ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির দাবি

মুক্তিযুদ্ধ অস্বীকার অপরাধ আইন চাই

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ২৭ ডিসেম্বর ২০১৫

মুক্তিযুদ্ধ অস্বীকার অপরাধ আইন চাই

স্টাফ রিপোর্টার ॥ একাত্তরের গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ‘মুক্তিযুদ্ধ অস্বীকার অপরাধ আইন’ প্রণয়নের দাবি জানিয়েছে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। একই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের ভিকটিমদের ক্ষতিপূরণ আইন করারও দাবি জানিয়েছে সংগঠনটি। মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া ও দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের বিতর্কিত মন্তব্য ঘিরে তুমুল সমালোচনার মধ্যে এ দাবি জানাল সংগঠনটি। যদিও অনেক আগে থেকেই সংগঠনের পক্ষ থেকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস অস্বীকার বা বিকৃতি প্রতিহত করতে ইউরোপের মতো ‘হলোকস্ট ডিনাইয়াল এ্যাক্ট’ প্রণয়নের দাবি ওঠে। শনিবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনী মিলনায়তনে এক সংবাদ সম্মেলনে এ দাবি জানানো হয়। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে। এ থেকে শহীদ পরিবার ও আর্থিকভাবে অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষতিপূরণ এবং পুনর্বাসনেরও দাবি জানানো হয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহরিয়ার কবির। লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, মানবতাবিরোধী অপরাধীদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি এবং ব্যাংকে গচ্ছিত অর্থ বাজেয়াফত করে তা মুক্তিযুদ্ধের ভিকটিম ও পরিবারের কল্যাণে ব্যয় করতে হবে। সংবাদ সম্মেলনে বক্তারা বলেন, মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী এবং তাদের এদেশীয় দোসররা আমাদের ওপর অমানবিক নির্যাতন চালিয়েছে। স্বাধীনতার ৪৪ বছর পর এসে একটি রাজনৈতিক দলের প্রধান মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তিকর বক্তব্য দিচ্ছেন। আমরা তার এই মানসিক নির্যাতন সহ্য করতে চাই না। তাই সরকারের কাছে দাবি, ১৯৭৩ সালের আইনে একটি অধ্যায় সংযোজন করে দ্রুত ‘মুক্তিযুদ্ধ অস্বীকার অপরাধ আইন’ এবং মুক্তিযুদ্ধের ভিকটিমদের ক্ষতিপূরণ আইন’ প্রণয়ন করুন। সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, শহীদের সংখ্যা বিষয়ে সংশয় প্রকাশ করে খালেদা জিয়া এবং বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় যেভাবে বক্তব্য দিয়েছেন, রাজনৈতিক বক্তব্য এমন হতে পারে না। এগুলো এক ধরনের পরিকল্পিত ইতরামি ছাড়া কিছু নয়। এমন বক্তব্য হঠাৎ করে মুখ ফসকে বেরিয়ে এসেছে, এমনটি নয়। তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লাখ শহীদের সংখ্যাটি বঙ্গবন্ধুর আগেও বিদেশি গণমাধ্যমে উঠে এসেছিল। যতদূর মনে পড়ে, অস্ট্রেলিয়ান রেডিওতে এমনটি শুনেছিলাম। তাছাড়া তৎকালীন সরকার (মুজিবনগর সরকার) যখন শহীদের সংখ্যা ত্রিশ লাখ বলে বলেছিল, তখন তারা খোঁজখবর নিয়েই বলেছে। সামান্য কিছু এদিক-সেদিক হতে পারে। কারণ সেই মুহূর্তে লাশ গুনে গুনে শহীদের সংখ্যা নির্ধারণের মতো পরিস্থিতি ছিল না। খালেদা জিয়া ও গয়েশ্বর চন্দ্র রায় যে বক্তব্য দিচ্ছেন তার মধ্যে যোগসূত্র রয়েছে উল্লেখ করে মুনতাসীর মামুন বলেন, যতই প্রতিবাদ করা হোক না কেন, খালেদা ও গয়েশ্বর কি এমন বক্তব্য দেয়া থেকে বিরত থাকবেন? উনারা আগেও এমন নানা বক্তব্য দিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধ অস্বীকার অপরাধ আইনটি পাস করা