ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবীর মর্মবাণী

প্রকাশিত: ০৪:৪৬, ২৫ ডিসেম্বর ২০১৫

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবীর মর্মবাণী

প্রিয়নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লাম ৫৭০ খ্রিস্টাব্দের ১২ রবিউল আউয়াল সোমবার সুবিহ্ সাদিকে মক্কা মুকাররমের প্রসিদ্ধ কুরাইশ বংশের হাশেমী গোত্রে আবির্ভূত হন। তাঁর পৃথিবীতে আবির্ভাবের সেই দিনটি উদ্যাপিত হয় ঈদে মিলাদুন্নবী। বিশ্ব মুসলিম মননে ঈদে মিলাদুন্নবী এক অনন্য ঈদের আনন্দ জাগ্রত করে। প্রিয়নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম এই পৃথিবীতে তশরীফ আনেন সমগ্র মানব জাতির কল্যাণের জন্য, সমগ্র বিশ্বজগতের কল্যাণের জন্য। মূলত তাঁর নূর মুবারক সৃষ্টির মাধ্যমে আল্লাহ্ রব্বুল ‘আলামীন তামাম কায়েনাত-সমগ্র সৃষ্টির সূচনা করেন। নূরে মুজাস্সামের মাটির পৃথিবীতে আশ্রাফুল মখলুকাত মানব সুরতে তশরীফ আনবার মধ্য দিয়ে পৃথিবীতে নবী আগমনের ধারাবাহিকতার সমাপ্তি ঘটে। তার নূর মুবারক সৃষ্টি করে আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু সৃষ্টির সূচনা করেন। মূলত তাঁর নূর মুবারকই সমগ্র সৃষ্টির উৎস। তাঁর থেকেই সব কিছু সৃষ্টি করেছেন খালিক-মালিক আল্লাহ্। তিনি রহমাতুল্লিল ‘আলামীন-বিশ্বজগতের জন্য রহমত।’ তাঁর মধ্যে রয়েছে সর্বোত্তম আদর্শ-অনুপম আদর্শ। কবি শেখ সাদী (র)-এর ভাষায় : ‘হাসুনাত জামি ’উ খিসালিহী’। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লাম এই পৃথিবীতে তশরীফ আনলেন এমন এক যুগকালে যখন সমগ্র পৃথিবীতে মানবতা ধুঁকে ধুঁকে মরছিল, অজ্ঞতা আর র্শিক-কুফরে সারা পৃথিবী ছেয়ে গিয়েছিল। আইয়ামে জাহিলিয়াতের সেই ঘনকালো অমানিশা দূর করতে, মানতকে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত করতে, সত্য-সুন্দরকে প্রতিষ্ঠিত করতে তিনি এলেন মুক্তিদাতা হিসেবে, তিনি রাউফুর রাহীম, আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু তাঁর নিজের গুণে তাঁকে গুণান্বিত করেছেন। প্রিয়নবী (সা) সম্পর্কে আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু ইরশাদ করেন : “অবশ্যই তোমাদের মাঝ থেকেই তোমাদের কাছে এক রসূল এসেছেন। তোমাদেরকে যা বিপন্ন করে তা তাঁর জন্য খুবই কষ্টের হয়। তিনি তোমাদের কল্যাণকামী, মু’মিনদের প্রতি তিনি অত্যন্ত স্নেহশীল পরম দয়ালু।” তাঁর আবির্ভাব হলো এমন এককালে যখন অজ্ঞতা আর অন্ধকারে নিমজ্জিত পৃথিবীর মানুষ ধর্মহীনতা ও অধর্মের বিষবাষ্পে শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় নিপতিত। পৃথিবীর মানুষ, শিরক্, কুফর, কুসংস্কার আর মস্তিষ্কজাত অন্ধবিশ্বাসের বিষাক্ত ছোবলে জর্জরিত। পৃথিবীর মানুষ পথভ্রষ্টতার নিকষকালো অন্ধকারে দিশাহারা। পশুত্ব আর লোলুপতার শেকলে বিপর্যস্ত