ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সাগরদাঁড়িতে মধুমেলা

‘আমি বাঙাল, আমার বাটি যশোহর’- হৃদয়ের অর্ঘ্যে ঋণ শোধ

প্রকাশিত: ০৫:৩৩, ২৬ জানুয়ারি ২০১৬

‘আমি বাঙাল, আমার বাটি যশোহর’- হৃদয়ের অর্ঘ্যে ঋণ শোধ

সাজেদ রহমান ‘আধুনিকতার প্রবর্তক মাইকেল মধুসূদন দত্ত সাগরদাঁড়ির সন্তান। এখানকার ধুলোমাটি মেখে তিনি মানুষ হয়েছেন। যৌবনে নিজ ধর্ম ত্যাগ করে খ্রীস্টান ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। পরে এক সময় তিনি কলকাতা থেকে সাগরদাঁড়ি এসেছিলেন। সাগরদাঁড়িবাসী তাঁকে তখন আশ্রয় দেয়নি। তিনি সেখান থেকে ফিরে গেছেন। কিন্তু সেই মধুসূদন দত্তকে নিয়ে এখন সাগরদাঁড়ির মানুষের আগ্রহের শেষ নেই। বাঙালীর আগ্রহের শেষ নেই। তাঁকে নিয়ে এখানে এখন মেলা হয়। তিনি বাঙালীকে অনেক কিছু দিয়ে গেছেন। সেই কবির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে হলে তাঁর নামে এখানে একটি বিশ্ববিদ্যালয় হওয়া দরকার।’ কথাগুলো বলছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত গবেষক খসরু পারভেজ। যশোরবাসী সাগরদাঁড়িতে একটি সংস্কৃতি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করার জন্য দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করছেন। ইতোমধ্যে যশোরের ছয়জন এমপির কাছে স্মারকলিপি দেয়া হয়েছে। যশোর-২ আসনের সংসদ সদস্য মনিরুল ইসলাম অবশ্য বিষয়টি জাতীয় সংসদে উপস্থাপনও করেছেন। ১৮২৪ খ্রিস্টাব্দের ২৫ জানুয়ারি (বাংলা ১২ মাঘ) যশোর জেলার কেশবপুর উপজেলার কপোতাক্ষ নদসংলগ্ন সাগরদাঁড়ি গ্রামের ঐতিহ্যবাহী দত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন মাইকেল মধুসূদন। তার বাবা ছিলেন রাজনারায়ণ দত্ত, মা জাহ্নবী দেবী। লেখাপড়ার জন্য মাত্র নয় বছর বয়সে তিনি গ্রাম ছাড়েন। ওঠেন গিয়ে কলকাতায়। ১৮৪৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি স্বেচ্ছায় খ্রীস্টধর্ম গ্রহণ করেন। বিয়ে করেন মাদ্রাজের রেবেকা ম্যাকটাভিসকে। তবে ওই বিয়ে বেশিদিন টেকেনি। পরে বিয়ে করেন এ্যামেলিয়া হেনরিয়েটাকে। ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দের কোন এক সময় তিনি স্ত্রী হেনরিয়েটাকে সঙ্গে নিয়ে সাগরদাঁড়ি আসেন। গাঁয়ের সমাজপতিরা সেদিন তাদের স্বগৃহে প্রবেশ করতে দেয়নি। কপোতাক্ষ নদে নৌকায় বসে থেকে তিনি বিদায় নেন। সেই স্থানের নাম এখন ‘বিদায় ঘাট’। ঊনবিংশ শতাব্দীজুড়ে মধুসূদন দত্ত নিজ গাঁয়ে ছিলেন উপেক্ষিত। বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে ‘যশোর সাহিত্য সংঘ’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান সাগড়দাঁড়িতে প্রতি বছর গিয়ে ২৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠান শুরু করে। এর পর এখানে আসেন শরৎ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বিভুতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, কবি জসীমউদ্দীনসহ সমাজের নানা পেশার বিশিষ্ট ব্যক্তি। আস্তে অস্তে সাগরদাঁড়ি পরিণত হয় ‘মধুতীর্থে’। আওয়ামী লীগ সরকার সাগরদাঁড়িকে ‘মধুপল্লী’ হিসেবে গড়ে তোলে। বর্তমানে সাগরদাঁড়ি একটি মনোরম পিকনিক স্পট। প্রতিদিন অগণিত মানুষ যান সাগরদাঁড়িতে ‘কবিতীর্থ’ দর্শনে। প্রতœতত্ত্ব বিভাগ ইতোমধ্যে মধুকবির বাড়ি সংস্কার করেছে। সরকার সেখানে তৈরি করেছে একটি ডাকবাংলো ও পর্যটন মোটেল। বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী মাইকেল মধুসূদন দত্ত তাঁর জীবদ্দশায় রচনা করেন বাংলা সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ মহাকাব্য ‘মেঘনাদবধ’। এছাড়াও তিনি রচনা করেন কাব্য ‘তিলোত্তমা সম্ভব’, ‘বীরাঙ্গনা’, ‘চতুর্দশপদী কবিতাবলী’, ‘নীতিমূলক কবিতা’, নাটক ‘শর্মিষ্ঠা’, ‘পদ্মাবতী’, ‘কৃষ্ণ কুমারী’, ‘মায়া কানন’, ‘প্রহসন’, ‘বুড়োশালিকের ঘাড়ে রোঁ’ ‘একেই কি বলে সভ্যতা’, উপকথা- ‘রসাল স্বর্ণ লতিকা- ‘অশ্ব ও কুরঙ্গ’, ‘কুক্কট ও মনি’, ‘মেঘ ও চাতক’, ‘সিংহ ও মশকী’। ব্যঙ্গ রচনা- ‘রোগ শয্যায়’, ‘দুর্যোধনের মৃত্যু’ এবং ইংরেজী রচনাবলী ‘দ্য ক্যাপটিভ লেডি’। তবে সাগরদাঁড়ির সবচেয়ে বড় আকর্ষণ সাত দিনব্যাপী ‘মধুমেলা’। ২২ জানুয়ারি এবার মেলার উদ্ধোধন করেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান। উপস্থিত ছিলেন জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ইসামত আরা সাদেক। এছাড়া মেলা উপলক্ষে প্রতিদিন থাকেন দেশের বরেণ্য ব্যক্তিরা। সাত দিনব্যাপী মেলা চলবে ২৭ জানুয়ারি পর্যন্ত। মধুকবির ওপর আলোচনা, সংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, নাটক, যাত্রা প্রতিদিন অনুষ্ঠিত হয়। মধুকবির সমাধিটি আছে কলকাতার পার্ক সার্কাস এলাকায়। তাঁর বংশধররা আছেন এখানে-ওখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। তাঁদের অনেকে বাংলা ভাষাই জানেন না। সাহেব হতে গিয়েও মধুকবি কিন্তু শেষ পর্যন্ত সবকিছু ছাপিয়ে বাঙালী হয়ে উঠেছিলেন। মৃত্যুর মাত্র এক বছর আগে ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে ঢাকার পোগেজ স্কুলে দেয়া এক সংবর্ধনার জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি বাঙাল। আমার বাটি যশোহর।’ যশোরের সাগরদাঁড়ি তাঁকে ত্যাগ করলেও সেদিন তিনি জন্মভূমিকে ত্যাগ করেননি, যার ঋণ সবাই আজ পরিশোধ করছেন হৃদয়ের অকুণ্ঠ অর্ঘ্য দিয়ে। ১৮৭৩ সালের ২৯ জুন কলকাতার আলীপুরের জেনারেল হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন মধুসূদন দত্ত। এর পর কবির ভাইয়ের মেয়ে কবি মানকুমারী বসু ১৮৯০ সালে প্রথম সাগরদাঁড়িতে আসেন। সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় জেলা প্রশাসন প্রতি বছর আয়োজন করছে সপ্তাহব্যাপী মধুমেলার। এই মেলাকে ঘিরে এরই মধ্যে উৎসব আমেজের সৃষ্টি হয়েছে কেশবপুরসহ আশপাশের এলাকায়। তবে সবকিছু ছাপিয়ে এবার মধুকবির জন্মজয়ন্তী উৎসবকে ঘিরে কবির জন্মস্থানে মধুসূদন সংস্কৃতি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবিতে সোচ্চার হয়েছেন সর্বস্তরের মানুষ। এ দাবিতে গঠিত হয়েছে আন্দোলন কমিটি। যশোরবাসীর প্রাণের দাবি মহাকবি মধুসূদন দত্তের নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের। মধুকবির নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা বলেছেন যশোর-৬ আসনের এমপি জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ইসামত আরা সাদেকও। পাশাপাশি মধু গবেষণা সেল ও লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠার কথাও বললেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি মধুকবির জন্মদিন, মৃত্যুদিবস পালন ছাড়াও তাঁকে ঘিরে গবেষণা আরও বিস্তৃত করার দাবিও মধু গবেষকদের। মধুকবিকে বিস্ময়কর প্রতিভা হিসেবে চিহ্নিত করে তাঁর সাহিত্যকর্ম সংরক্ষণ ও গবেষণার কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমানও। মাইকেল মধুসূদন দত্তের স্মৃতিবিজড়িত কপোতাক্ষ’র পাড়ে কবির বাস্তুভিটায় একটি সংস্কৃতি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করে কবির প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করা হবে- এমন প্রত্যাশা সকলের।
×