হলে, এ ধরনের কথাবার্তা বন্ধ হবে। আইনটি দ্রুত পাস করে এর পক্ষে জনমত সৃষ্টি করতে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তিনি। সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে শাহরিয়ার কবির বলেন, কোন খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা যদি একাত্তরের গণহত্যা নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য বা সংশয় প্রকাশ করেন, তাহলে তার খেতাব কেড়ে নেয়ার জন্যও একটি আইন করতে হবে। পাকিস্তান রাষ্ট্র তাদের মিথ্যাচার চালিয়ে যাবেই। কিন্তু আমাদের দেশে কেউ এমনটি করলে ফৌজদারি আইনে তার সাজা নিশ্চিত করতে হবে। এ ছাড়া ইন্টারনেটের (ইউটিউব বার্তা) মাধ্যমে কেউ অপপ্রচার চালালে তার বিরুদ্ধে আইসিটি আইনে ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। লিখিত বক্তব্যে শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধকালে বাংলাদেশে ৩০ লাখ মানুষ শহীদ হননি এ ধরনের মন্তব্য করে বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়া আবারও প্রমাণ করেছেন মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের প্রতি তার যে সমর্থন ও দুর্বলতা ছিল এখনও তা অক্ষুণœ রয়েছে। তার এ ধরনের বক্তব্য শুধু আদালত ও সংবিধান অবমাননা নয়, বাংলাদেশের অস্তিত্ববিনাশী চক্রান্তের অন্তর্গত।’ তার বক্তব্যকে ‘হাল্কাভাবে নেয়ার সুযোগ নেই, মন্তব্য করে শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘খালেদা জিয়ার মুক্তিযুদ্ধবিরোধী বক্তব্যে নিঃসন্দেহে পাকিস্তানের আইএসআই এবং আল কায়েদা ও আইএসের মতো আন্তর্জাতিক জঙ্গী সন্ত্রাসী সংগঠন অনুপ্রাণিত হবে।’ সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগের সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বলেন, জানা মতে বিশ্বের ১৪ দেশে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতাকারীদের শাস্তির আইন প্রত্যক্ষভাবে রয়েছে। এ ছাড়া আরও অনেক দেশে পরোক্ষভাবে তাদের দেশীয় আইনে শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা হচ্ছে এক ধরনের ঘৃণা প্রচারের শামিল। এর ফলে নতুন প্রজন্মের মধ্যেও সংশয় সৃষ্টি হবে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার যখন ক্ষমতায় আছে, তখন দাবি জানাই তারা যেন আর কালবিলম্ব না করে। খালেদা জিয়া এবং ডেভিড বার্গম্যানের মতো লোকদের যেন দ্রুত শাস্তির আওতায় আনা হয়। বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘যুদ্ধাপরাধীদের সব সম্পত্তি বাজেয়াফত করতে আইন করতে হবে বা ৭৩ এর আইনে একটি অধ্যায় সংযোজন করতে হবে।’ যুদ্ধাপরাধীদের সম্পত্তির বাজেয়াফতের বিষয়টি নুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনাল, রুয়ান্ডা ট্রাইব্যুনাল, যুগোসøাভ ট্রাইব্যুনাল ও রোম সংবিধির ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্টে রয়েছে বলে জানান তিনি। ‘এইসব ট্রাইব্যুনালের আইনে বলা আছে, যারা অপরাধী হিসেবে সাজাপ্রাপ্ত হবে তাদের সব সম্পদ বাজেয়াফত করতে হবে।’ বাংলাদেশের গণহত্যার শিকার যারা হয়েছেন তাদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দিতে পাকিস্তানের ওপর সর্বাত্মক চাপ প্রয়াগসহ ২৫ মার্চকে ‘গণহত্যা দিবস’ ঘোষণা এবং একাত্তরের যুদ্ধশিশুদের মধ্যে যারা বাংলাদেশের নাগরিকত্ব গ্রহণে আগ্রহী তাদের নাগরিকত্ব প্রদানের জন্যও সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন ভাস্কর ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী, ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ও শ্যামলী নাসরিন।
×