ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মেলার আশপাশে দীর্ঘ যানজট

বাণিজ্যমেলা কানায় কানায় পূর্ণ, ভিড় সামলাতে দোকানিরা হিমশিম

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ২৩ জানুয়ারি ২০১৬

বাণিজ্যমেলা কানায় কানায় পূর্ণ, ভিড় সামলাতে দোকানিরা হিমশিম

রহিম শেখ ॥ ক’দিন আগের বৃষ্টিতে রাজধানীতে বইছে শীতের হিমেল হাওয়া। শীতের এমন দিনেও বাণিজ্যমেলামুখী ছিলেন নগরবাসী। শুক্রবার ছুটির দিন থাকায় সকাল থেকেই দর্শনার্থী ও ক্রেতাদের স্রোত ছিল মেলা প্রাঙ্গণের দিকে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মেলায় রীতিমতো মানুষের ঢল নামে। বিকেলের দিকে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে ক্রেতা-দর্শনার্থীদের মেলায় প্রবেশ করতে দেখা যায়। সন্ধ্যায় গোটা মেলা প্রাঙ্গণ হয়ে ওঠে রীতিমতো জনসমুদ্র। শেষ মুহূর্তের পছন্দের পণ্য কিনতে দিনভর স্টল ও প্যাভিলিয়নগুলোতে ছিল উপচেপড়া ভিড়। অনেক ক্রেতাই ছুটে বেড়িয়েছেন বিশেষ ছাড় কিংবা ডিসকাউন্টে পণ্য কিনতে। ছুটির দিনে ক্রেতার বাড়তি চাপে বিক্রি নিয়ে সন্তুষ্টির কথা জানালেন বিক্রেতারা। শুক্রবার সরেজমিন বাণিজ্যমেলা ঘুরে দেখা যায়, দুপুরের পর থেকেই মেলা প্রাঙ্গণ মানুষের ভিড়ে কানায় কানায় পূর্ণ ছিল। বিকেল হতে না হতেই মেলার সামনের প্রাঙ্গণও পূর্ণ হয়ে যায়। শেষ বিকেলে আগত যারা তাদের প্রায় ঘণ্টাখানেক দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে প্রবেশ টিকেট কাটতে হয়েছে। মেলার আশপাশের সড়কে দুপুরের পর থেকে যানজট লেগে ছিল। অনেকেই ফার্মগেট থেকে হেঁটে মেলায় আসেন। আর এ সড়ক থেকে মেলার প্রধান ফটক পর্যন্ত ছিল মানুষের ঢল। আগারগাঁওয়ের আইডিবি ভবন থেকে মেলার প্রবেশপথ পর্যন্ত ছিল দীর্ঘ লাইন। অন্যদিকে গণপরিবহনে যাওয়া মানুষ মেলা প্রাঙ্গণের কাছাকাছি নেমে হেঁটে যেতে পারলেও বেশি ভোগান্তি হয়েছে নিজস্ব বাহনে করে আসা দর্শনার্থীদের। এদিকে মেলার প্রবেশপথে ব্যাপক লোক সমাগমে হিমশিম খেতে হয় শৃঙ্খলার দায়িত্বে থাকা কর্মীদের। বিকেলের পর থেকে টিকেট কাউন্টারের সামনে তৈরি হয় লম্বা লাইন ও জটলা। শুক্রবার দর্শক বাড়ায় দুপুরের পর থেকে স্টল ও প্যাভিলিয়নগুলোতে ছিল ক্রেতা-দর্শনার্থীদের প্রচ- ভিড়। ক্রেতার বাড়তি চাপে দিনভর স্টল মালিকদের হিমশিম খেতে হয়। কয়েকজন বিক্রয় প্রতিনিধি জনকণ্ঠকে জানান, মেলার শেষ সময়ে প্রকৃত ক্রেতার সংখ্যা বেড়েছে। যাঁরা এখন মেলায় আসছেন, সবাই পণ্য কিনছেন। এদিকে মেলার সময়ের পরিধি কমতে থাকায় বিশেষ মূল্যছাড় ও উপহার দিয়ে ক্রেতা আকর্ষণের চেষ্টা করছেন দোকানিরা। প্রায় প্রতিটি স্টল ও প্যাভিলিয়নে নগদ ক্রয়ের ওপর বিভিন্ন অঙ্কের ছাড়, নানা ধরনের উপহার, স্ক্র্যাচকার্ডে পণ্য জিতে নেয়ার সুযোগ, প্যাকেজ অফারে বিভিন্ন অঙ্কের টাকা ছাড় দিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। ফলে ছুটির দিনগুলোতে বিক্রির মাত্রা বাড়লেও অন্যদিনগুলোতে খুব