পৃথিবীর মানুষ এক করুণ অবস্থার মধ্য দিয়ে দিন গুজরান করছিল। আশ্রাফুল মখলুকাত বনী আদম আল্লাহকে ভুলে যেয়ে কল্পিত দেব-দেবীর পূজা করে, পাথর পূজা করে, সূর্য, পাহাড় এমনকি পুরোহিতদেরও পূজা করে। ত্রিত্ববাদ ও বহুত্ববাদের আবর্তে নিপতিত হয়ে মানবিক মূল্যবোধ পৃথিবী থেকে উঠে গেছে। সত্য বলতে কোথাও কিছু নেই, সততা বলতে কোথাও কিছু নেই, মনুষ্যত্ব নেই, ন্যায়-নীতি নেই, ন্যায়বিচার নেই, দয়া-মায়া বলতে কোথাও কিছু নেই। ক্রীতদাস প্রথা, নারী নির্যাতন, যুলুম-অত্যাচার বিশ্বটাকে কুরে কুরে ঝাঁঝরা করে দিচ্ছিল। পৃথিবীর সর্বত্র তখন নৈরাজ্য, নৈরাশ্যের বিষণœতা ছায়া ফেলে। সামন্তবাদ, প্রভুত্ববাদ, আধিপত্যবাদ, সাম্রাজ্যবাদ এবং রাজতন্ত্রের শৃঙ্খলে পৃথিবীর প্রায় আটানব্বই ভাগ মানুষ বন্দী দশায় কোনোমতে বেঁচে আছে। তাঁর আবির্ভাবে পৃথিবী আলোর সন্ধান পেলো, শান্তির সন্ধান পেলো, মুক্তির সন্ধান পেলো। তিনি তো আলোর আলো। তাঁর এই পৃথিবীতে তশরীফ আনার ফলে র্শিক ও কুফরের ভিত্তি ভেঙ্গে চৌচির হয়ে যায়, মারামারি, হানাহানি, কাটাকাটি আর হিংস্রতার পৃথিবীতে নেমে আসে শান্তির হাওয়া, সত্য-সুন্দর ও মানবতার বিজয় বারতা ঘোষিত হয়। ঘোষিত হয়Ñ লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহামম্মাদুর রসূলুল্লাহ- আল্লাহ্ ছাড়া নেই কোনো ইলাহ্ হযরত মুহম্মদ (সা) আল্লাহ্র রসূল। আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু তাঁর প্রিয় হাবীব সাইয়্যেদুল মুরসালীন খাতামুন্নাবীয়ীন রহমাতুল্লিল ‘আলামীন শাফিউল মুযনিবীন হযরত মুহম্মদ মুস্তাফা আহ্মদ মুজতবা (সা)- কে এই পৃথিবীতে প্রেরণ করলেন তাঁর মনোনীত পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা কায়েম করার জন্য। আর সেই আল্লাহ্র দেয়া একমাত্র জীবন ব্যবস্থাই হচ্ছে ইসলাম। এই জীবন ব্যবস্থাই দুনিয়ার কল্যাণ বয়ে আনে, আখিরাতের কল্যাণ বয়ে আনে, মানবিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করে, আল্লাহ্র রবুবিয়্যাত কায়েম করে। এটাই আদ্দীনুল হক, এটাই আস্সিরাতুল মুস্তাকীম। কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে : “তিনি (আল্লাহ্) যিনি তাঁর রসূলকে হিদায়াত ও সত্য দীনসহ প্রেরণ করেছেন অপর সমস্ত ধর্ম-এর উপর বিজয়ী করার জন্য। আর সাক্ষী হিসেবে আল্লাহ্ই যথেষ্ট (সূরা ফাত্হ : আয়াত ২৮)।” প্রিয়নবী (সা) এর মহান আখ্লাকে সমস্ত গুণের সমাবেশ ঘটেছে। আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু ইরশাদ করেছেন : “আর আপনি অবশ্যই সুমহান আখ্লাকের উপর সুপ্রতিষ্ঠিত” (সুরা কালাম : ৪)। একবার এক সাহাবী উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়িশা সিদ্দীকা (রা)-এর কাছে প্রিয়নবী (সা) এর আখ্লাক সম্পর্কে জানতে চাইলে হযরত আয়িশা সিদ্দীকা (রা) বললেন : কুরআন মজীদই