ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ

যৌথ প্রযোজনার সিনেমা না প্রতারণা?

প্রকাশিত: ০৬:১৪, ২৪ ডিসেম্বর ২০১৫

যৌথ প্রযোজনার সিনেমা না প্রতারণা?

১৯৮৬ সালের নীতিমালায় বলা আছে, যৌথ প্রযোজনার ছবি নির্মাণে নির্মাতা, শিল্পী, কলাকুশলী দু’দেশ থেকে সমহারে থাকতে হবে। দু’দেশে শূটিং হতে হবে। কিন্তু ২০১২ সালের পরিবর্তিত নীতিমালায় উল্লেখ আছে দু’দেশের নির্মাতা আলোচনার ভিত্তিতে সব বিষয় চূড়ান্ত করবে। নির্মাতারা বলেন, আসলে এটি শুভঙ্করের ফাঁকি ছাড়া আর কিছুই নয়। ২০১৪ সালে বিতর্কিত পরিচালক অনন্য মামুনের হাত ধরে ‘আমি শুধু চেয়েছি তোমায়’ নামক যৌথ প্রতারণার চলচ্চিত্র মুক্তি পায়। এতে নায়ক-নায়িকা চরিত্রে বাংলাদেশের কাউকেই সুযোগ দেয়া হয়নি। এ নিয়ে চলচ্চিত্রাঙ্গনে তীব্র সমালোচনার ঝড় তৈরি হয়। চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতি থেকে ব্যান হয় অনন্য মামুন জাল ও ভুয়া সার্টিফিকেট দিয়ে ছবিটি মুক্তি দেয়ার দায়ে। এর পরে ২০১৫ সালে রোমিও বনাম জুলিয়েট নামে আরও একটি সিনেমা নিয়ে চলচ্চিত্রপ্রেমীদের মনে দাগ কাটে, যেটিতে নায়কের চরিত্রে ওপার বাংলার অঙ্কুশ এবং নায়িকা চরিত্রে বাংলাদেশের মাহিয়া মাহি। এ সিনেমার পোস্টারে কোন পরিচালকের নাম ব্যবহার করা হয়নি। ধারণা করা হয় এ ছবিটির বাংলাদেশের অংশের কাজও অনন্য মামুনকে দিয়েই করানো হয় এবং নেটে আবদুল আজিজের নাম ব্যবহার করা হয়, কিন্তু সিনেমার পোস্টারে কোন পরিচালকের নামই ব্যবহার করা হয় না। চলতি বছর ‘আশিকী’ নামে যৌথ প্রযোজনার ছবি নির্মাণ করে। সে ছবিতেও ভারতীয় ভার্সনে পরিচালক কিংবা প্রযোজক হিসেবে কারও নাম ছিল না। অথচ প্রতারণার বিষয়টি ঢাকতে বাংলাদেশে প্রদর্শিত পোস্টার কিংবা হল প্রিন্টে পরিচালক হিসেবে কলকাতার অশোকপাতির নামের পাশে জাজের কর্ণধার আবদুল আজিজের নামও দেখা গেছে। বাংলাদেশের একজন সিনিয়র প্রযোজক বলেন, ‘মাত্র বিশ-পঁচিশ হাজার টাকা দিয়ে দেশের কোন পরিচালকের নাম কিনে সিনেমায় ব্যবহার করা হচ্ছে। ঐ পরিচালক শূটিংয়ের তারিখ পর্যন্ত জানে না।’ যার সত্যতা পাওয়া যায় অনন্য মামুন ও অশোকপতি নির্মিত ছবিতে। কারণ কলকাতায় ছবিটির টাইটেল বা পোস্টারে এ দেশের নির্মাতার নাম এবং এটি যে যৌথ আয়োজনের ছবি তার কোন উল্লেখ নেই। এছাড়া দেশী শিল্পীদের অবহেলার চিত্র ফুটে ওঠে অগ্নি টু, ব্ল্যাক ছবিতেও। নায়িকা ছাড়া মুখ্য চরিত্রে বাংলাদেশের কাউকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। তাই নতুন করে যৌথ আয়োজনের ছবি নির্মাণের আগে ১৯৮৬ সালের নীতিমালা পুনর্বহালের দাবি সর্বস্তরের সিনেমাপ্রেমীদের। সিনিয়র নির্মাতার মধ্যে নায়করাজ রাজ্জাক বলেন, ‘যৌথ আয়োজনে ছবি নির্মাণ হয়েছে এবং হবে এটিই স্বাভাবিক। কিন্তু কেন এবং কার স্বার্থে নতুন করে নীতিমালা তৈরি করতে হয়েছে জানি না। এ কারণে নতুন করে সমস্যাও দেখা দিয়েছে। তাই আগের নীতিমালা অনুযায়ী বা বর্তমান সময়োপযোগী করে নীতিমালা তৈরি করে কাজ করা দরকার।’ চিত্র নায়িকা সুচন্দা বলেন, ‘দুই দেশের তারকা শিল্পীদের এক মঞ্চে হাজির করতে, নতুন স্বাদ যোগ করতে যৌথ আয়োজনে চলচ্চিত্র নির্মাণ হতেই পারে। যা আগেও হয়েছে। কিন্তু নীতিমালা যদি সঠিক না হয় তাহলে উভয়পক্ষেরই ক্ষতি হবে।’ একই কথা জানান চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির সহ-সভাপতি সুদীপ্ত কুমার দাশ। নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, গিয়াসউদ্দীন সেলিম, স্বপন আহমেদ, মুস্তাফা কামাল রাজ, রেদোয়ান রনি, শাহীন কবির টুটুলসহ এই প্রজন্মের প্রায় সব নির্মাতার অভিন্ন মত। তাদের কথায় যৌথ প্রযোজনায় ছবি নির্মাণ হয়েছে এবং হতেই পারে। তবে তা হতে হবে সমতার ভিত্তিতে। তাই উভয়পক্ষের স্বার্থ সংরক্ষণে ১৯৮৬ সালের নীতিমালার কোন বিকল্প নেই। এদিকে কলকাতার সঙ্গে যৌথ আয়োজনে যেসব ছবি নির্মাণ হতে যাচ্ছে সেগুলো হলো- নায়ক ফেরদৌস প্রযোজিত ‘বিয়ের ফাঁদে’, উত্তম আকাশের ‘ঢাকার ছেলে কলকাতার মেয়ে’, অনন্য মামুনের ‘ঈদ মোবারক’ ,ইফতেখার চৌধুরীর ‘মোটকা’ এবং শাকিব খান প্রযোজিত নাম চূড়ান্ত না হওয়া দুটি ছবি। অর্থনীতিবিদদের মতে যৌথ প্রযোজনার নামে মূল প্রতারণা হয় আর্থিক খাতে। অর্থ প্রাচারের এর চেয়ে সহজ মাধ্যম এখন পর্যন্ত আবিষ্কার হয়নি। যৌথ প্রযোজনার আড়ালে ভয়াবহ রকম অর্থ পাচার করা হচ্ছে বলেই অনেক চলচ্চত্রি বোদ্ধাই অভিযোগ করেছেন। দেশপ্রেম তথা দেশের চলচ্চিত্রের প্রতি শ্রদ্ধা কিংবা ভালবাসা জলাঞ্জলি দিয়ে এসব প্রযোজক-নির্মাতারা দেশের সংস্কৃতিবিরোধী, সর্বোপরি দেশবিরোধী এসব কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন। শীঘ্রই-এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য তথ্য, অর্থ, বাণিজ্য ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন চলচ্চিত্রপ্রেমীরা। এছাড়া চুক্তি ভঙ্গের অভিযোগে ‘ব্ল্যাক’ ছবির প্রদর্শন বন্ধ করার দাবিতে ২৭ নবেম্বর কলকাতা হাইকোর্টে একটি মামলা দায়ের করেন ওই ছবির বাংলাদেশের প্রযোজক কামাল মোহাম্মদ কিবরিয়া। তার অভিযোগ, কলকাতার প্রযোজনা সংস্থা দাগ ক্রিয়েটিভ মিডিয়া প্রাইভেট লিমিটেড চুক্তি ভঙ্গ করেছে। তাদের বাণিজ্যিক চুক্তিতে আছে, ছবিটি দুই দেশে একইদিনে মুক্তি পাবে। কিন্তু কলকাতার প্রযোজনা সংস্থা বাংলাদেশের প্রযোজককে না জানিয়ে একতরফাভাবে কলকাতায় মুক্তি দেয়। এতে করে বাংলাদেশের প্রযোজনা সংস্থা আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। তাই কলকাতার প্রদর্শন বন্ধ রেখে একযোগে দু’দেশে মুক্তির আরজি জানান। বাংলাদেশী