ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

তৌফিক অপু

ফ্যাশনে গতিশীলতার বছর

প্রকাশিত: ০৭:৫২, ১ জানুয়ারি ২০১৬

ফ্যাশনে গতিশীলতার বছর

ঋতুর পালা বদলে বইছে কনকনে হাওয়া। বিরাজ করছে শীতের আমেজ। আর এ সময়টাতে চারদিকে চলছে উৎসব উৎসব সাজ। পারিবারিক, সামাজিক কিংবা ধর্মীয় যে কোন উৎসবই এ মৌসুমে এসে যেন অন্য রকম আবহ সৃষ্টি করে। বাঙালীর ইতিহাস ঐতিহ্য হাজার বছরের। বারো মাসে তেরো পার্বণে অভ্যস্ত বাঙালী খুবই উৎসবপ্রিয়। যে কারণে নিজস্ব উৎসব ছাড়াও অন্যের উৎসবেও রঙ ছড়াতে দ্বিধাবোধ করে না। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এ জাতি ইংরেজী নববর্ষ পালন করে থাকে বেশ জাকজমকপূর্ণভাবে। প্রিয়জনকে ফুল, মিষ্টি আর কার্ড আদান-প্রদানের মাধ্যমে বরণ করে নেয় নতুন বছরকে। আয়োজন করা হয় বিভিন্ন অনুষ্ঠানের। গান, আলাপ চারিতা, উপহার আদান-প্রদান আর ঘুরে বেড়ানোর ট্র্যাডিশন এখন এদেশেও চালু হয়েছে। গ্রামবাংলার কিছু অঞ্চলে বাঙালীর নিজস্ব ক্যালেন্ডার ফলো করা হলেও সমাজ রাষ্ট্রের সব কাজ গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারকে অনুসরণ করে করা হয়ে থাকে। কারণ ইংরেজী নববর্ষ আমাদের জীবনে সাংবাৎসরিক অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিদায়ী বছরের বিণœœতাকে ছাপিয়ে মনকে উৎফুল্ল করে তোলে নতুন বছরের আগমনী বার্তা। ক্যালেন্ডারের শেষ পাতাটি ছিঁড়ে একসঙ্গে উচ্চারিত হয় হ্যাপি নিউ ইয়ার। নতুন দিনের সূচনা, নতুন করে পথচলা। নতুন প্রাণচাঞ্চল্য, নতুন শপথ সব কিছুই যেন একাকার হয়ে বছরের প্রথম দিনটিতে এসে। অতীতকে মুড়িয়ে দিয়ে নতুন এক সময়কে বরণ করে নেয়ার শিহরণই যেন অন্যরকম। প্রতি মুহূর্তেই চলে নতুন বছরকে বরণ করে নেয়ার প্রস্তুতি। বন্ধু প্রিয়জনকে শুভেচ্ছা জানানোর মাধ্যমে শুরু নতুন বছরের দিন। পুরনো গ্লানি মুছে নতুন ভাবে বাঁচার প্রত্যয়ে শুরু হয় নববর্ষ। যে কারণে উন্মাদনাও একটু বেশি থাকে নববর্ষকে ঘিরে। বিভিন্ন উৎসব পার্বণের মধ্য দিয়ে বরণ করে নেয় হয় নতুন বছরকে। ইংরেজী নববর্ষ পালনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য উৎসব হচ্ছে থার্টি ফাস্ট নাইট। বছরের শেষ এ রাতটিতে পুরো বিশ্ব জুড়ে পালন করা হয় নববর্ষের উৎসব। ঘড়ির কাঁটায় ঠিক বারোটা বাজার সঙ্গে সঙ্গে সুর ও সঙ্গীতের মূর্ছনায় মুখরিত হয়ে ওঠে চারপাশ। আতশবাজির আলোকছটায় ছেয়ে যায় আকাশ। শুরু হয় প্রিয়জনদের শুভেচ্ছা বার্তা পাঠানো। একে অপরকে উপহার আদান-প্রদানের মাধ্যমে বরণ করে নেয় নতুন বছর। বিশ্বের প্রায় প্রতিটি অঞ্চলেই পালন করে হয়ে থাকে ইংরেজী নববর্ষ। নতুন বছরের এ প্রভাব যেন ফ্যাশন ট্রেন্ডেও এসে পড়ে। বছর জুড়েই