তাঁর আখ্লাক। হযরত আয়িশা সিদ্দীকা (রা) এর এই একটি ছোট্ট উক্তির মধ্যে প্রিয়নবী (সা) এর মহান এই একটি ছোট্ট উক্তির মধ্যে প্রিয়নবী (সা.) এর মহান জীবনাদর্শের সার্বিক চেহারা প্রস্ফুটিত হয়ে উঠেছে। প্রিয়নবী (সা.) বলেছেন, “মহান আখ্লাকসমূহ পূর্ণভাবে বিকশিত করার জন্য আমাকে পাঠানো হয়েছে।” কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে : “আল্লাহ্র নিকট হতে এক নূর ও স্পষ্ট কিতাব তোমাদের কাছে এসেছে। যারা আল্লাহ্র সন্তুষ্টি লাভ করতে চায়, এর দ্বারা তিনি তাদেরকে শান্তির পথে পরিচালিত করেন এবং অন্ধকার থেকে বের করে আলোর দিকে নিয়ে যান (সূরা মায়িদা : আয়াত ১৫-১৬।” প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লাম-এর আখ্লাক, তাঁর জীবনাদর্শ আল্লাহ্ জাল্লা শানুহুই গড়ে তুলেছেন। তিনি যা কিছু বলেছেন তা সবই আল্লাহ্ কর্তৃক আদিষ্ট হয়ে বলেছেন এবং তিনি যা কিছু করেছেন তা সবই আল্লাহ্র হুকুম বাস্তবায়নের জন্য করেছেন। আল্লাহ্ তাঁকে যা করতে আদেশ করেছেন তিনি তা পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে পালন করেছেন, যা করতে আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু নিষেধ করেছেন তা আদৌ করেননি। আল্লাহ্ জাল্লা শানুহুর নির্দেশ মুতাবিকই তিনি মানুষের সামনে হিদায়াতের বাণী পৌঁছে দিয়েছেন এবং মানুষকে সত্য ও সুন্দর পথের দিশা দান করেছেন। কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে : “এবং তিনি নিজের থেকে কিছুই বলেন না, তাঁর কাছে যে ওহী আসে তিনি সেই ওহীই বলেন।” তিনি মহান আখ্লাকসমূহকে নিজে যেমন আমল দ্বারা পূর্ণভাবে বাস্তবায়িত করেছেন, তেমনি তাঁর সাহাবীগণ তাঁকে হুবহু অনুসরণ ও অনুকরণ করে সেই মহান আখ্লাকের গতিধারাকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। যার প্রবাহ যুগে যুগে শ্রেষ্ঠ জীবনাদর্শরূপে গতি সঞ্চারিত করে আসছে। লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহম্মদুর রসূলুল্লাহ- ‘আল্লাহ্ ছাড়া কোনো ইলাহ্ নেই, মুহম্মদ (সা) আল্লাহর রসূল’- কালেমা তায়্যেবার এই চিরন্তন সত্য তাঁর জীবনাদর্শের মূল চেতনা, তাওহীদ ও রিসালতের সুদৃঢ় বুনিয়াদের উপর তা সংস্থাপিত। সে জীবনাদর্শের সালাত, সিয়াম, হজ্জ, যাকাত বিধানের সমুজ্জ্বল ধারা মানবিক মূল্যবোধকে বুলন্দ করেছে, আল্লাহ্র সঙ্গে বান্দার সম্পর্ক সুনিবিড় করে দিয়েছে। প্রিয়নবী (সা) আল্লাহ্র যিকর অধিক পরিমাণে করবার তাকিদ বয়ে আনলেন। আল্লাহ্ তা’আলা ঘোষণা করলেন : “নিশ্চয় আল্লাহ্র যিক্র অন্তরে প্রশান্তি আনে।” একদিন এক ব্যক্তি প্রিয়নবী (সা) এর দরবারে আরয করলেন : ইয়া রসূলাল্লাহ্! ইসলামের বহু হুকুম-আহকাম আছে যা অবশ্যই পালন করতে হবে। তবুও আমাকে এমন একটি বিষয়ে শিক্ষা দিন যা প্রাণপ্রিয় সাক্ষী করে রাখতে পারি। প্রিয়নবী (সা.) বললেন : “জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তোমার জিহ্বা যেনো আল্লাহ্র যিকরে সিক্ত থাকে।” প্রিয়নবী (সা) এর জীবনাদর্শে তাবত্ গুণের সমাবেশ ঘটেছে। তিনি যেমন সর্বশ্রেষ্ঠ মানব, তেমনি তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ নবী। আল্লাহ্ তা’আলা বিশ্বগত সৃষ্টির পূর্বে তাঁরই নূর অর্থাৎ নূরে মুহাম্মদী সৃষ্টি করেন। হযরত আদম (আ.)-এর জন্মেরও বহু পূর্বে আল্লাহ্ তা’আলা হযরত মুহম্মদ (সা.)-কে নবুওয়াত দান করেন। যিনি সবার আগে নবুওয়াত প্রাপ্ত হলেন, আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু তাঁর পৃথিবীতে আগমনের খবর পৌঁছে দেবার জন্য সেই আলমে আরওয়াহ্ তে সব নবী-রসূলের কাছ থেকে মীসাক বা অঙ্গীকার গ্রহণ করেছিলেন। কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে : “আর যখন আল্লাহ্ নবীদের অঙ্গীকার গ্রহণ করেছিলেন যে, তোমাদেরকে কিতাব ও হিকমত যা কিছু দেই অতঃপর তোমাদের যা কিছু থাকে তার সমর্থকরূপে যখন একজন রসূল আসবেন তখন তোমরা অবশ্যই তাঁর প্রতি ঈমান আনবে এবং তাঁকে সাহায্য করবে। তিনি (আল্লাহ্) বললেন : তোমরা কী স্বীকার করলে? এবং এ সম্পর্কে আমার অঙ্গীকার কি তোমরা গ্রহণ করলে? তারা বললো : আমরা স্বীকার করলাম। তিনি (আল্লাহ্) বললেন : তোমরা সাক্ষী থাকো এবং আমিও তোমাদের সাথে সাক্ষী থাকলাম।” (সূরা আল ইমরান : আয়াত ৮১)। এই আয়াতে কারীমার ব্যাখ্যায় হযরত আলী (রা), হযরত আবদুল্লাহ্ ইব্নে আব্বাস (রা) প্রমুখ বলেছেন যে, আল্লাহ্ তা’আলা অঙ্গীকার নেন যে, যদি তাঁরা নিজেরা তাঁর আমলে জীবিত থাকেন তাহলে তাঁর উপরই মান এনে তাঁকে সহযোগিতা করবেন। নিজেদের উম্মাতদেরকেও এ ব্যাপারে যেন তাঁরা নির্দেশ দিয়ে যান। কুরআন মজীদের উপরিউক্ত আয়াতে কারীমা দ্বারা এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, হযরত আদম (আ.)-এর পয়দা হবারও বহু পূর্বে রূহের জগতে প্রিয়নবী হযরত মুহম্মদ (সা)-এর নবুওয়াত ও রিসালাত প্রদানের ঘোষণা দিয়ে আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু সব নবী-রসূলের কাছ থেকে এই অঙ্গীকার করেন যে, তাঁরা যেন তাঁর প্রতি ঈমান আনে, তাঁদের উন্মতদেরকেও ঈমান আনতে বলেন এবং তিনি যদি তাঁদের আমলে আবির্ভূত হন তাহলে অবশ্যই তাঁকে মদদ জোগাবেন আর যদি না পান তাহলে উম্মত পরম্পরায় তাঁর আগমন বারতা যেনো দিয়ে যান। প্রিয়নবী (সা.) বলেছেন : “আদম (আ) পানি ও মাটির মধ্যে লীন ছিল তখনও আমি নবী ছিলাম।” তিনি আরো বলেছেন : “আমি রসূলগণের পূর্বাভাস এবং নবীগণের পরিসমাপ্তি।” এর দ্বারা এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, তিনিই প্রথম নবী ও রসূল কিন্তু পৃথিবীতে তাঁর আগমন ঘটে সবার শেষে, তিনি খাতামুন্নাবিয়ীন- সর্বশেষ নবী। তিনি পৃথিবীতে আবির্ভূত হলেন সবার পরে, তিনি সাইয়্যেদুল