ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

খাদ্যশস্যের পর এবার দুধে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে চায় বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৫:৩৭, ১৩ জানুয়ারি ২০১৬

খাদ্যশস্যের পর এবার দুধে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে চায় বাংলাদেশ

এম শাহজাহান ॥ আমার সন্তান যেনো থাকে ‘দুধে-ভাতে’। বাঙালী বাবা-মায়ের এ আকুতি চিরন্তন ও সার্বজনীন। কিন্তু নির্ভেজাল ও দেশী গাইয়ের খাঁটি দুধ এখন আর সহজলভ্য নয়। দুধ ও মাংসের চাহিদা বাড়লেও বাড়েনি গবাদি পশুর উৎপাদন। আর তাই এবার গবাদি পশু বিশেষ করে গরু, ছাগল, ভেড়া ও মহিষের উৎপাদন বাড়িয়ে দুধে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে চায় বাংলাদেশ। এজন্য খামারিদের মাত্র ৫ শতাংশ সুদে ঋণ প্রদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। আজ বুধবার রাজধানীর খামারবাড়িতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনুষ্ঠানিকভাবে এ ঋণ প্রদান কার্যক্রমের উদ্বোধন করতে যাচ্ছেন। আশা করা হচ্ছে, স্বল্পসুদে ঋণ বিতরণ কার্যক্রম শুরু হলে আগামী তিন বছরের মধ্যে দুধে স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে বাংলাদেশ। পাশাপাশি চাহিদা মতো গরুর মাংসের উৎপাদনও বাড়বে। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের। জানা গেছে, দেশে দুধের চাহিদার ২০ ভাগ দেশীয় উৎপাদনে পূরণ করা হয়। বাকি ৮০ শতাংশ দুধ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা হচ্ছে। দুধের পাশাপাশি সঙ্কট রয়েছে গরুরও। এ কারণে কোরবানির ঈদ সামনে রেখে প্রতিবছর সীমান্তে গরু বাণিজ্যকে কেন্দ্র করে উত্তেজনা দেখা দেয়। সীমান্তরক্ষীদের গুলিতে মারা যায় সাধারণ গরু ব্যবসায়ীরা। এ বাস্তবতায় দেশে গবাদি পশু ও দুধ উৎপাদন বাড়ানো প্রয়োজন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। আর তাই গত অক্টোবর মাসে দুধের উৎপাদন বাড়াতে খামারিদের ৫ শতাংশ সুদে ঋণ দেয়ার উদ্যোগ নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এজন্য ২০০ কোটি টাকার পুনঃঅর্থায়ন তহবিলের আওতায় ১২টি ব্যাংক ও ১টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এ ঋণ বিতরণের চুক্তি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের সম্মেলন কক্ষে এ চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠিত হয়েছে। ওই চুক্তিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের কৃষিঋণ বিভাগের মহাব্যবস্থাপক প্রভাষ চন্দ্র মল্লিক এবং সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী, বেসিক, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক, আনসার ভিডিপি ব্যাংক, কর্মসংস্থান ব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংক, আইএফআইসি ব্যাংক, মিডল্যান্ড ব্যাংক ও আইডিএলসি ফাইন্যান্স লিমিটেডের প্রধান নির্বাহীরা সই করেন। প্রধানমন্ত্রী সেই কার্যক্রমটি এখন আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করতে যাচ্ছেন। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নর ড. আতিউর রহমান জানিয়েছেন, আমদানি নির্ভরতা কমাতে সরকার ক্ষুদ্র প্রান্তিক খামারিদের ২০০ কোটি টাকার তহবিলের মাধ্যমে ঋণ বিতরণের উদ্যোগ নিয়েছে। সৃজনশীল এ প্রকল্পের শতভাগ বাস্তবায়ন হলে দেশ দুধে স্বয়ংসম্পন্ন হবে। বাড়বে গবাদি পশুর উৎপাদন এবং এতে মানুষের পুষ্টির চাহিদাও পূরণ হবে। এ ঋণ বিতরণ করতে প্রকৃত ও নারী খামারিদের অগ্রাধিকার দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, এতে নারীর ক্ষমতায়ন ও কর্মসংস্থান বাড়বে। সম্ভাবনাময় এ প্রকল্পটি সফলভাবে বাস্তবায়ন হলে পরবর্তীতে ঋণ বিতরণের তহবিল আরও বাড়ানো হবে। এদিকে, মৎস্য প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, দেশে মুরগি ও হাঁস পালনে যথেষ্ট অগ্রগতি হলেও চতুষ্পদ প্রাণীর মানোন্নয়ন এবং সরবরাহে কোন অগ্রগতি নেই। কৃত্রিম প্রজনন ছাড়া কার্যকরী কোন উন্নয়ন উদ্যোগও দেখা যাচ্ছে না। এমনকি তাদের খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থাও দুর্বল। কিন্তু দেশের জনগণের পুষ্টি চাহিদা বিবেচনায় চতুষ্পদ প্রাণিসম্পদ উন্নয়নে বিশেষ নজর দেয়ার পাশাপাশি পাইলট প্রকল্প গ্রহণ করা হচ্ছে। চলতি বাজেট বক্তৃতায়ও এ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন, সরকারের কৃষি বান্ধব নীতিকৌশলের কারণে দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। ইতোমধ্যে গবাদি পশুর ঘাটতি মোকাবেলায় তিন বছর মেয়াদি একটি সমন্বিত কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। এ কার্যক্রমের আওতায় গবাদি পশুর টিকা উৎপাদন, চিকিৎসা সেবা প্রদান, কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে জাত উন্নয়ন এবং কৃষকদের প্রশিক্ষণ প্রদান কার্যক্রম জোরদার করা হবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক প্রাণিসম্পদ উন্নয়নের জন্য একটি বিশেষ ঋণ কার্যক্রম শুরু করতে যাচ্ছে। মাত্র ৫ শতাংশ সুদে গবাদি পশু খরিদ ও লালন-পালনের জন্য ঋণ প্রদান করা হবে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ হিসাব মতে, দেশে এখন গরুর সংখ্যা ২ কোটি ৮৬ লাখ। এর মধ্যে ১ কোটি ৭৫ লাখ গাভী। শুধু কোরবানি ঈদে প্রায় ৭০ লাখ গরু ও মহিষের চাহিদা রয়েছে। এছাড়া সারাবছরেও মাংসের চাহিদা পূরণে গরুর প্রায় সমপরিমাণ চাহিদা রয়েছে। পাশাপাশি দুধেরও ঘাটতি রয়েছে। সরকারীভাবে মিল্ক ভিটা নামক তরল দুধ উৎপাদন করা হচ্ছে। এর পাশাপাশি ব্র্যাকের উৎপাদিত আড়ং, প্রাণসহ আরও কয়েকটি কোম্পানি দুধ উৎপাদন করছে। যদিও এ উৎপাদন দুধের সব চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম হয়নি। এ কারণে অভ্যন্তরীণ উৎপাদনে এখন সবচেয়ে বেশি নজর দেয়া হচ্ছে। স্বল্পসুদে ঋণ বিতরণ কার্যক্রম শুরু হলে খামারিরা গরুসহ গবাদি পশু লালন পালনে উৎসাহিত হবেন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। বর্তমান দেশে মোট গরুর চাহিদার ৭০ শতাংশের যোগান দেয় দেশীয় খামারিরাই। বাকি ৩০ শতাংশ আসে ভারত থেকে। তবে সরকারী বিভিন্ন সহযোগিতায় প্রতিবছর দেশে গরু উৎপাদন বাড়ছে। কুষ্টিয়া, যশোর, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ ও পাবনাসহ উত্তরবঙ্গের প্রায় জেলায় গরুর বড় বড় খামার গড়ে উঠছে। স্বল্পসুদে ঋণ পাওয়া গেলে বেসরকারী খাতের উদ্যোক্তারা গরু উৎপাদনে আর বেশি উৎসাহিত হবেন।
×