ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে বাবা-মার ক্ষোভ

সান্ত¡না ছাড়া কিছুই জোটেনি জিহাদের পরিবারের

প্রকাশিত: ০৫:৪৫, ২৭ ডিসেম্বর ২০১৫

সান্ত¡না ছাড়া কিছুই জোটেনি জিহাদের পরিবারের

আনোয়ার রোজেন ॥ দুই ছেলে এক মেয়ে আছিল আমার। এখন এক ছেলে জিসান আর মেয়ে স্বর্ণা। এরা যতবার আম্মা বলে ডাকে তার চেয়ে বেশিবার ডাকত জিহাদ। টিয়াপাখির মতো ‘আম্মা আম্মা’ ডাকছে আমার বাবায়। নিচে খেলতে যাওনের সময় একটু পর পর জোরে জোরে বলত- ‘আম্মা, ও আম্মা, আমারে খেলতে নেয় না’; এটুকুন বলেই আঁচলে মুখ ঢাকেন খাদিজা বেগম (২৫)। একটা দলাপাকানো কষ্ট হয়ত তার বুক বেয়ে গলার কাছে এসে আটকে যায়। বেরুতে পারে না। তবে রক্তজবার মতো লাল চোখ জোড়ায় জমা হওয়া অশ্রু গোপন করতে পারেন না খাদিজা। তা ঠিকই বেরিয়ে আসে। এক বছর আগের এ দিনটিতে (২৭ ডিসেম্বর) পাইপের ভেতর থেকে উদ্ধার করা হয় তার শিশুসন্তান জিহাদের নিথর দেহ। দিনের হিসাবে সন্তানের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। তাই আয়োজন করেছেন মিলাদের। কিন্তু সেখানে না থেকেও যেন বেশি করে থাকছে জিহাদের উপস্থিতি। মায়ের ভাষায়- মিলাদ অনুষ্ঠানের মিষ্টির জন্য পাগল আছিল ছেলেটা। কলোনির কারও মিলাদ বা অন্য কোন অনুষ্ঠানে টুপি পরে সবার আগে হাজির থাকত। মিষ্টি না পাইলে আমার কাছে আইসা বায়না ধরত। আইজ ঘরভর্তি মিলাদের খাওন, তয় পোলা তো আমার কাছে আর খাওন চাইব না...। গত বছর ২৬ ডিসেম্বর বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে রাজধানীর শাহজাহানপুরে বাসার কাছে রেলওয়ে মাঠে খেলতে খেলতে ওয়াসার পাম্পের পাইপের ভেতর পড়ে যায় চার বছরের জিহাদ। প্রায় ২৩ ঘণ্টা পর ২৭ ডিসেম্বর বিকেল তিনটার দিকে জিহাদকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। এরপর শিশুটিকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। জিহাদকে উদ্ধারের ঘটনা সেসময় দেশজুড়ে আলোড়ন তুলেছিল। কিন্তু তারপর কেমন কেটেছে জিহাদের পরিবারের একটি বছর? শনিবার বিকেলে শাহজাহানপুরে রেলওয়ে কলোনির বাসায় কথা হয় জিহাদের মা খাদিজা বেগম ও বাবা নাসির ফকিরের (৩০) সঙ্গে। দোতলায় তাদের দেড়কক্ষের ঘরে মানুষে ভর্তি। এককোণার দেয়ালে জিহাদের ছবি টানানো। ছবির ফ্রেমের ভেতর দিয়ে তাকিয়ে আছে একজোড়া নিষ্পাপ চোখ। বাবা নাসির ফকির ইতোমধ্যে শোক সামলে উঠেছেন। কলোনির বাসিন্দারা মিলে রেলওয়ের মাঠে জিহাদের জন্য মিলাদের আয়োজন করেছেন। সেটার প্রস্তুতি নিয়ে কিছুটা ব্যস্ত। কিন্তু এসবের কিছুতেই যেন মায়ের মন নেই। থেকে থেকেই সন্তানের জন্য ডুকরে কেঁদে উঠছেন। বললেন, জিন্স প্যান্ট আর গেঞ্জি ছিল জিহাদের পছন্দের পোশাক। প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে দুলে দুলে হাঁটত। আর শুক্রবার এলে নিজেই বলত- আম্মা