বেশি বিক্রি করতে পারছেন না বিক্রেতারা। শুক্রবার বাণিজ্য মেলায় দর্শনার্থীদের সবচেয়ে বেশি ভিড় দেখা গেছে গৃহস্থালি, প্লাস্টিক, ফার্নিচার ও ইলেক্ট্রনিক্সের স্টল ও প্যাভিলিয়নগুলোতে। বিক্রির তালিকায় আরও আছে কসমেটিক্স, পাটজাত পণ্য, চামড়াজাত পণ্য, মেশিনারিজ, কার্পেট, জুয়েলারি, জুতা, কাপড়সামগ্রী ইত্যাদি। সব মিলিয়ে ছোট-বড় সবার প্রয়োজনীয় পণ্যের কোন কমতি নেই। পাশাপাশি রয়েছে শিশুদের বিনোদনের জন্য নাগরদোলা। শুক্রবার বাণিজ্যমেলার প্লাস্টিক পণ্যের স্টল ও প্যাভিলিয়নগুলোতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারী ক্রেতা দেখা গেছে। বেঙ্গল, আরএফএল, এনপলি, তানিন, গাজীসহ বিভিন্ন পাস্টিক পণ্যের স্টলে সারাদিনই ভিড় লেগেছিল। ক্রেতাদে সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাণিজ্যমেলায় প্লাস্টিকের বাটি, মগ, জগ, চেয়ার, টেবিল, টুল ও বাচ্চাদের তৈরি খেলনা সবচেয়ে বেশি বিক্রি হচ্ছে। মেলায় ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠানগুলো ছাড়াও বিভিন্ন দোকানে অন্য পণ্যের পাশাপাশি প্লাস্টিকের মগ, জগ, থালাবাটি, পানির পাত্র বিক্রি হচ্ছে। এসব দোকানে মূল্যছাড় দিয়ে ক্রেতা আকর্ষণের চেষ্টা চলছে। এবার মেলায় গৃহস্থালি পণ্য বিক্রি হয়েছে সর্বাধিক। দিল্লী ও কিয়াম এ্যালুমিনিয়ামসহ কয়েকটি স্টলে ক্রেসার ঠাসা ভিড় লক্ষ্য করা গেছে। অন্য বছরের চেয়ে এবার এ্যালুমিনিয়ামের তৈজসপত্রের আধিক্য সবচেয়ে বেশি বলে জানিয়েছেন বিক্রেতারা। বাণিজ্যমেলায় অন্য সব পণ্যের তুলনায় ইলেকট্রনিক পণ্যের চাহিদাও বেশ। শুক্রবার ওয়ালটন, রানার, যমুনা, সনিসহ বিভিন্ন নামী দামী প্যাভিলিয়নে সারাদিনই ভিড় লেগেছিল। এদিকে দেশী-বিদেশী ফ্রিজ ও রেফ্রিজারেটরেও ছিল ক্রেতাদের আকর্ষণ। দেশীয় ব্র্যান্ড ওয়ালটন, যমুনা, ভিশন ছাড়াও বিদেশী ব্র্যান্ড শার্প, সিমেন্স, সিঙ্গার, গোদরেজ, র‌্যাংগস, এলজি ফ্রিজের প্যাভিলিয়নের ক্রেতা দর্শকদের ভিড় লক্ষ্য করা যায়। তবে বিদেশী পণ্যের চেয়ে দেশী পণ্যের দাম তুলনামূলক কম এব মানেও ভাল হওয়ায় সেদিকেই বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছেন তারা। বরাবরের মতো এবারো মেলায় ক্রেতা চাহিদার শীর্ষে রয়েছে ইলেকট্রনিক্স পণ্যের দেশীয় ব্র্যান্ডগুলো। যার সিংহভাগ বাজার শীর্ষ ব্র্যান্ড ওয়ালটনের দখলে। ওয়ালটন প্যাভিলিয়নের কর্মকর্তারা জানান, এবারের মেলায় গ্রাহকদের চাহিদা ও রুচির ভিন্নতা অনুযায়ী আকর্ষণীয় ও উচ্চ মানসম্পন্ন ৪ শতাধিক মডেলের বিভিন্ন ধরনের প্রযুক্তি পণ্য প্রদর্শন করছে ওয়ালটন। এরমধ্যে রয়েছে প্রায় অর্ধশত নতুন মডেলের পণ্য। মেলায় আগত দর্শনার্থীরা জানান, একসময় প্রযুক্তি পণ্যের সমস্ত ফোকাস ছিল বিদেশী ব্র্যান্ডগুলোর উপর। এখন সে জায়গা দখল করে নিয়েছে ওয়ালটন। এটা দেশের জন্য একটি ইতিবাচক দিক। গৃহবধূ ফারহানা ইয়াসমিন বলেন, এখন মেলায় আসলে সবাই ভাবে একবার ওয়ালটন ঘুরে যাই, দেখি কি কি নতুন প্রযুক্তি পণ্য