র্মুসালীন-সব রসূলদের নেতা, খাতামুন্নাবিয়ীন, সর্বশেষ নবী, নবীগণের সমাপ্তি। তিনি ন্যায়পরায়ণতা, দানশীলতা, বদান্যতা, বিনম্রতা, মমতা, বিশ্বস্ততা, সত্যবাদিতা, ধর্মপরায়ণতা, নির্ভীকতা, সাহসিকতা, সহিষ্ণুতা প্রভৃতি সকল গুণের অনুপম আদর্শ। সত্য প্রতিষ্ঠা করতে যেয়ে তাঁকে অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে। মক্কার কাফির-মুশ্রিকরা তাঁর ওপর চালিয়েছে অকথ্য যুলুম-নির্যাতন। তাঁকে তারা উপহাস করেছে আবার নানা রকম প্রলোভনও দেখিয়েছে সত্য প্রচার থেকে নিবৃত্ত হবার জন্য। কিন্তু তিনি আল্লাহর দেয়া দায়িত্ব পালন করা থেকে একটুও নিবৃত্ত হননি। নির্ভীকচিত্তে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি বলেছেন : “আল্লাহর কসম, আমার এক হাতে সূর্য আর এক হাতে চাঁদ এনে দিলেও আমার ওপর যে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে তো পালন করা থেকে আমি পশ্চাৎপদ হবো না।” প্রিয়নবী (সা.) তায়েফে গিয়েছেন সত্যের পথে আহ্বান জানানোর জন্য। তায়েফবাসী তাঁর আহ্বানে সাড়া না দিয়ে পাথর মেরে তাঁকে রক্তাক্ত করে দিয়েছে, তবুও তিনি তাদের জন্য বদদু’আ করেননি। আল্লাহর নির্দেশে তিনি মক্কা থেকে হিজরত করে মদীনায় এসেছেন। মদীনা মুনওয়ারায় প্রতিষ্ঠিত করেছেন একটি আদর্শ কল্যাণ রাষ্ট্র। প্রণীত হয়েছে পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম লিখিত শাসনতন্ত্র মদীনার সনদ। মক্কার কাফির-মুশ্রিকরা মদীনার ইয়াহুদী ও মুনাফিকরা যৌথভাবে তাঁকে পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন করবার ষড়যন্ত্রে মেতেছে। তারা মদীনা আক্রমণ করেছে। প্রিয়নবী (সা) সমস্ত আক্রমণ প্রতিহত করেছেন। যুদ্ধ করেছেন। সব যুদ্ধই ছিল আত্মরক্ষামূলক। প্রতিটি যুদ্ধেই তাঁর বিজয় পতাকা উড্ডীন হয়েছে। অতঃপর মক্কা জয় হয়েছে। শত্রু তাঁর পদানত হয়েছে। তিনি কোনো প্রতিশোধ গ্রহণ করেননি। সবাইকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। সে ক্ষমার নজীর বিশ্ব ইতিহাসে দেখা যায় না। ঘোষিত হয়েছে : “সত্য সমাগত, মিথ্যা দূরীভূত, নিশ্চয়ই মিথ্যা দূর হবার।” মহানবী (সা) দয়া, ক্ষমা ও সহমর্মিতা দ্বারা সব ধরনের নিষ্ঠুরতা মুকাবিলা করেছেন। আল্লাহ জাল্লা শানুহু তাঁকে ‘রাউফুর রাহীম’ অর্থাৎ দয়াবান দয়ালু খেতাবে ভূষিত করেছেন। তাঁর কাছে কেউ সাহায্য প্রার্থী হলে তিনি তাকে ফিরিয়ে দিতেন না। তিনি বলেছেন : “এক খ- শুকনো খেজুর দান করার থাকলেও তাই দান করে জাহান্নাম থেকে রক্ষা পাবার চেষ্টা করো।” যদি অতোটুকুও সামর্থ্য না থাকে তাহলে অন্তত মিষ্টভাষী হয়ে সে চেষ্টা অব্যাহত রাখো। তিনি বলেছেন : “প্রতিবেশীকে অভুক্ত রেখে যে পেটপুরে খায় সে মু’মিন নয়।” প্রিয়নবী (সা) অতি অনাড়ম্বর জীবন-যাপন করতেন। খেজুর পাতার ছাউনি দেয়া একটি ছোট্ট কুটিরে