ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

সিরাজগঞ্জের ঐতিহ্য ইলিয়ট ব্রিজ

নির্মাণশৈলীতে অভিভূত পর্যটকরা- মানুষ চেনে ‘বড়পুল’ নামে

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ২৩ জানুয়ারি ২০১৬

নির্মাণশৈলীতে অভিভূত পর্যটকরা- মানুষ চেনে ‘বড়পুল’ নামে

বাবু ইসলাম খাম্বা ছাড়া ব্র্রিজ। দৃষ্টিনন্দন এই সেতুটি নির্মাণ করা হয়েছিল ব্রিটেনের টেম্স নদীর ওপর নির্মিত ব্রিজের অনুকরণে। লোহার এ্যাঙ্গেলের ওপর ১৮০ ফুট লম্বা এই ব্রিজ কোন খাম্বা ছাড়াই দাঁড়িয়ে আছে সিরাজগঞ্জ শহরের কাটাখালের ওপর। এর নাম ইলিয়ট ব্রিজ। কিন্তু সিরাজগঞ্জের মানুষের কাছে এই ব্রিজ সমধিক পরিচিত ‘বড়পুল’ নামে। শতাব্দীর সাক্ষী এই বড়পুল। সিরাজগঞ্জে আগত পর্যটক বা অতিথিরা এই ব্রিজের নির্মাণশৈলী দেখে অভিভূত হন। পাকিস্তান আমলে বড়পুলের পূর্বপারে ছিল মুসলিম লীগের দলীয় অফিস। পশ্চিমপারে ছিল আওয়ামী লীগের অফিস। বর্তমানে পূর্বপারে বিএনপির দলীয় অফিস। এ কারণেই রাজনৈতিক কর্মকা-ও চলে বড়পুলের এপার-ওপারকে ঘিরে। কোন কারণে সংঘর্ষ শুরু হলে এই বড়পুল হয়ে ওঠে ইটপাটকেল নিক্ষেপ ও পুলিশের টিয়ারশেল ছোড়ার প্রাণকেন্দ্র। নোম্যান্স ল্যান্ডে পরিণত হয় এই বড়পুল। খাম্বাবিহীন দৃষ্টিনন্দন এই ব্রিজ শহরের ভূমি থেকে কমপক্ষে ২৫ ফুট উঁচু। বড়পুলের চূড়ায় দাঁড়ালে গোটা শহর দেখা যায়। রাজনৈতিক দলের কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হলে এই বড়পুল নোম্যান্স ল্যান্ডে পরিণত হয়। যে দল বড়পুলের চূড়ায় ওঠে, তারাই যেন সংঘর্ষে বিজয়ী হয়। তৎকালীন পাকিস্তান আমলে মুসলিম লীগের সঙ্গে আওয়ামী লীগকর্মীদের এবং বর্তমানে বিএনপি ও আওয়ামী লীগকর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষ চলাকালে বড়পুলের চূড়া দখল করা যেন মূল বিষয় হয়ে ওঠে। প্রায় সোয়া শ’ বছর আগে নির্মাণকালে এই বড়পুলের নাম ছিল ইলিয়ট ব্রিজ। এই ব্রিজ সিরাজগঞ্জের সর্বস্তরের মানুষের কাছে বড়পুল হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। এরও রয়েছে সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। ১৮৯২ সালে যখন এই ব্রিজটি নির্মাণ করা হয় তখন প্রমত্তা যমুনার শাখানদী ছিল সিরাজগঞ্জ শহরের মাঝ দিয়ে বয়ে যাওয়া হুড়া সাগর নদী। সিরাজগঞ্জ শহরের প্রথম এবং একমাত্র বড় এই ব্রিজটি নির্মাণের পর হুড়া সাগর নদীর দু’পারের মধ্যে সংযোগ স্থাপিত হয়, যেটি বর্তমানে কাটাখাল হিসেবে পরিচিত। এর আগে সিরাজগঞ্জ শহরটি মূলত হুড়া সাগর নদী দ্বারা বিভক্ত ছিল। নৌকা ছাড়া পারাপারের কোন সুযোগ ছিল না। এ নদী দিয়ে তখন