আসল। মেলায় ওয়ালটন প্যাভিলিয়নের বিক্রয়কর্মীরা জানান, এবার ক্রেতা-দর্শনার্থীর উপস্থিতি ও বিক্রির পরিমাণ দুটোই বেশ সন্তোষজনক। এরই মধ্যে মেলায় ক্রেতাদের নজর কেড়েছে ইনভার্টার প্রযুক্তির তিনটি নতুন মডেলের (৫২৬ লিটার, ৫১২ লিটার ও ৪৩০ লিটার) রেফ্রিজারেটর ও দুটি নতুন মডেলের ডিপ ফ্রিজ, এন্ড্রয়েড স্মার্ট মডেলের নতুন তিনটি (৪৩ ইঞ্চি, ৪৯ ইঞ্চি ও ৫৫ ইঞ্চি) এলইডি টেলিভিশন, রুটি মেকার, ডোনাট মেকার, স্যান্ডউইচ মেকার, কেক মেকার, ট্রাভেল ব্লেন্ডার, ইলেকট্রিক্যাল স্যুইচ, সকেট ও সিলড লেড এ্যাসিড রিচার্জেবল ব্যাটারি। বিশেষ করে, রফতানির জন্য তৈরি করা ৩ দরজার ৫২৬ লিটারের নো-ফ্রস্ট ফ্রিজটি দৃষ্টি কেড়েছে ক্রেতাদের। বাণিজ্যমেলায় বেশ কয়েকটি ফুড ও বেভারেজ কোম্পানির স্টল ঘুরে দেখা যায়, নানারকম বাহারি বিস্কুট, জুস, চানাচুর, চিপ্স নজরকাড়া মোড়কে বিশেষ প্যাকেজ কিনতে রীতিমতো লাইন দিয়েছেন ক্রেতারা। মিরপুর থেকে মেলায় আসা গৃহিণী আতিকা রহমান জনকণ্ঠকে জানান, মেলা শুরুর পর বেশ ক’বার মেলায় আসা হয়েছে। কিন্তু খুব একটা কেনা হয়নি। শেষ বারের মতো এসে অনেক কেনাকাটা করেছি। আরেক ক্রেতা মিরপুরের নওশীন জামান জানান, গত বছর হরতাল ও অবরোধের কারণে একদিনও মেলায় আসতে পারিনি। এবার দেশের রাজনৈতিক অবস্থা ভাল থাকায় বেশ কয়েকবার মেলায় এসে ঘুরে ঘুরে পণ্য দেখেছি। মেলা শেষ হওয়ার পথে তাই অনেক কিছু কিনেছি। তবে ক্রেতার ভিড় বেশি থাকায় কেনাকাটা করাটা কষ্টকর হয়েছে। আলাপকালে রাজধানীর আজিমপুর থেকে আসা নাসিমা ইয়াসমিন জনকণ্ঠকে জানান, মেলা থেকে ঘর-সংসারের জন্য কিছু তৈজসপত্র ও ছেলের জন্য একটি সাইকেল কিনেছি। কেনাকাটায় এখানে সুবিধা হিসেবে পেয়েছি মূল্যছাড়। এ ছাড়া এ শহরে বাচ্চাদের নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর তেমন একটা জায়গা নেই। এ সুযোগে ওরা কিছুটা বিনোদন পেয়েছে। সব মিলিয়ে এক ছাদের নিচে অনেক পণ্য পাওয়ার সুবিধা আছে। শুধু রাজধানী ঢাকা নয়, বাণিজ্যমেলায় আসছে ঢাকার বাইরের ক্রেতা-দর্শনার্থীও। তাদেরই একজন নারায়ণগঞ্জ থেকে আসা সাইদুল ইসলাম। স্ত্রীসহ মেলায় আসা এ ক্রেতা জানালেন, এখানে অনেক দেখেশুনে, মনের মতো পণ্য কেনার সুযোগ আছে। অধিকাংশ স্টল ও প্যাভিলিয়নে নগদ অঙ্কের ছাড়, নানা ধরনের উপহার, ক্র্যাচকার্ডে পণ্য জিতে নেয়ার সুযোগ, প্যাকেজ অফারে বিভিন্ন অঙ্কের টাকা ছাড় দিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। এতে মেলায় ক্রেতা-দর্শনার্থীদের কেনাকাটা বেড়েছে। কেনা-কাটার পাশাপাশি বিভিন্ন নান্দনিক ডিজাইনের প্যাভিলিয়ন ছাড়াও বিভিন্ন ফোয়ারা, সুন্দরবন ইকোপার্ক, বঙ্গবন্ধু স্মৃতি প্যাভিলিয়নের সামনে দর্শনার্থীদের ছবি তুলতে দেখা যায়। এবার মেলায় যথেষ্ট খোলামেলা জায়গা রাখায় অনেকে সন্তুষ্ট প্রকাশ করেন অনেকে। মেলার ঠিক মাঝখানে বড় টাওয়ারের চারপাশে প্রচুর জায়গা ও বসার ব্যবস্থা থাকায় কেনা-কাটার মাঝখানে বিশ্রাম নিতে দেখা যায় অনেক ক্রেতাদের।
×