাখা কিংবা প্রাণিজ আমিষের মধ্যে সবচেয়ে সস্তায় ডিম ও মুরগির মাংসের সরবরাহ নিশ্চিত করা। দাম সহনীয় রাখা তখনই সম্ভব যখন অভ্যন্তরীণ উৎস থেকেই অধিকাংশ কাঁচামালের চাহিদা মিটবে, প্রয়োজনীয় কাঁচামাল আমদানির ক্ষেত্রে কোন শুল্ক আরোপ করা হবে না, চাহিদা পূরণ ও উৎপাদন বাড়ানোর স্বার্থে সরকার ক্ষেত্র বিশেষে প্রণোদনা প্রদান করবে, নতুন করে কোন করের বোঝা বাড়বে না। মোটকথা উৎপাদন খরচ বাড়বে না, প্রসেসড ফুডের মার্কেট বাড়বে, রফতানির মাধ্যমেও আয় বাড়বে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, কাঁচামালের মধ্যে কেবলমাত্র ভুট্টাই দেশীয়ভাবে উৎপন্ন হচ্ছে, তাও মোট চাহিদার মাত্র ৪০ শতাংশ। বাকি সবকিছ্ইু আমদানি করতে হচ্ছে। হাতেগোনা কিছু ওষুধ দেশে তৈরি হচ্ছে, বেশিরভাগই আসছে বাইরে থেকে। কাঁচামাল আমদানির ক্ষেত্রে নতুন করে শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। আয়কর এবং অগ্রিম আয়কর আরোপ করা হয়েছে। কাস্টমস জটিলতায় বন্দরে মাল আটকে পড়ে থাকছে। বাজার ব্যবস্থায় মধ্যস্বত্ব¡ভোগীদের নিয়ন্ত্রণ বাড়ছে। ব্যাংকের সুদের হারও বেশি। বিদেশী কোম্পানিগুলোর সাথে দেশীয় খামারিরা প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না। কাজেই সবার জন্য লেবেল প্লেইং ফিল্ড নেই। বার্ড ফ্লু’র ভ্যাকসিনের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিয়ে জটিলতা নতুন করে বেড়েছে। ১৯৯৬ সালে পোল্ট্রি খামারের জন্য ব্যবহৃত জমির খাজনা ছিল প্রতি শতাংশে এক টাকা দশ পয়সা। ২০১৫ সালের জুন মাসে প্রকাশিত এক সার্কুলারে খাজনার পরিমাণ প্রতি শতাংশে দুই টাকা নির্ধারণ করা হয়। ২০১৫ সালের অপর এক সার্কুলারের মাধ্যমে বর্তমানে শতাংশ প্রতি খাজনা ১৫০ টাকা দাবি করা হচ্ছে। এ ধরনের সিদ্ধান্ত পোল্ট্রি খামার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অন্তরায় হিসেবে কাজ করছে। পোল্ট্রি বীমা, পোল্ট্রি বোর্ড গঠন, জাতীয়ভাবে পোল্ট্রি সপ্তাহ উদযাপনের জন্য সরকারের কাছে বহুদিন থেকেই অনুরোধ জানানো হলেও কোন উদ্যোগ নেই। নিরাপদ ডিম ও মুরগির মাংস উৎপাদনে উদ্যোক্তারা আন্তরিক প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। কিন্তু কিছু অসাধু ব্যবসায়ীর কারণে তারা ক্ষতির শিকার হচ্ছেন। সম্প্রতি ‘২০২১ সালের প্রাণিজ আমিষের চাহিদা পূরণের চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক একটি নীতি-নির্ধারণীমূলক কর্মশালার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী মোহাম্মদ ছায়েদুল হক এ বিষয়ে বলেন, ব্যাংক সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে না এলে পোল্ট্রি শিল্পের বিকাশ সম্ভব হবে না। ১২ থেকে ১৫ শতাংশ সুদ দিয়ে শিল্প করা কঠিন। ডিম, দুধ, মাছ ও মাংস সকল বয়সের মানুষ বিশেষ করে নারী ও শিশুর জন্য খুবই দরকারি খাদ্য। তবে ২০২১ সাল নাগাদ প্রাণিজ আমিষের চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে পোল্ট্রিখাত উল্লেখযোগ্য অবদান রাখবে। সেক্ষেত্রে পুষ্টি-স্বল্পতা কিংবা অপুষ্টি দূর করতে হলে ডিম ও মাংস খাওয়ার পরিমাণ অনেক বাড়াতে হবে। পাশাপাশি স্বল্পমূল্যে প্রাণিজ আমিষের যোগান নিশ্চিত করতে হবে। পোল্ট্রি শিল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন এখাতে অপর চ্যালেঞ্জগুলো হচ্ছে পোল্ট্রি ডিম ও মাংস সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মাঝে এখনও সচেতনতার অভাব। তথ্যানুসন্ধানে দেখা যায়- জাপানের মানুষ বছরে ডিম খায় গড়ে প্রায় ৬০০টি। সেখানে বাংলাদেশের