নায়িকাদের আপত্তিকর দৃশ্যে অভিনয়ের প্রস্তাব দেয়ার অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। যে চরিত্রে কলকাতার প্রতিষ্ঠিত নায়িকারা আপত্তি জানাচ্ছে সেই চরিত্রই এদেশের নায়িকার দেয়া হচ্ছে। জয়া আহসানের রাজকাহিনী মুক্তির পর থেকেই এমন অভিযোগের পক্ষে শক্ত মত পাওয়া যাচ্ছে। আশীকি ছবিতে চরিত্রের গুরুত্ব নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছন স্বয়ং মৌসুমী। এছাড়া তাকে এমন গুরুত্বহীন চরিত্রে দেখা যায় যা বাংলাদেশের ছবিতে কল্পনাও করা যায় না। সিনিয়র একজন অভিনেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘তারা আমাদের শিল্পীদের নামে মাত্র কাস্টিং করেন এদেশের বাজার ধরার জন্য। আমাদের উচিত দেশীয় শিল্পকে যথাযথ বিকাশ করা।’ অনুসন্ধানে একটি বিষয় জানা গেছে, মূলত অর্থ পাচারের জন্যই ছবিগুলোর বাংলাদেশী ভার্সনে যৌথ প্রযোজনার নাম দেয়া হয়। বাংলাদেশের নির্মাতারা দীর্ঘদিন ধরেই যৌথ প্রযোজনায় সিনেমা নির্মাণ করে আসছেন। যৌথ প্রযোজনার ছবি নিয়ে একটি সুদীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। ১৯৭৩ সাল থেকে বাংলাদেশে যৌথ প্রযোজনার ছবি নির্মাণ শুরু“হয়। প্রখ্যাত নির্মাতা আলমগীর কবিরের পরিচালনায় ‘ধীরে বহে মেঘনা’ ছবির মাধ্যমে যৌথ প্রযোজনায় ছবি নির্মাণের সূচনা ঘটে। একই বছর ঋত্বিক ঘটকের পরিচালনায় ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ মুক্তি পায়। শুধু ভারতের সঙ্গেই নয়; ১৯৮৩ সালে ভারত, বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানের সম্মিলিত প্রযোজনায় ‘দূরদেশ’ শীর্ষক ছবিটি নির্মিত হয়েছিল। এরপর থেমে থেমে যৌথ প্রযোজনায় ছবি নির্মিত হয়ে আসছে। যদিও সেই সময়কার নিয়ম-কানুন অনেকটা কড়াকড়ি ছিল। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, তখনকার নির্মাতারা নিয়মমাফিক কাজ করতেন। তাই তখন যৌথ প্রযোজনার ছবি নিয়ে ততোটা সমালোচনা হয়নি। এমনিতেই যৌথ প্রযোজনার ক্ষেত্রে কিছু শর্ত মেনে চলতে হয়। ১৯৮৬ সালের যৌথ প্রযোজনার নীতিমালায় সব দেশের শিল্পীদের সমান হারে অংশগ্রহণের নিশ্চয়তা বাধ্যতামূলক ছিল। তবে সম্প্রতি দুই দেশের যৌথ প্রযোজনার ছবি নিয়ে বেশ সমালোচনা হয়েছে। এতে অনেক নিয়মকানুন মানা হচ্ছে না বলে চলচ্চিত্রবোদ্ধারা মনে করছেন। এ ছাড়া বার বার যৌথ প্রযোজনার নামে বাংলাদেশের নির্মাতা, শিল্পী ও কলাকুশলীদের বিভিন্নভাবে ঠকানো হচ্ছে। তবে যৌথ প্রযোজনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা এসব সমস্যার সমাধান করতে পারলে দেশের চলচ্চিত্রশিল্পে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। নয়তো শিল্পী হায়দারের মত ‘কী দেখার কথা কী দেখছি’ বলে আফসোস করা ছাড়া উপায় থাকবে না।
×