ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

এক বছরের কূটনীতি

ভারতের সঙ্গে ছিটমহল বিনিময় বছরের সবচেয়ে বড় সাফল্য

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ২৪ ডিসেম্বর ২০১৫

ভারতের সঙ্গে ছিটমহল বিনিময় বছরের সবচেয়ে বড় সাফল্য

তৌহিদুর রহমান ॥ ২০১৫ সালে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকারের কূটনৈতিক সাফল্য এসেছে। ভারতের সঙ্গে স্থলসীমান্ত চুক্তির বাস্তবায়ন ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফর ছিল অন্যতম আলোচিত ঘটনা। মোদির সফরের সময় বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ১৯ চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হয়। এছাড়া চীনের উপপ্রধানমন্ত্রীর ঢাকা সফরকালে দুই দেশের মধ্যে ছয়টি চুক্তি সই হয়। তবে বছরের শেষ দিকে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যা অস্বীকার ও যুদ্ধাপরাধ বিচার ঘিরে বাংলাদেশ-পাকিস্তানের মধ্যে টানাপোড়েন শুরু হয়। এছাড়া দুই বিদেশী নাগরিক হত্যার ঘটনায় সরকার প্রথম দিকে বিদেশী চাপে থাকলেও পরে তা কাটিয়ে উঠতে সমর্থ হয়। চলতি বছরের ৫ মে ভারতের রাজ্যসভায় সীমান্ত বিল অনুমোদন করা হয়। এর দু’দিন পর ৭ মে ভারতের লোকসভায়ও বিলটি পাস হয়। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ছিটমহল বিনিময়ে ১৯৭৪ সালে স্বাক্ষরিত স্থলসীমান্ত চুক্তি ও ২০১১ সালে স্বাক্ষরিত এ বিষয়ক প্রটোকল বাস্তবায়নের পথ খুলে যায়। এই বিল পাসের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের ছিটমহলবাসীর ৬৮ বছরের দুঃখ ও যন্ত্রণার অবসান হয়। ভারতের রাজ্য ও লোকসভায় সীমান্ত বিল পাসের পর চলতি বছরের ৬ জুন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঢাকা সফর করেন। সে সময় দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীদের মধ্যে সীমান্ত বিলের চুক্তি বিনিময় হয়। এছাড়া মোদির সফরের সময় আরও ১৯ সমঝোতা স্মারক ও চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের প্রেক্ষিতে দুই দেশের মধ্যে আনুষ্ঠানিক ছিটমহল বিনিময় ছিল এই বছরের অন্যতম আলোচিত ঘটনা। সীমান্ত চুক্তির রূপরেখা অনুযায়ী ৩১ জুলাই মধ্যরাতে দুই দেশের ছিটমহল বিনিময় হয়। ফলে ভারতের অভ্যন্তরে বাংলাদেশের ৫১ ও বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতের ১১১ ছিটমহল বিনিময় করা হয়। ছিটমহল বিনিময়ের মধ্য দিয়ে দুই দেশের সীমান্তে ‘ছিটমহল’ শব্দটির আনুষ্ঠানিক বিলুপ্তি ঘটে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ছাড়াও এক বছরে দু’বার ঢাকা সফরে আসেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। চলতি বছরের ১৯ ফেব্রুয়ারি তিন দিনের সফরে ঢাকা আসেন তিনি। সে সময় পশ্চিমবঙ্গের পৌর ও নগর উন্নয়নমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমসহ তিন মন্ত্রী আসেন ঢাকায়। এরপর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরের সময় আবারও ঢাকায় আসেন মমতা। ঢাকা সফরের সময় দু’বারই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক হয় মমতার। এ সময় তিস্তা চুক্তির বিষয়ে মমতার কোন আপত্তি নেই বলেও জানান তিনি। চলতি বছরের ২৪ মে ঢাকা সফরে আসেন চীনের উপপ্রধানমন্ত্রী লিউ ইয়াংদঙ। সে সময় চীনের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে ছয়টি সমঝোতা স্মারক সই হয়। চীনা উপপ্রধানমন্ত্রীর ঢাকা সফরের সময় বাংলাদেশের কয়েকটি বড় প্রকল্পে সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দেয় চীন। গভীর সমুদ্রবন্দর, রেল, এক্সপ্রেসওয়ে, তথ্যপ্রযুক্তি, শিল্পাঞ্চল নির্মাণসহ এ ধরনের প্রকল্পগুলোতে সহায়তার আগ্রহ প্রকাশ করে দেশটি। চীন পায়রা সমুদ্রবন্দর, ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, চট্টগ্রামের দোহাজারী-রামু-ঘুনধুম পর্যন্ত দ্বৈতগেজ রেলপথ, ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলওয়ের জন্য কর্ডলাইন, পদ্মা সেতু থেকে যশোর পর্যন্ত রেলপথ, কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে টানেল, চট্টগ্রামে