তিনি থাকতেন। কোনোদিন মিহি আটার রুটি খাননি। তাঁর গৃহে খাদ্যাভাব প্রায়ই লেগে থাকতো। জীবনে কখনো আরাম বিছানায় শয়ন করেননি। হযরত আবদুল্লাহ্্ ইব্নে মাস‘উদ (রা) বর্ণিত একখানি হাদীস থেকে জানা যায় যে, মহানবী (সা) খেজুর পাতার মাদুরের উপর শয়ন করতেন। তাঁর জিসাম মুবারকে মাদুরের দাগ বসে যেতো। একদিন হযরত আব্দুল্লাহ ইব্নে মাস‘উদ (রা) প্রিয়নবী হযরত মুহম্মাদুর রসূলাল্লাহ (সা) কে বললেন; ইয়া রসূলাল্লাহ্্! আপনি যদি ইজাযত দেন তাহলে মাদুরের উপর কিছু বিছিয়ে দেই। একথা শুনে প্রিয়নবী (সা) বললেন : “আমি তো একজন মুসাফিরের মতো, সে ক্ষণিক সময়ের জন্য একটি গাছের ছায়ায় বিশ্রাম নিয়ে আবার সব ছেড়ে চলে যায়।” তিনি কারো অসুখ-বিসুখের কথা শুনলে তাকে দেখতে যেতেন। তিনি বলেছেন : “রোগীর সেবাকারী নিজ গৃহে ফিরে না আসা পর্যন্ত জান্নাতের পথে চলতে থাকে।” প্রিয়নবী (সা) ক্রীতদাস প্রথার শেকড় উৎপাটন করেন, গরীব-দুঃখী ও অসহায় মানুষের পৃথিবীতে খেয়ে-পরে বেঁচে থাকবার অধিকার নিশ্চিত করেন। কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে : “ধনীদের ধন সম্পদে ভিক্ষুক ও বঞ্চিতের ন্যায্য অধিকার রয়েছে।” প্রিয়নবী (সা.) শিশুদের প্রতি ছিলেন অত্যন্ত স্নেহপরায়ণ, ইয়াতীমদের প্রতি তাঁর ছিল অপরিসীম দরদ। এমনকি জীব-জন্তু, গাছপালার প্রতিও তিনি ছিলেন দারুণ দরদী, তাঁর জীবনাদর্শ উস্্ওয়াতুত্্ হাসানা, তা গ্রহণের মাধ্যমেই কেবল পৃথিবীতে সুখ-শান্তি প্রগতি ও সমৃদ্ধি আসতে পারে। ‘ইসলাম হার মরাল এ্যান্ড স্পিরিচুয়্যাল ভ্যালু’ গ্রন্থে মেজর আর্থার গ্লায়ন লিউনার্ড বলেছেন : “নবী হিসেবেই তিনি কেবল শ্রেষ্ঠ নন, বরং একজন দেশ প্রেমিক হিসেবে, রাষ্ট্র পরিচালনায় সুযোগ্য ও দক্ষ ব্যক্তিত্ব হিসেবে, দুনিয়াবী ও রূহানী নির্মাতা হিসেবে তিনি শ্রেষ্ঠ। তিনি সংস্থাপন করেছেন একটি শ্রেষ্ঠ বসতি ও সাম্রাজ্য। এই তিন মাহাত্ম্য ছাড়াও তাঁর সংস্থাপিত দীন আজো সর্বশ্রেষ্ঠ। তা ছাড়া তিনি যে সত্য কায়েম করেন তার যথার্থ কারণ হচ্ছে তিনি নিজের কাছে নিজে সত্য ছিলেন, তার জনগণের নিকট বিশ্বস্ত ছিলেন, সর্বোপরি তাঁর রব্্-এর অনুগত ছিলেন।” জর্জ বার্নার্ড শ’র ভাষায় বলা যায় If all the world was united under one leader Muhammad would have been the best fitted man to lead the peoples of various creeds dogmas and ideas to peace and happiness. -“পৃথিবীর নানা ধর্ম-মত, ধর্ম-বিশ্বাস ও চিন্তাধারার লোককে শান্তি ও সুখের পথে পরিচালিত করবার জন্য গোটা পৃথিবীটাকে একত্র করে যদি নেতা খোঁজা হয় তাহলে সর্বোত্তম ও যোগ্যতম ব্যক্তি হবেন হযরত মুহম্মদ (সা.)।” লেখক : পীর সাহেব দ্বারিয়াপুর শরীফ, উপদেষ্টা ইনস্টিটিউট অব হযরত মুহম্মদ (সা.) সাবেক পরিচালক ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ
×