‘ভূমিকম্পে উঠল কেঁপে নিদ্রিত নগরী।’ অবশ্য কেঁপে উঠল না বলে প্রকম্পিত হয়ে উঠল বলাই ভাল। আরও সঠিক শব্দ হতে পারে আতঙ্কিত। মঙ্গলবার ভোর ৫টা ৭ মিনিটে অকস্মাত প্রবল ভূকম্পনে রাজধানী তথা সারা দেশবাসী যেভাবে ভয়ে ও আতঙ্কে জেগে উঠেছে, তার তুলনা বুঝি কেবল চলে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে বর্বর পাকবাহিনীর নিরীহ নিরস্ত্র বাঙালীর ওপর রকেট লঞ্চার, হ্যান্ড গ্রেনেড, মর্টারশেল সর্বোপরি অত্যাধুনিক রাইফেলের মুহুর্মুহু গোলাবর্ষণ ও গোলাগুলির সঙ্গে। অথবা তার চেয়েও বেশি কিছু। আজান আসন্ন জেনেও সর্বস্তরের মানুষ কিন্তু পৌষ মাসের শীতের শেষ রাতে বেশ জম্পেশ করে ঘুম দেয়। বেশ একটু বেলা করেই ওঠেন অনেকে। লেপ বা কম্বলের ভেতরে শুয়ে থেকে প্রবল আলস্যে এপাশ-ওপাশ করেন, আড়মোড়া ভেঙে উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করেন, সাত সকালে সূর্যের আলো আদৌ ফুটেছে কিনা! এদিন কিন্তু সে অবকাশ হয়নি অনেকেরই। কেবল গুটিকতক কুম্ভকর্ণ ব্যতিরেকে। ভূমিকম্পের ঝাঁকুনি, তীব্রতা, দোলাচল, সর্বোপরি সশব্দ কম্পনÑ সবকিছু মিলে এতটাই ছিল আকস্মিক ও ভয়ঙ্কর। ঘুমের ঘোরে হঠাৎ করে ভয় আতঙ্কে ঘুম ভেঙ্গে যাওয়ায় ব্যাপারটা বুঝতে না পেরে অনেকেই বুঝি ভেবেছিলেন জঙ্গী হামলা হয়েছে অথবা ডাকাত পড়েছে বাড়িতে। পরে কিঞ্চিত ধাতস্ত হলে বোঝা গেল ভূমিকম্প। কেননা নেপালের এই সেদিনের ভূমিকম্পের অভিজ্ঞতা ঢাকাবাসীসহ বাংলাদেশীদের কাছেও খুব বেশি পুরনো হয়ে যায়নি। তবে সেটি হয়েছিল দিনের বেলায়। আর তাই মানুষ ভয় পেলেও আতঙ্কিত হয়নি তেমন। তবে এবারেরটি শীত রাতের শেষে ঘুমের ঘোরে সংঘটিত হওয়ায় মানুষ ভয় পাওয়ার পাশাপাশি আতঙ্কিতও হয়েছে। আর তাই প্রাণভয়ে শেষ রাতের তীব্র হিম কুয়াশা শীতলতা ও শৈত্যপ্রবাহ প্রায় একবাক্যে পরিহার করে স্বামী-স্ত্রী, ভাই-বোন, বাচ্চা-কাচ্চা, শিশু এমনকি নবজাতকসমেত পাঁচ-সাত-দশ তলা অথবা আরও সুউচ্চ ভবন থেকে নেমে এসেছে নিচে, পথনির্জন রাস্তায়, নিরাপত্তার চিন্তা একবারও না করে। না, রাস্তাঘাটে এদিন মানুষের জানমালের নিরাপত্তা বিঘিœত হয়নি কোথাও। ‘লাইফ অব পাই’ বলে একটা ছবি আছে না! বিপদে পড়লে বাঘে-গরুতে এক ঘাটে জল খায়। তবে ভীত ও আতঙ্কিত হয়ে কিছু মানুষ মারা গেছে আকস্মিক হৃদরোগে। ছোটাছুটি করতে গিয়ে অথবা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে প্রাণ বাঁচাতে চার-পাঁচতলা থেকে লাফিয়ে পড়ে আহত হয়েছেন অনেকে। এসবই ভূমিকম্পের বহিরাঙ্গন। আসুন, ভূমিকম্পের অন্তরাঙ্গনটা একটু দেখি।