গোসল করাইয়া দেও, নামাজ পড়তে যামু। জিহাদের মৃত্যুর পর তো অনেকেই সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন; সে সবের কতটুকু পেয়েছেন? এমন প্রশ্নে অসহিষ্ণু হয়ে উঠে খাদিজার গলা। ক্ষোভ উগরে দিয়ে বলেন, এতদিন যে কয়জন সরকারী অফিসার আমারে সান্ত¡না দিতে আসছে, তারা প্রত্যেকে যদি এক শ’ টাকা কইরাও দিত, তয় আমার ১০ লাখ টাকা হইয়া যাইত। একটা টাকাও কেউ দেয় নাই। আশপাশের মাইনষে ভাবে আমরা না জানি কত টাকা পাইছি। সরকার কিছু দিলে তো ঢোল পিটাইয়াই দিত, আমাগো গোপনে টাকা দিব ক্যান? এইডা একটু ভাল কইরা লিখবেন- কেউ একটা পয়সাও আমাদের দেয় নাই। পাশে বসা জিহাদের বাবা যোগ করলেন- ছেলে যেখানে মারা গেল সেখানে একটা মিনার করলাম। ৩০ হাজার টাকার মতো খরচ হইছে। মিনার করতে কেউ বাধা দেয় নাই। কিন্তু পুরো টাকাটাই আমার পকেট থেকে দিছি। শুনেছিলেন রেলে চাকরি পাবেন। সেই আশায় মাস তিনেক আগে আরও কয়েকজনের সঙ্গে খালাসির পদে আবেদন করেছিলেন। আর সবারই ইন্টারভিউয়ের কার্ড এসেছে; শুধু তারটাই আসেনি। এ নিয়ে বললেন, জিহাদের মৃত্যুর জন্য যার বিরুদ্ধে মামলা করলাম, রেলওয়ের সেই প্রকৌশলী জাহাঙ্গীর আলম এখন চট্টগ্রামে আছেন। তিনিই আমার আবেদনপত্র বাতিল করেছেন। তার চাকরি দূরের কথা, ছেলের মৃত্যুর জন্য দায়ী কর্মকর্তাদের বিচার আদৌ হবে কিনা তা নিয়েই এখন সন্দিহান নাসির ফকির। তিনি বর্তমানে মতিঝিল মডেল স্কুল এ্যান্ড কলেজে নিরাপত্তা প্রহরীর কাজ করছেন। মেয়ে স্বর্ণা সপ্তম শ্রেণীতে আর ছেলে জিসান নার্সারিতে পড়ছে। এদিকে জিহাদ যে পাইপের ভেতর পড়ে গিয়েছিল, শনিবার বিকেলে সেখানে গিয়ে দেখা যায় একটি স্মৃতিস্তম্ভ। তাতে টাইলসের টুকরোয় কাঁচা হাতে আঁকা হয়েছে জিহাদের ম্যুরাল। নিচে আরও কাঁচা হাতে লেখা- মোঃ জিহাদ, জন্ম : ২২/১২/২০১০, মৃত্যু : ২৬/১২/২০১৪। স্মৃতিস্তম্ভের বেদিতে চারটি ফুলের তোড়া। সবই জিহাদের পরিবারের তরফে। সেখানে কিছুক্ষণ দাঁড়াতেই চোখে পড়ল চার-পাঁচ বছরের কয়েকটি বাচ্চা ছেলে একটা গোলাপ হাতে হাসিমুখে ম্যুরালের দিকে এগিয়ে আসছে। তোমরা জিহাদকে চেন? জিজ্ঞেস করতেই তানভীর নামে এক শিশু হাসিমুখে বলল- ও আমার বন্ধু ছিল। সেদিন আমরা একসঙ্গেই খেলছিলাম। জিহাদের জন্য খারাপ লাগে না? এবার একটু দ্বিধাগ্রস্ত মনে হয় শিশুটিকে। কী বলবে বুঝে উঠতে পারে না। খারাপ লাগা কী জিনিস তা হয় তো বুঝে না। তাই শুধু ওপরে নিচে মাথা দোলায়। শীতের বিকেলের ম্লান আলো পশ্চিমে ঢলে পড়েছে। জিহাদের স্মৃতিস্তম্ভের কাছেই একটি চারতলা বিল্ডিং। সেটার তিন তলার জানালায় চোখ পড়ল। খাড়া লোহার শিক ধরে বছর চারেকের একটি ছেলে আনন্দে লাফালাফি করছে। নিচ থেকে হঠাৎ দেখলে দৃশ্যটা বিপজ্জনক ঠেকবে বৈকি। তবে ছেলেটি জিহাদের মতো হতভাগ্য নয়, তার পেছনে মা দাঁড়িয়ে আছে। তার কিচ্ছু হবে না!
×