চীনা অর্থনৈতিক ও শিল্পাঞ্চল নির্মাণ, ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে প্রযুক্তি খাতের উন্নয়ন, ঢাকা পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানির (ডিপিডিসি) আওতাধীন এলাকায় বিদ্যুত ব্যবস্থা সম্প্রসারণ ও শক্তিশালীকরণ, ইস্টার্ন রিফাইনারি দ্বিতীয় ইউনিট স্থাপন ইত্যাদি প্রকল্পে সহায়তা নিয়ে আলোচনা হয়। চীনের কোন উপপ্রধানমন্ত্রীর এটাই ছিল প্রথম বাংলাদেশ সফর। এছাড়া এই বছর ছিল বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কের ৪০ বছরপূর্তি। এই ৪০ বছরপূর্তি উপলক্ষে দুই দেশ বছরব্যাপী বিভিন্ন অনুষ্ঠান পালন করে। বছরের শেষ দিকে এসে বিএনপি নেতা সাকা চৌধুরী ও জামায়াতের মুজাহিদের ফাঁসি কার্যকরের পর বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে কূটনৈতিক টানাপোড়েন শুরু হয়। এই দুই যুদ্ধাপরাধীর মৃত্যুদ-ে নাখোশ হয়ে গত ২২ নবেম্বর তীব্র প্রতিক্রিয়া জানায় পাকিস্তান। পাকিস্তানের ওই প্রতিক্রিয়ার প্রতিবাদে গত ২৩ নবেম্বর দেশটির ঢাকায় নিযুক্ত হাইকমিশনার সুজা আলমকে তলব করে সরকার। সে সময় পাকিস্তানের হাইকমিশনারকে জানিয়ে দেয়া হয়, পাকিস্তান সরকার এখন সরাসরি দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করছে। তবে অভ্যন্তরীণ বিষয়ে পাকিস্তান সরকার কোনভাবেই যেন আর হস্তক্ষেপ না করে, সে বিষয়ে তাদের সতর্ক থাকতে বলা হয়। এরপর গত ৩০ নবেম্বর পাকিস্তানে নিযুক্ত বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনার মৌসুমী রহমানকে তলব করে পাকিস্তান সরকার। তাকে তলবের পর ১৯৭১ সালের হত্যাকা-ে সম্পৃক্ততার অভিযোগ অস্বীকার করে পাকিস্তান। তলব ও পাল্টাতলব নিয়ে দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কে নতুন করে টানাপোড়েন চলে। এই ঘটনার পর বিভিন্ন মহল থেকে পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্নের দাবি উঠেছে। সেই দাবি এখনও অব্যাহত রয়েছে। গত ২৮ সেপ্টেম্বর ঢাকায় ইতালির নাগরিক সিজার তাভেলা ও ৩ অক্টোবর রংপুরে জাপানী নাগরিক কুনিও হোশি হত্যাকা-ের শিকার হন। এই দুই নাগরিক হত্যার ঘটনায় কূটনীতিকরা গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তারা নিরাপত্তার দাবি করেন। একই সঙ্গে দুই বিদেশী হত্যার ঘটনায় দ্রুত বিচার প্রত্যাশা করেন। এই হত্যাকা-ের পর বিভিন্ন দেশ বাংলাদেশে ভ্রমণের বিষয়ে সতর্কতা জারি করে। ফলে সরকার বিব্রতবোধ করে। পরবর্তীতে বিদেশী কূটনীতিকদের নিয়ে দফায় দফায় বৈঠকের পর সরকারের পক্ষ থেকে তাদের আশ্বস্ত করা হয়। এছাড়া দুই বিদেশী হত্যার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সাইট ইন্টেলিজেন্স গ্রুপ দাবি করে, এসব হত্যায় ইসলামিক স্টেট (আইএস) জড়িত। তবে সরকারের পক্ষ থেকে সেই অভিযোগ পুরোপুরি অস্বীকার করা হয়। বছরের শেষ দিকে ঢাকা সফরে আসেন মার্কিন রাজনীতি বিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি টমাস শ্যানন। তিনি ঢাকায় এসে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ পৌরসভা নির্বাচন অনুষ্ঠানের তাগিদ দেন। এছাড়া আইএসবিরোধী লড়াইয়ে বাংলাদেশের সহযোগিতা চান তিনি। চলতি বছর আইএসবিরোধী লড়াইয়ে যোগ দেয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। বাংলাদেশ মার্কিনবিরোধী ওই জোটে অংশ নেয়নি। তবে ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহী দমনের লক্ষ্যে সৌদি আরবের নেতৃত্বে জোটকে সমর্থন দেয় বাংলাদেশ। এছাড়া সম্প্রতি সৌদি আরবের নেতৃত্বে মুসলিম দেশগুলোর সমন্বয়ে গঠিত সন্ত্রাসবিরোধী জোটে যোগ দেয় বাংলাদেশ। এই জোটকে সামরিক জোট বলা হলেও বাংলাদেশ বলেছে, এটি হবে একটি সন্ত্রাসবিরোধী জোট। বিশ্বজুড়ে সন্ত্রাসবিরোধী লড়াই জোরদার করতেই এই জোটে যোগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ। এদিকে চলতি বছর লেখক-প্রকাশক ও ব্লগার হত্যা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন বিদেশী কূটনীতিকরা। তারা লেখক-প্রকাশক হত্যাকারীদের দ্রুত গ্রেফতার দাবি করেন। একই সঙ্গে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
×