এতদিনে সবাই জেনে গেছেন যে, ঢাকা ও দেশের সর্বত্র আতঙ্ক সৃষ্টিকারী ভূমিকম্পটির উৎপত্তিস্থল ছিল রাজধানী থেকে ৩৫১ কিলোমিটার দূরে, উত্তর-পূর্ব ভারতের মণিপুর রাজ্যের রাজধানী ইম্ফল থেকে ৩০ কিলোমিটার পশ্চিমে, ভূপৃষ্ঠের ৫৫ কিলোমিটার গভীরে। মাত্রা ছিল রিখটার স্কেলে ৬ দশমিক ৭। তবে স্থানীয় আবহাওয়া বিভাগ বলছে, ঢাকায় অনুভূত মাত্রার পরিমাণ ৫। ভূমিকম্পে বাংলাদেশে কয়েকজনের মৃত্যু, কয়েকটি ভবনের হেলে পড়া বাদ দিলে ক্ষয়ক্ষতি তেমন নয়। তবে স্বভাবতই মণিপুর তথা ইম্ফলের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ব্যাপক। যদিও প্রাণহানি তুলনামূলকভাবে কম। কেননা সেখানকার অধিবাসীরা ভূমিকম্পের সঙ্গে বসবাসে অভ্যস্ত।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এএসএম মাকসুদ কামাল বলেন, মণিপুর পৃথিবীর ষষ্ঠ ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা। এটি ৫০০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে প্রলম্বিত এবং সর্বোচ্চ ৮ দশমিক ৬ মাত্রার ভূমিকম্প সৃষ্টি করার ক্ষমতা রাখে। ভারতের ত্রিপুরা, মিজোরাম ও মণিপুর রাজ্য এবং বাংলাদেশের সিলেট, কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম এই মেগাথ্রাস্টের অংশ। মাত্রা ও গভীরতার বিচারে ভূমিকম্পটি ছিল মাঝারি শক্তিশালী অগভীর বা শ্যালো ফোকাস। তবে নিঃসন্দেহে এটি স্মরণকালের মধ্যে সবচেয়ে বড় ঝাঁকুনি। নেপালের ভূমিকম্পের অভিজ্ঞতার চেয়েও বেশি। বাংলাদেশে সর্বশেষ বড় ভূমিকম্প ৭ দশমিক ৪ মাত্রার হয়েছিল ১৯১৮ সালে, যা শ্রীমঙ্গল ভূমিকম্প নামে পরিচিত। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সিলেট সীমান্তে সক্রিয় ডাউকি ফল্টের উৎসমূল থেকে ভূমিকম্প হতে পারে ২০১৯ সালের দিকে।
উল্লেখ্য, গত বছর ২৫ এপ্রিল ৭ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হেনেছিল নেপালে। এতে ব্যাপক প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি ঘটে। বাংলাদেশেও এর প্রভাব পড়েছিল, তবে কম। ওই ভূমিকম্প হয়েছিল এমন এক ভূ-তাত্ত্বিকভাবে সংঘর্ষপ্রবণ এলাকায়, যেখানে ইন্ডিয়ান টেকটোনিক প্লেট প্রতিবছর ২ সেন্টিমিটার করে উত্তরবঙ্গকে ঠেলে দিচ্ছে ইউরেশিয়া প্লেটের দিকে। একটি প্লেট আর একটি প্লেটের নিচে যত শক্তিতে ঢুকে যাবে, ভূমিকম্পের মাত্রাও হবে তত তীব্র। একটি বা দুটি বড় ধরনের ভূমিকম্প ভূগর্ভের অভ্যন্তরে চলমান ও ক্রমবর্ধমান অস্থিরতাকে বাড়িয়ে দেয়। ফলে বড় ভূমিকম্পের আশঙ্কা থেকেই যায়। গত বছর নেপালে পর পর দুটো ভূমিকম্পের পর ভূবিজ্ঞানীদের কেউ কেউ বলেছিলেন, এবার পালা উত্তর-পূর্বাঞ্চলের। সেটাই সত্যি হয়েছে। তবে নেপালের মতো হয়নি মণিপুরে। নেপালে একটি প্লেট আর একটি প্লেটের নিচে ঢুকেছে। তবে মণিপুরের ক্ষেত্রে একটি প্লেট অন্যটিকে ধাক্কা দিয়ে সরে গেছে। বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা, এই অঞ্চলে অদূর ভবিষ্যতে আরও বড় মাত্রার ভূমিকম্প হতে পারে। অথচ তাদের পরামর্শ উপেক্ষা করে এই অঞ্চলে বড় বড় বহুতল ভবন, শপিংমল, মার্কেট গড়ে উঠছেই। ব্রহ্মপুত্রে নেয়া হয়েছে টিপাইমুখ বাঁধ ও বিদ্যুত প্রকল্প। সে অবস্থায় ক্ষয়ক্ষতি হবে আরও ব্যাপক।