ফ্যাশন ট্রেন্ডে বৈচিত্র্যময় ফ্যাশন নিয়ে, আধুনিক কনসেপ্টকে উপজীব্য করে নানা ফর্মে পোশাকে ডিজাইনের শৈল্পিক প্রতিভাটি ফুটিয়ে তোলার কাজটিও এ বছর করা হবে সুনিপুণভাবে। গত বছরের তুলনায় আরও একধাপ এগিয়ে থাকবে এ বছরের ফ্যাশন এটাই স্বাভাবিক। তবে খুব বেশি তারতম্য না হলেও কিছু পার্থক্য অবশ্যই চোখে পড়বে। কিরণ মালা গত বছর পাখি ড্রেস নিয়ে কম পানি ঘোলা হয়নি। পারিবারিক কলহের সংবাদ পর্যন্ত পাওয়া গেছেÑ এতটাই সাড়া ফেলেছিল পাখি ড্রেস। এবারেও সেই একই প্যাটার্নের ড্রেস কিরণমালা নাম নিয়ে এসেছে। ক্রেতারা এবারেও কিরণমালা পোশাক নিয়ে বেশ মাতামাতি করেছে। বলা যায় কিরণমালা পোশাকটি এবারের ফ্যাশন ট্রেন্ডকে বেশ ভাল ভাবেই নাড়া দিয়েছে। হিজাবের ভেরিয়েশন একটা সময় শুধু আব্রু হিসেবে হিজাব ব্যবহৃত হলেও এবারে সেই হিজাবের পরিবর্তন ছিল চোখে পড়ার মতো। কাপড়, ডিজাইন এবং রঙের বাহার এবারে হিজাবকে অন্যমাত্রা যোগ করেছে। আড্ডা থেকে পার্টি পর্যন্ত হিজাব ছিল লক্ষ্যণীয়। পালাজ্জু একটা সময় ঢিলেঢালা সালোয়ারকে ডিভাইডার বলা হতো। সেই ডিভাইডারের আরও আধুনিক প্যাটার্ন পালাজ্জু হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। অর্থাৎ যে কোন ড্রেসের সঙ্গে পালাজ্জু ব্যবহার যেন ছিল অত্যাবশ্যকীয়। বিভিন্ন রঙ ও কাপড়ের বৈচিত্র্যে প্রতিটি শোরুম ছিল পালাজ্জু দিয়ে পরিপূর্ণ। শাড়ি দেশীয় শাড়ির পাশাপাশি বিদেশী শাড়িও এ বছর কেনাকাটার তালিকায় স্থান পাবে। গত বছর দেশীয় শাড়ির মধ্যে সর্বাধিক চাহিদা হলো টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি ও জামদানি শাড়ির। এর পাশাপাশি মিরপুরের বেনারসি, কাতানের রয়েছে বিপুল সমাদর। জর্জেট, সিল্ক, কাতান সহ অভিজাত নামের সব বাহারি শাড়ি ও বিভিন্ন ড্রেস হাউসে বিরজমান ছিল। তবে এক্ষেত্রে এগিয়ে রয়েছে টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি। টাঙ্গাইলের শাড়িতে সাম্প্রতিক ডিজাইনের বৈচিত্র্য এবং সহনীয় দাম নারীসমাজের এই শাড়ির প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার অন্যতম মূল কারণ। সুতি, সিল্ক, হাফসিল্কসহ নানা নামের টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি ঈদের সময় থাকে নারীর কালেকশন লিস্টের শীর্ষে। এর পরই থাকে জামদানি এবং মিরপুরের বেনারসি ও কাতান। জামদানি কিছুটা বেশি দামের হলেও মিরপুরের বেনারসি ও কাতানের দামটাও রয়েছে নাগালের মধ্যে। যার ফলে টাঙ্গাইলের তাঁত পল্লী, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ তাঁত পল্লীসহ সিদ্ধিরগঞ্জ, সোনার গাঁয়ের জামদানি ফ্যাক্টরি এবং মিরপুরের বেনারসি পল্লীতে থাকবে তাঁত শিল্পীদের অবিশ্রান্ত ব্যস্ততা। এ বছরও এর ব্যতিক্রম হবে না। সালোয়ার কামিজ মেয়েদের নিত্যব্যবহার্য পোশাক সালোয়ার কামিজ বরাবরই ফ্যাশন ট্রেন্ডে আনে বৈচিত্র্য। পাজামা, ওড়না ও কামিজের ভিন্নধর্মী নকশা সালোয়ার কামিজকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলে যা সহজেই দৃষ্টি কাড়ে ক্রেতাদের। ভয়েল, পপলিন, প্রিন্ট, আদ্দি কটন, কটন জর্জেট, টিসি সিনথেটিক কালার ইত্যাদি কাপড়ের সমন্বয়ে এবার প্রস্তুত হয়েছে সালোয়ার কামিজ। (আবহাওয়াকে প্রাধান্য দিয়ে সালোয়ার কামিজের কাপড় সিলেকশন করা হবে। সালোয়ার কামিজের পাশাপাশি ওড়নার বৈচিত্র্য এবার লক্ষণীয়, এর কাটিং ডিজাইন এবং লেআউটে রয়েছে ভিন্নতা। সুতার কাজ, ক্রিস্টাল, মেটাল আইটেম এবং কড়ি দিয়ে ডিজাইন করা হয়েছে সালোয়ার কামিজ এবং ওড়নায়) তাছাড়া শিপন জর্জেটের স্ট্রাইপ প্যাটার্নের হেভি কাজের সালোয়ার কামিজ প্রচুর উঠবে বাজারে। স্টোন এবং স্ট্রিং পাইপের ডিজাইনের সালোয়ার কামিজ এবার বাজার বাজিমাত করবে। সুতি কাপড়ের চাহিদাও এবার বেশ থাকবে। পাইপিন এবং টারসোলর সমন্বয়ে কটন এবং এন্ডি কটনের ডিজাইন করা হয়েছে। পাঞ্জাবি পাঞ্জাবি ছাড়া উৎসব কোন পুরুষ কল্পনাই করতে পারেন না। অন্য কোন পোশাক কিনুন বা না কিননু পাঞ্জাবি যেন কিনতেই হবে। এ কারণেই ফ্যাশন হাউসগুলো প্রতিবছরই পাঞ্জাবির ডিজাইন এবং রঙের ক্ষেত্রে নতুনত্ব আনতে চেষ্টা করে। ফ্যাশন হাউসগুলোর ভেতরে রীতিমতো প্রতিযোগিতা তৈরি হয়। কোন্ হাউস কত ভাল ডিজাইনের পাঞ্জাবি তৈরি করবে। ডিজাইনভেদে পাঞ্জাবির মূল্য একেক রকম। বড়দের পাশাপাশি বাচ্চাদের পাঞ্জাবির ভেরিয়েশন গত বছর চোখে পড়ার মতো ছিল। এ বছর আরও ভেরিয়েশন পাওয়া যায়। শিশুদের পোশাক সবচেয়ে বেশি ভেরিয়েশন থাকবে শিশুদের পোশাকে। গত বছর স্পাইডারম্যান, বেনটেন এন্ড ডরিমন পোশাকের ব্যাপক চাহিদা ছিল। এ বছরও কিছুটা থাকবে। তবে এবার নিনজা স্টাইলের ব্ল্যাক ড্রেসও কিংবা নিনজা হাতুড়ির ড্রেস প্রাধান্য পাবে। এছাড়া সাড়া বছর পড়ার মতো পোশাকের বৈচিত্র নজড় কাড়বে। জুতো জুতোর ভেরিয়েশন প্রতিবছরই লক্ষ্যণীয়। গত বছর মেয়েদের হাইহিল জুতো, হাই বুট, ছেলেদের কনভার্স এবং বুটজুতো বেশি প্রাধান্য পেয়েছে। এ বছর কনভার্স সবচেয়ে বেশি চলবে বলে আশা করা হচ্ছে। অনলাইন ফ্যাশন অন্যান্য বছরের তুলনায় গত বছরে অনলাইনে কেনাকাটার হিড়িক একটু বেশিই ছিল। যান্ত্রিক জীবনে সময়ের ফুসরত না থাকাতে অনেকেই অনলাইন কেনাকাটার প্রতি নির্ভরশীল হয়ে পরেন। যে কারণে অনলাইন ব্যবসায়ীরা বেশ ভাল ব্যবসা করেছে গেল বছর। জামা, জুতো থেকে শুরু করে ঘরের আসবাবপত্র এবং নিত্যনৈমিত্তিক পণ্য অনলাইনে বিক্রি হয়েছে দেদারসে। এ বছরে ধারনা করা হচ্ছে অনলাইন ব্যবসা