চলাচল করেছে বড় বড় লঞ্চ, স্টিমার এবং বড় বড় পাল তোলা নৌকা। এমনি সময়ের কোন এক বিকেলে সিরাজগঞ্জের তৎকালীন ইংরেজ মহুকুমা প্রশাসক বিটসন বেল শহরের পশ্চিমপার হতে পূর্বপারে তার আবাসস্থলে যাচ্ছিলেন, পথে এক দুস্থ মানুষের আর্তনাদ তাকে দারুণভাবে নাড়া দেয়। তিনি দেখেন একজন দুস্থ লোক নদী পার হওয়ার জন্য মাঝির নিকট করুণভাবে আবেদন-নিবেদন করছেন। কিন্তু মাঝি তাকে বিনা পয়সায় নদী পার করতে নারাজ। তিনি জানতে পারেন অভাবী ওই মানুষটি তার পুরোদিনের উপার্জন দিয়ে পরিবারের জন্য খাদ্য কিনে পকেটের সব টাকা শেষ করেছেন। তার হাতে অবশিষ্ট কোন টাকা নেই। অপরদিকে নদী পার হতে না পারলে সে বাড়ি পৌঁছতে পারবে না। অনাহারে থাকবে পরিবারের লোকজন। এমন অবস্থায় বিটসন বেলের অনুরোধে মাঝি দুস্থ লোকটিকে নদী পার করে দেন। এ ঘটনার পরই মি. বেল নদীর ওপর ব্রিজ নির্মাণে উদ্যোগী হন। গঠন করেন ব্রিজ নির্মাণ কমিটি। তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা চাঁদা তুলে তহবিল গঠন শুরু করেন। একপর্যায়ে তৎকালীন পাবনা জেলা বোর্ড ব্রিজ নির্মাণের সহযোগিতাস্বরূপ ১৫ হাজার টাকা মঞ্জুর করেছিল। তবে এই ব্রিজ নির্মাণে মোট কত টাকা ব্যয় হয়েছিল তার সঠিক কোন হিসাব জানা যায়নি। প্রবীণদের ধারণা, এই ব্রিজ নির্মাণে সে সময় প্রায় অর্ধলক্ষ টাকা ব্যয় হয়েছিল। এই ব্রিজ নির্মাণ করে পাটাতন দেয়া হয়েছিল শালকাঠের তক্তা দিয়ে। পরে তা কংক্রিট-সিমেন্ট বা সিসি ঢালাই করা হয়। ১৮৯২ সালের ৬ আগস্ট তৎকালীন বাংলা ও অসমের গবর্নর স্যার চার্লস ইলিয়ট ব্রিজটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। পরে তার নামানুসারে ইতিহাসসমৃদ্ধ এই ব্রিজটির নামকরণ করা হয় ইলিয়ট ব্রিজ। সেই সময়ের ১৮০ ফুট দীর্ঘ ও ১৬ ফুট প্রস্থের এই ব্রিজটি ছিল এ অঞ্চলের সবচেয়ে বড় ও উল্লেখযোগ্য স্থাপনা। মূলত এ কারণেই সিরাজগঞ্জের সর্বস্তরের মানুষ এটিকে বড়পুল হিসেবে অলিখিতভাবে নামকরণ করে। হুড়া সাগর নদী অনেক আগেই তার গৌরব হারিয়েছে। সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছে যমুনার সঙ্গে। কিন্তু কালের সাক্ষী হিসেবে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে সৌন্দর্যম-িত, ইতিহাসসমৃদ্ধ সেই ইলিয়ট ব্রিজ তথা বড়পুল। তবে বড়পুলের ঐতিহ্য ধরে রাখতে নিয়মিতভাবে ব্রিজটির সংস্কার করা প্রয়োজন। ব্রিজের গোড়ার দিকের অনেকাংশ ইতোমধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দখল হয়েছে ব্রিজের আশপাশের অনেক জায়গা। নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ না করলে হয়ত একদিন এই বড়পুল ধ্বংস হয়ে যাবে।
×