বাংলাদেশে সরকারের সমন্বিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচী (সিডিএমপি) থেকে ভূমিকম্প ঝুঁকি বিষয়ক সর্বশেষ জরিপ হয় ২০০৯ সালে। সেখানে বলা হয়েছে, দেশের অভ্যন্তরে মাঝারি ও তীব্র ভূমিকম্পের ভয় নেই। তবে মূল ভয় পরিবেষ্টিত তিন দেশ ভারত, মিয়ানমার ও নেপাল। এসব এলাকায় ৮ থেকে ১০ মাত্রার ভূমিকম্প হলে বাংলাদেশে মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হবে। কম-বেশি ক্ষয়ক্ষতিও হবে। সে অবস্থায় প্রস্তুতি না নেয়ার বিকল্প নেই। দুর্যোগ ও ত্রাণমন্ত্রী সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ঢাকা শহরের মাটি শক্ত। ভূমিকম্পের ভয় নেই। বাস্তবে এরও কোন ভিত্তি নেই। প্রকৃতপক্ষে ঢাকার ৩৫ শতাংশ এলাকা শক্ত বা লালমাটি দিয়ে গঠিত। বাকি ৬৫ শতাংশ এলাকায় নরম মাটি, আবর্জনা অথবা জলাভূমি ভরাট করে তৈরি করা হয়েছে বহুতল ভবন, বাড়িঘর, মার্কেট, শপিংমল ইত্যাদি। ঝুঁকিপূর্ণ চিহ্নিত ভবনের সংখ্যা ৭২ হাজার। বেশি ঝুঁকিপূর্ণ প্রায় চার শ’। সে অবস্থায় ৮ মাত্রার ভূমিকম্প হলে জলাভূমি ভরাট করে নির্মিত ভবনগুলো ধসে পড়বে। ঢাকা পরিণত হতে পারে প্রায় মৃত্যুকূপে। ভবন ধস ছাড়াও রাজধানী আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকা ভূগর্ভস্থ গ্যাস পাইপ লাইনগুলো ইলেকট্রিক স্পার্ক পেলে জ্বলে উঠবে দাউ দাউ করে। ঢাকা পরিণত হতে পারে অগ্নিবলয় বা ইনফারনোতে। অথচ ভূমিকম্প, অগ্নিকা- ও এই জাতীয় দুর্যোগ-দুর্ঘটনার বিরুদ্ধে আমাদের প্রস্তুতি বড় কম। এখন পর্যন্ত মাত্র ৬৯ কোটি টাকার উদ্ধার অভিযানের যন্ত্রপাতি কেনা হয়েছে, যা দেয়া হয়েছে সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ ও ফায়ার সার্ভিসকে। ১৬৯ কোটি টাকার আধুনিক সরঞ্জাম কেনার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। হাল্কা সরঞ্জাম দেয়া হয়েছে ৫০ লাখ স্কাউটকে। এসবই অপ্রতুল ও অপর্যাপ্ত।
যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও সিঙ্গাপুরের এক দল বিজ্ঞানীর মতে, হিমালয় সন্নিহিত অঞ্চলটি অবস্থিত ভূতাত্ত্বিকভাবে সংঘর্ষপ্রবণ এলাকায়, যেখানে ইন্ডিয়ান টেকটোনিক প্লেট প্রতিবছর ২ সেন্টিমিটার করে উত্তর ভাগকে ঠেলে দিচ্ছে ইউরেশিয়া প্লেটের দিকে। একটি প্লেট আর একটির নিচে বা ওপরে যত শক্তিতে ঢুকে যাবে, ভূমিকম্পের মাত্রা হবে তত তীব্র। ইতোমধ্যে এই অঞ্চলে ভূগর্ভে বিপুল পরিমাণ শক্তি জমা হয়েছে এবং সেই শক্তি নিজেকে নিঃশেষ করার জন্য বেছে নিতে পারে ভূমিকম্পের মতো ভয়ঙ্কর পথ। সে কারণে এই অঞ্চলটি বিশেষভাবে নজরদারির দাবি রাখে। অথচ এই অঞ্চলের মানুষ বাড়িঘর তৈরিতে তেমন সাবধানতা অবলম্বন করে না। বাস্তবে এসব অঞ্চলে ভূমিকম্প সহনীয় আবাসন তৈরি করা অপরিহার্য।