মানুষ খায় মাত্র ৪৫ থেকে ৫০টি ডিম। আমাদের দেশের মানুষ মুরগির মাংস খায় বছরে গড়ে মাত্র তিন দশমিক ৬৫ কেজি। অথচ আমেরিকায় মানুষ খায় বছরে গড়ে প্রায় ৫০ কেজি। উৎপাদন খরচের সাথে বাজারদরের তফাৎ। পোল্ট্রি সংশ্লিষ্টরা বলছেন- বছরের প্রায় চার মাস খামারিদের উৎপাদন খরচের চেয়েও কম মূল্যে ডিম ও মুরগির মাংস বিক্রি করতে হয়। এর অন্যতম একটি কারণ হচ্ছে পাইকারি বাজার ব্যবস্থায় খামারি কিংবা উদ্যোক্তাদের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। খামার থেকে মুরগি ও ডিম পাইকারি বাজার পর্যন্ত আসতে কয়েক ধাপে হাত বদল হয়। খামারিরা অনেকটাই এসকল মধ্যস্বত্ব¡ভোগীদের হাতের পুতুল। তথ্য-উপাত্তের অভাব। পোল্ট্রি খাতটি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অন্তর্ভুক্ত। নাম থেকেই বুঝা যায় এখানে মৎস্য ও পশুসম্পদের প্রাধান্যই বেশি। মৎস্য অধিদফতর এবং প্রাণিসম্পদ অধিদফতর নামে দু’টি পৃথক অধিদফতর থাকলেও পেল্ট্রি বিষয়ক কোন অধিদফতর নেই। ফলে প্রাণিসম্পদ অধিদফতর থেকে কার্যত পোল্ট্রি বিষয়ক তেমন কোন হালনাগাদ তথ্য পাওয়া যায় না। পোল্ট্রি সংশ্লিষ্টরা ন্যূনতম হলেও একটি পোল্ট্রি বোর্ড গঠনের দাবি উত্থাপন করেছেন। ব্রিডার্স এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (বিএবি)-এর মতে, পোল্ট্রি ফিডের অত্যাবশ্যকীয় কাঁচামাল সয়ামিল (এইচ.এস কোড : ১২০৮.১০.০০) এবং অয়েল কেক (এইচ.এস কোড : ২৩০৬.৪১.০০) এর শুল্কহার শূন্য থেকে বাড়িয়ে পাঁচ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছিল চলতি অর্থবছরের বাজেটে। এর ফলে পোল্ট্রি ফিডের দাম অনেকাংশেই বাড়ছে। এগ প্রোডিউসার্স এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইপিএবি) এর সভাপতি তাহের আহম্মেদ সিদ্দিকী বলেন, প্রধানমন্ত্রী খাদ্য নিরাপত্তার পাশাপাশি পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার তাগিদ দিচ্ছেন। এটি নিঃসন্দেহে একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ। আপামর মানুষের পুষ্টি চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে পোল্ট্রি শিল্প অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। মোট প্রাণিজ আমিষের প্রায় অর্ধেকই যোগান দিচ্ছে এ খাত। তাই পুষ্টি চাহিদা নিশ্চিত করতে হলে পোল্ট্রিখাতকে আগের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ এ্যাসোসিয়েশনের (বিপিইএ) এর মহাসচিব ডা. এম.এম খান বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার ২০২১ সাল নাগাদ জনপ্রতি বার্ষিক ডিম খাওয়ার গড় পরিমাণ ১০৪টিতে উন্নীত করার লক্ষ্য নিয়ে কাজ শুরু করেছে। প্রাণিজ আমিষের চাহিদা পূরণে সরকারের এ লক্ষ্য বাস্তবায়ন করতে হলে ২০২১ সাল নাগাদ দৈনিক প্রায় সাড়ে ৪ কোটি ডিম এবং দৈনিক প্রায় ৩ দশমিক ৫ থেকে ৪ হাজার মেট্রিক টন মুরগির মাংস উৎপাদনের প্রয়োজন হবে। বিনিয়োগ দরকার হবে প্রায় ৫০-৬০ হাজার কোটি টাকা। প্রাসঙ্গিক কারণেই বাস্তবসম্মত স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং বিদ্যমান আইন ও নীতিমালা সংশোধনের প্রয়োজন হবে। তাছাড়া নিরাপদ খাদ্য ও ভোক্তার অধিকার নিশ্চিত করতে হলে সামগ্রিকভাবে পোল্ট্রি চেনে আরও বেশি আধুনিকায়ন এবং মানোন্নয়নের প্রয়োজন হবে। তিনি বলেন, এমতাবস্থায় পোল্ট্রি শিল্পের উপর নতুনভাবে কর প্রযুক্ত হলে এ শিল্পের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে, মুরগির ডিম ও মাংসের দাম বৃদ্ধি পাবে এবং এ শিল্পে বিনিয়োগের গতি শ্লথ হয়ে পড়বে।
×