ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

সিঙ্গাপুর থেকে ফেরত ২৬ বাংলাদেশীর বারো জনকে ছেড়ে দেয়া হলো কেন?

প্রশ্নের মুখে জঙ্গী দমনে বাংলাদেশের দক্ষতা বিশ্বাসযোগ্যতা

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ২৫ জানুয়ারি ২০১৬

প্রশ্নের মুখে জঙ্গী দমনে বাংলাদেশের দক্ষতা বিশ্বাসযোগ্যতা

শংকর কুমার দে ॥ ইসলামী জিহাদের নামে বিদেশের মাটিতে বসে দেশের সরকার উৎখাতের স্বপ্ন দেখেছিল যারা তাদের অনেককে ছেড়ে দেয়ায় রীতিমতো হৈচৈ শুরু হয়েছে। বাংলাদেশে জঙ্গী দমনের দক্ষতা ও বিশ্বাসযোগ্যতার বিষয়টি আন্তর্জাতিক মহলে সন্দেহের চোখে পড়তে পারে। সিঙ্গাপুর সরকারের রিপোর্টে গুরুতর অভিযোগ এনে বলা হয়, আটক ২৬ বাংলাদেশী আইএস, আল কায়েদার সঙ্গে জড়িত। অথচ বাংলাদেশে ফেরত আসার পর জানানো হলো, তারা আইএস বা আল কায়েদার সঙ্গে জড়িত নয়। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশে ২৬ জনকে ফেরত পাঠানোর পর তাদের মধ্যে ১২ জনকে জঙ্গী নয় এমন সার্টিফিকেট দিয়ে ছেড়ে দিয়েছে ঢাকার গোয়েন্দারা। প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, সিঙ্গাপুর সরকারের রিপোর্ট সঠিক, নাকি বাংলাদেশের তদন্তকারী গোয়েন্দাদের রিপোর্ট সঠিক? বাংলাদেশ ও সিঙ্গাপুর- দুই দেশে একই ব্যক্তি সম্পর্কে দুই ধরনের ফলে বাংলাদেশের জঙ্গী দমনের বিষয়টিও আন্তর্জাতিক মহলে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে ওঠার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন অপরাধ বিশেষজ্ঞরা। সিঙ্গাপুর থেকে ২৬ জনকে জঙ্গী সম্পৃক্ততার অভিযোগে দেশে ফেরত পাঠানোর পর ১২ জনকে পারিবারিক জিম্মায় ছেড়ে দেয়ায় তদন্তের বিশ্বাসযোগ্যতা ও দক্ষতার বিষয়টি সামনে চলে এসেছে। কারণ পারিবারিক জিম্মায় ছেড়ে দেয়া হয়েছে যাদের তাদের বিরুদ্ধেও গুরুতর জঙ্গী সম্পৃক্ততার অভিযোগ করেছে সিঙ্গাপুর সরকার। আর ১৪ জনকে গ্রেফতার দেখানো আবদুল্লাহপুর বাসস্ট্যান্ডের পাশের খন্দকার ফিলিং স্টেশন এলাকায়। সিঙ্গাপুর থেকে গ্রেফতার করে তাদের দেশে পাঠানো হয় গত ডিসেম্বরে। আর দেশে তাদের গ্রেফতার দেখানো হয় জানুয়ারিতে, তাও আবার আবদুল্লাহপুরের ফিলিং স্টেশন এলাকা থেকে। সিঙ্গাপুর থেকে ফেরত পাঠানো হয় ২৬ জনকে। গ্রেফতার দেখানো হয় ১৪ জনকে, বাকি ১২ জনকে ছেড়ে দেয়া হয় পরিবারের জিম্মায়। উত্তরা-পূর্ব থানায় মামলা হয় ১৪ জনের বিরুদ্ধে। ঢাকা মহানগর পুলিশের মুখপাত্র যুগ্ম কমিশনার (গোয়েন্দা) মনিরুল ইসলাম বলেছেন, সিঙ্গাপুর থেকে ফেরত পাঠানো ২৭ বাংলাদেশীর সঙ্গে জঙ্গী সংগঠন আল কায়েদা ও আইএসের কোন সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়নি। সিঙ্গাপুরে আটক ২৭ জনের মধ্যে ১৪ জন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের মতাদর্শে বিশ্বাসী। এই ১৪ জন সিঙ্গাপুরের এ্যাঙ্গুলিয়া নামে একটি মসজিদে প্রায়ই একত্রিত হতেন। ২০১৫ সালের নবেম্বর ও ডিসেম্বরে জঙ্গী সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে মোট ২৬ জনকে ব্ল্যাকলিস্টেড করে বাংলাদেশে ফেরত পাঠায় সিঙ্গাপুর সরকার। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তাদের মধ্যে ১৪ জনের সঙ্গে জঙ্গীদের সংশ্লিষ্টতা পেয়েছি। সিঙ্গাপুরে আটক ২৭ বাংলাদেশীকে ফেরত পাঠানোর পর আইএস বা আল কায়েদার সঙ্গে জড়িতদের জিজ্ঞাসাবাদে তাদের কাছ থেকে হামলার সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য পাওয়া যায়নি বলে জানান ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম। অপর ১২ জনকে পারিবারিক জিম্মায় ছেড়ে দেয়ার প্রসঙ্গে বলেন, তারা নজরদারিতে আছেন। ঢাকার গোয়েন্দারা আটক ২৭ বাংলাদেশীদের জঙ্গী সম্পৃক্ততার বিষয়টি এ ধরনের হাল্কাভাবে নিলেও সিঙ্গাপুর সরকার কিন্তু নিয়েছে খুবই গুরুত্বের সঙ্গে গভীর তদন্তের মাধ্যমে। সিঙ্গাপুর সরকার তাদের দেশে আটক ২৭ বাংলাদেশীর জঙ্গী সম্পৃক্ততার সম্পর্কে নিশ্চিত হতে দীর্ঘদিন ধরে নজরদারি, তদন্ত করে এতই নিশ্চিত হন যে, সিঙ্গাপুর সরকারের প্রধানমন্ত্রীর ফেসবুকে পোস্ট প্রদান, সিঙ্গাপুর সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতি প্রকাশ, সিঙ্গাপুরের বহুল প্রচারিত গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকাগুলোতে তাদের ছবিসহ প্রতিবেদন প্রকাশ পায়। এতে আটক বাংলাদেশীদের সম্পর্কে ইসলামিক স্টেট (আইএস), আল কায়েদার অনুসারী বলে উল্লেখ করে বাংলাদেশে সশস্ত্র জিহাদ, হামলার পরিকল্পনার অভিযোগ করা হয়। এমনকি সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী লি সিয়েন লুং গত ২০ জানুয়ারি আটক ২৭ বাংলাদেশীকে সিঙ্গাপুরের নিরাপত্তার জন্য হুমকি বলে ফেসবুকে একটি পোস্ট দেন, যা সিঙ্গাপুরের স্ট্রেইট টাইমস পত্রিকায় উল্লেখ করা হয়। সিঙ্গাপুর সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রকাশিত বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ২০১৫ সালের ১৬ নবেম্বর থেকে ১ ডিসেম্বরের মধ্যে জঙ্গী সংগঠন আল কায়েদা ও ইসলামিক স্টেটের (আইএস) অনুগত ২৭ বাংলাদেশীকে আটক করে সিঙ্গাপুর পুলিশ। আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংগঠন আল কায়েদা ও ইরাক-সিরিয়ায় সক্রিয় জঙ্গী সংগঠন ইসলামিক স্টেটের (আইএস) মতাদর্শ সমর্থন করে সপ্তাহে একবার বৈঠকে মিলিত হতেন তারা। গোপন বৈঠকে তারা সশস্ত্র জিহাদ নিয়ে আলোচনা করতেন। দেশে ফিরে কিভাবে সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ করা যায়, তারা বৈঠকে তা নিয়েও আলোচনা করতেন। ২৬ জনের অনেকেই মধ্যপ্রাচ্যে গিয়ে জিহাদী কর্মকা-ে অংশ নেয়ার স্বপ্ন দেখতেন। দেশে ফিরে এসে সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র জিহাদে অংশ নেয়ার ইচ্ছা ছিল আটক বাংলাদেশীদের। সিঙ্গাপুর সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রকাশিত বিবৃতিটি আটক ২৭ বাংলাদেশীর ছবিসহ স্ট্রেইট টাইমসসহ সিঙ্গাপুরের মিডিয়ায় গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করা হয়। এ বিষয়ে জঙ্গী বিশ্লেষকদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, বাংলাদেশে আইএস, আল কায়েদা, দেশী জঙ্গী তৎপরতার বিষয়টি নিয়ে অভিযোগ করে আসছে বেশকিছু প্রভাবশালী রাষ্ট্র। এর মধ্যে আমেরিকাসহ বিভিন্ন রাষ্ট্র থেকে জঙ্গীবিরোধী অভিযানে সহায়তা দেয়ার প্রস্তাবও করা হয়। আর এবার সিঙ্গাপুর সরকার ২৬ বাংলাদেশীকে জঙ্গী সম্পৃক্ততায় জড়িত থাকার বিষয়ে সাক্ষ্য, প্রমাণ, আলামতসহ গ্রেফতার করে ফেরত পাঠানোর পর ১২ জনকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে, ১৪ জনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক জঙ্গী সম্পৃক্ততার অভিযোগটি বাদ দেয়া হয়েছে। এসব ঘটনা বিদেশীরা নিবিড় পর্যবেক্ষণ করবে, সন্দেহের চোখে দেখবে, এটাই স্বাভাবিক। আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংগঠনের অভিযোগে বিদেশ থেকে বহিষ্কৃৃত, ফেরত পাঠানোর বিষয়টিকে আরও গভীরভাবে তদন্ত করে দেখা না হলে অদূর ভবিষ্যতে এরাই বিপদ ডেকে আনতে পারে বলে মনে করেন জঙ্গী বিষয়ক বিশ্লেষকরা।
×