আরও জমজমাট হয়ে উঠবে। ক্রিকেটারদের আধিপত্য অন্যান্য পেশাদার মডেলের পাশাপাশি গত বছরের ফ্যাশন ট্রেন্ডে জাতীয় দলের ক্রিকেটারদেরকে মডেল হিসেবে দেখা গেছে। দৈনিক পত্রিকা, ম্যাগাজিন, ফ্যাশন হাউস এমনকি বিলবোর্ডেও ক্রিকেটারদের আধিপত্য ছিল চোখে পড়ার মতো। ফ্যাশন শো গেল বছর পুরোটা জুড়েই ছিল ফ্যাশন শো। দিন দিন বাড়ছে ফ্যাশন শো’র সংখ্যা। ফ্যাশন হাউসগুলো কোন উপলক্ষ পেলেই আয়োজন করেছে ফ্যাশন শো। এতে করে সাড়া মিলেছে প্রচুর। উল্লেখযোগ্য ফ্যাশন শোগুলো মধ্যে দেশী দশের বিজয় পোশাকের শো, খাদি ফ্যাশন শো এবং ঈদ ফ্যাশন শোগুলো ছিল উল্লেখযোগ্য। এ বছরও এর ব্যতিক্রম হবে না। আন্তর্জাতিক অঙ্গন ২০১৫ সালে আন্তর্জাতিক ফ্যাশন ট্রেন্ডে সবচেয়ে বেশি আলোচিত ছিলেন টেইলর সুইফট। কখনও এক্সক্লুসিভ কাজের কারণে কখনও বিতর্কে জড়িয়ে সারা বছরই ছিলেন আলোচনার শীর্ষে। তবে বছর শেষে সেরার তকমাটা ঠিকই নিজের করে নিয়েছেন। অন্যদিকে সবচেয়ে বাজে মডেলের আসন নিজের করে নিয়েছেন সেলেনা গোমেজ। ছেলেদের মধ্যে হার্টথ্রব গায়ক জাস্টিন বিবার গান এবং ফ্যাশন ট্রেন্ডে নিজের শীর্ষ অবস্থান ধরে রেখেছেন। এছাড়া প্যারিস ফ্যাশন উইক ছিল নজর কাড়ার মতো। মার্কিন ফ্যাশন ডিজাইনার রিক ওয়েনের ব্যাকপ্যাক ফ্যাশন টি আলোচিত হয়েছে বেশ। ছেলেদের পিঠের ঝোলায় এবং মেয়েদের সামনের দিকের ঝোলায় মানুষ বহন করার ফ্যাশনটি ব্যাপক প্রশংসা কুড়িয়েছে। সামনের বছরের প্রত্যাশা ২০১৫ সালটি বিভিন্ন দুর্যোগ এবং সহিংসতা ছাড়াই নিরবচ্ছিন্নভাবে ব্যবসা করে গেছে ব্যবসায়ীরা। ২০১৪ সালের সহিংসতা কাটিয়ে ২০১৫ বছরটায় যেন হাফ ছেড়েছেন অনেকেই। যা ফ্যাশন ট্রেন্ডের জন্য ইতিবাচক দিক। শুধু ফ্যাশন ট্রেন্ড কেন পরিচ্ছন্ন এবং শান্ত পরিস্থিতিরি একটা দেশ সবারই কাম্য। এ বছরটাও যেন এভাবেই কাটে এ প্রত্যাশা করছে সবাই। এ বছরে ফ্যাশন ট্রেন্ডেও কিছু পরিবর্তন থাকবে। কিছু ঘোষণা ইতোমধ্যে পাওয়া গেছে। যেমন মোটা বা স্থূলকায় মানুষদের জন্য বিভিন্ন ফ্যাশন হাউস চমকপ্রদ পোশাক বাজারে ছাড়াবে। গর্ভবতী মায়েদের জন্য ফ্যাশনেবল পোশাক আসবে বাজারে। এছাড়া ফ্যাশন ট্রেন্ডে কদর বাড়বে দেশীয় মোটিফের পোশাকগুলোর। স্বদেশী পণ্যের প্রতি তরুণ প্রজন্মের আগ্রহ সে ইঙ্গিতই বহন করে। পুরো বছরে রদবদল থাকলেও সম্ভাব্য এ তালিকাটির খুব সংযোজন বিয়োজন হবে না। তবে নতুন নতুন ট্রেন্ড এ দেশে যুক্ত হতে এখন বেশি সময় নেয় না। যা সত্যিকার অর্থেই ইতিবাচক দিক। সমৃদ্ধ হোক এ বছরের ফ্যাশন ট্রেন্ড সেই সঙ্গে দিনে দিনে ফ্যাশন ট্রেন্ড যেন আরও বর্ণিল হয় সে প্রত্যাশা রইল শুভ নববর্ষ। ছবি : আরিফ আহমেদ মডেল : নুসরাত ফারিয়া আরিফিন শুভ, মেহজাবিন বুলবুল টুম্পা ও সুজানা
×