ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সমস্যা যখন পাত্রী সঙ্কট

প্রকাশিত: ০৬:৪৩, ৮ জানুয়ারি ২০১৬

সমস্যা যখন পাত্রী সঙ্কট

ভারতের হরিয়ানা রাজ্যের জিন্দ জেলার বিবিয়ানা গ্রাম। বড় একটি গাছের ছায়ায় রীতিমতো জটলা। তাস খেলছেন চারজন; বাকিরা দর্শক। এর মধ্যে একজন হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে সুখবরটা শোনান, ‘আমার সন্তান হয়েছে। ফুটফুটে একটা মেয়ে।’ কিন্তু এতে কারও কাছ থেকে প্রত্যাশা অনুযায়ী প্রতিক্রিয়া পাননি। উল্টো বিদ্রƒপের সুরে উপদেশ দেয়ার প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। বেশিরভাগের মুখ থেকে বেরিয়ে আসে, তুমি কি আলট্রাসনোগ্রাফি করে স্ত্রীর গর্ভের বাচ্চা ছেলে নাকি মেয়ে তার পরীক্ষাটি করাওনি? কেন ভ্রƒণ থাকতেই বাচ্চাটাকে মারলে না! জন্মের আগে লিঙ্গ নির্ধারণ পরীক্ষা ভারতে নিষিদ্ধ। কিন্তু এর বাস্তব অবস্থাটা বোঝার জন্য খুব বেশি উদাহরণ টানার প্রয়োজন পড়ে না। বিবিপুর গ্রামের দিকে তাকালেই ভারতের বিরাজমান পুরুষ সন্তানের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে পরিষ্কার একটা ধারণা নেয়া যায়। পুত্রের জন্য সাংস্কৃতিক অগ্রাধিকার দেশটির ১২০ কোটি জনসংখ্যার লিঙ্গগত ভারসাম্যকে পুরোপুরি নষ্ট করে দিয়েছে। বিশেষত পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্য হরিয়ানা, রাজস্থান ও পাঞ্জাবে। হরিয়ানার জিন্দ জেলায় নারী ও পুরুষের অনুপাত হচ্ছে, প্রতি ১ হাজার জন পুরুষের বিপরীতে নারী রয়েছে মাত্র ৮৭১ জন। অবস্থা এতোই বেগতিক যে, হরিয়ানা, রাজস্থান ও পাঞ্জাবের মতো জেলাগুলোর যুবকেরা পাত্রী সমস্যার সমাধান টানতে হন্যে হয়ে ছুটে যাচ্ছে দারিদ্র্যপীড়িত পশ্চিমবঙ্গ ও বিহার এমনকি আরও দূরের রাজ্য, দক্ষিণাঞ্চলের কেরালায়। এতেও অনেক রাজ্যের দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আসছে না। কিনে আনা বধূরাও বাধ্য হচ্ছেন মেয়েশিশুর গর্ভপাতে। এভাবেই বেরিয়ে আসা যাচ্ছে না ভারসাম্যহীনতার দুষ্টচক্র থেকে। তাস খেলোয়াড়দের একজনের রক্ষণশীল পরিবার হরিয়ানায় মেয়েদের অপর্যাপ্ততার কারণে কঠোর সামাজিক মূল্যবোধ ভেঙ্গে তার জন্য পশ্চিম বাংলা থেকে কিনে এনেছিল কিশোরী বধূ। কলঙ্কের ভয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ৪০ বছরের এ লোকটি শোনাচ্ছিলেন তার জীবনের কাহিনী, ‘আমার স্ত্রী ইতিমধ্যে তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিল। একদম দেরি না করেই আমরা তার আল্ট্রাসনোগ্রাফি টেস্ট করিয়েছিলাম। রিপোর্ট বলে দিয়েছিল, মেয়েশিশু হবে এটি। কিন্তু ডাক্তার শিশুটিকে নষ্ট করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন এই যুক্তিতে যে, এতে করে শিশুর জীবন নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি মায়ের জীবনও বিপন্ন হতে পারে। এ কথা জানার পর আমার পরিবারের অনেক সদস্য এবং কিছু বন্ধু হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল হরিয়ানা ও রাজস্থানের ডাক্তার ও ক্লিনিকের একটি তালিকা, যেখানে ঝামেলামুক্ত গর্ভপাত সম্ভব। জয়পুরে এক আত্মীয়ের বিয়ে খেতে যাচ্ছি বলে আমার ১৯ বছর বয়সী স্ত্রীকে নিয়ে গিয়েছিলাম একটি ক্লিনিকে। স্বাভাবিক উপায়ে গর্ভপাত সম্ভব নয় বলে ডাক্তার আমার স্ত্রীর প্রজনন পথে একটি বড়ি রেখে দিয়েছিলেন। পরের দিন সকালে কাঁপতে কাঁপতে স্ত্রী আমাকে ‘সুসংবাদটা’ দিয়েছিল, ‘প্রস্রাবের সঙ্গে শিশুর শরীরের অনেক অংশ বেরিয়ে গেছে। এতেই আমি বুঝে গিয়েছিলাম কাজ হয়েছে!’ ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নাল ল্যান্সেট ২০১১ সালে এক গবেষণা শেষে রিপোর্ট প্রকাশ করেছিল, গত তিন দশকে ভারতে অন্তত ১২ মিলিয়ন মেয়ে ভ্রƒণ নষ্ট করা হয়েছে। ভারতের অনেক অংশে ৪০ উর্ধ অবিবাহিত পুরুষের সংখ্যা বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। স্ত্রী পেতে ব্যাকুল তারা। গত বছরের সাধারণ নির্বাচনের আগে শিরোনাম হয়ে উঠেছিল বিবিপুর (যার অর্থ বধূদের গ্রাম)। কানওয়ারা ইউনিয়ন বা ব্যাচেলর্স ইউনিয়ন নামক স্থানীয় একটি সংগঠন নির্বাচনের প্রতিদ্বন্দ্বীকে সরাসরিই জানিয়ে দিয়েছিল, ‘আমাদের বউ দাও এবং জিতে নাও ভোট।’ ভারতের নারী ও শিশু কল্যাণমন্ত্রী মানেকা গান্ধী স্বীকার করে নিয়েছেন, গর্ভপাত একটি মারাত্মক সমস্যা। আরও বহু সমস্যার উৎস এটি। আল জাজিরার একটি রিপোর্ট থেকে জানা গিয়েছে, ভারতে প্রতিবছর ২ হাজার মেয়েকে গর্ভেই কিংবা জন্মের পরপরই হত্যা করা হয়। কিন্তু জাতিসংঘের রিপোর্ট অনুসারে এ সংখ্যাটা ৭ হাজারের আশপাশে। দেশের অনেক জায়গায় পরিবারের সদস্য সংখ্যা বলতে গিয়ে মেয়েদের বিবেচনাতেই আনা হয় না। শুধুমাত্র গরিব পরিবারের ক্ষেত্রেই এমনটি ঘটছে, তা কিন্তু নয়। সূত্র : টাইমস অব ইন্ডিয়া
×