ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে তার বিতর্কিত মন্তব্যে বিভিন্ন সংগঠনের তীব্র নিন্দা ও ক্ষোভ

নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়ে বক্তব্য প্রত্যাহার করতে খালেদাকে উকিল নোটিস

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ২৪ ডিসেম্বর ২০১৫

নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়ে বক্তব্য প্রত্যাহার করতে খালেদাকে উকিল নোটিস

স্টাফ রিপোর্টার ॥ মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার বিতর্কিত বক্তব্যে ‘দেশদ্রোহী’ মনোভাব পাওয়া যাচ্ছে অভিযোগ করে তা প্রত্যাহার করতে উকিল নোটিস পাঠিয়েছেন এক আইনজীবী। সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামসহ মুক্তিযুদ্ধের সংগঠন থেকে শুরু করে বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের পক্ষেও এ বক্তব্যের তীব্র নিন্দা ও ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়েছে। পাশাপাশি ২০ দলের জোট নেত্রীকে জাতির কাছে ক্ষমা চাওয়ারও দাবি উঠেছে বিভিন্ন মহল থেকে। খালেদাকে উকিল নোটিস ॥ নোটিসে বলা হয়েছে, আগামী সাত দিনের মধ্যে জাতির কাছে নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করে খালেদা জিয়া তার বক্তব্য প্রত্যাহার না করলে তাঁর বিরুদ্ধে দেওয়ানি ও ফৌজদারি আইনে মামলা দায়ের করা হবে। বুধবার সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সম্পাদক এ্যাডভোকেট মোমতাজ উদ্দিন আহমেদ মেহেদী ডাকযোগে বিএনপির নয়াপল্টন ও গুলশান কার্যালয়ে এ নোটিস পাঠান। নোটিসে বলা হয়েছে, গত ২২ ডিসেম্বর কয়েকটি জাতীয় দৈনিকে ‘মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক আছে’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে বিজয় দিবস উপলক্ষে জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা দল আয়োজিত সভায় খালেদা জিয়া বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগ মুক্তিযোদ্ধাদের দল নয়। তারা শুধু মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে, তাদের দলে কোন মুক্তিযোদ্ধা নেই, যারা আছেন সবাই ভুয়া। তাদের দেশের প্রতি কোন মায়া নেই। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম উল্লেখ না করে খালেদা জিয়া আরও বলেন, ‘তিনি স্বাধীনতা চাননি, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে চেয়েছিলেন। স্বাধীন বাংলাদেশ চাননি। নোটিসে বলা হয়েছে, খালেদা জিয়ার এ ধরনের বক্তব্য ঔদ্ধত্যপূর্ণ। তার স্মরণ রাখা উচিত যে বঙ্গবন্ধুর মতো মহান নেতার জন্ম না হলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হতো না। যার নেতৃত্বে সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে আপত্তিকর বক্তব্য দিয়ে খালেদা জিয়া ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনাকে ভূলণ্ঠিত ও সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন, যা রাষ্ট্রদ্রোহের শামিল। নোটিসে আরও বলা হয়েছে, খালেদা জিয়া একজন স্বাধীনতাবিরোধী ও মনে প্রাণে পাকিস্তানি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শে বিশ্বাস করেন না বলেই আপনার পক্ষে এ ধরনের সংবিধানবিরোধী বক্তব্য দেয়া সম্ভব হয়েছে। আপনার এ ধরনের বক্তব্যের সঙ্গে পাকিস্তান সরকারের বক্তব্যের মিল খুঁজে পাওয়া যায়। আপনি প্রকৃতপক্ষে একজন স্বাধীনতাবিরোধী ও স্বাধীনতাবিরোধীদের মদদদাতা ও পৃষ্ঠপোষক। একটি রাজনৈতিক দলের প্রধান হিসেবে স্বাধীন বাংলাদেশে রাজনীতি করতে চাইলে আপনার এ বক্তব্য প্রত্যাহার করা উচিত। তাই নোটিসপ্রাপ্তির সাত দিনের মধ্যে বক্তব্য প্রত্যাহার করে জাতির কাছে নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে। উল্লেখ্য, গত সোমবার রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা দল আয়োজিত মুক্তিযোদ্ধা সমাবেশে মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শদীদের সংখ্যা নিয়ে খালেদা জিয়া বলেন, আজকে বলা হয় মুক্তিযুদ্ধে এত লাখ লোক শহীদ হয়েছে। আসলে কত লোক শহীদ হয়েছে এটা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে, নানা বই-কিতাবে নানা কথা লেখা হয়েছে। আর জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা না দিলে দেশে মুক্তিযুদ্ধ হতো না, আপনারা কেউ মুক্তিযোদ্ধা হতে পারতেন না। ক্ষমা চাওয়ার আহ্বান সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের ॥ বুধবার সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম-মুক্তিযুদ্ধ ’৭১ এর চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব) কে এম শফিউল্লা, ভাইস চেয়ারম্যান লে. (অব) কর্নেল আবু ওসমান চৌধুরী এবং মহাসচিব হারুন হাবীব এক বিবৃতিতে খালেদা জিয়াকে জাতির কাছে ক্ষমা চাওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়, ‘মহান মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক তুলে এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে ইতিহাস বিবর্জিত অসত্য বক্তব্য উপস্থাপন করে খালেদা জিয়া বাংলাদেশের জাতীয় ইতিহাসের উদ্দেশ্যমূলক অবমাননা করেছেন বলে আমরা মনে করি। তাঁর বক্তব্য একাধারে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসের নির্জলা মিথ্যাচার এবং রাষ্ট্রের পবিত্র সংবিধানের লঙ্ঘন। বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ‘আমরা বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করছি যে; এ ধরনের উদ্দেশ্যমূলক বক্তব্য ঠিক তখনই দেয়া হয়েছে যখন পাকিস্তান সরকার বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও একাত্তরের গণহত্যার দায় সরাসরি অস্বীকার করছে। মহান মুক্তিযুদ্ধের শহীদের অবমাননা এবং জাতির পিতা সম্পর্কে বিকৃত ইতিহাস নির্ভর বক্তব্য প্রদান করার জন্য আমরা বেগম খালেদা জিয়াকে জাতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনার আহ্বান জানাই’। একই সঙ্গে সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের সকল বিভাগ, জেলা ও প্রতিষ্ঠান শাখাকে এই উদ্দেশ্যমূলক ইতিহাস বিকৃতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ কর্মসূচী গ্রহণের আহ্বান জানানো হয়েছে সংগঠনের পক্ষ থেকে। পাকিস্তানের অপকর্ম আড়াল করছেন খালেদা- ওয়ার্কার্স পার্টি ॥ মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার বক্তব্যে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি। দলটির মতে, ‘শহীদের সংখ্যা নিয়ে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার বক্তব্য পাকিস্তানীদের অপকর্মকে আড়াল করার উদ্দেশ্যেই।’ মঙ্গলবার ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন এবং সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা এক যুক্ত বিবৃতিতে এসব কথা বলেন। বিবৃতিতে এই দুই নেতা বলেন, একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী এবং তাদের এ দেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদর, আলশামস, শান্তি কমিটির হায়েনারা ত্রিশ লাখ বাঙালীকে হত্যা করেছে। এ কথা আজ শুধু অনুমানই নয়, মীমাংসিত সত্য। এ জঘন্য গণহত্যাসহ ধর্ষণ, লুটপাট ও অন্যান্য মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধের বিচার এ মুহূর্তে বাংলাদেশ এগিয়ে নিয়ে চলেছে। এ বিচারের বিরোধিতা করে পাকিস্তান সরকার নিজেদের সে সময়ের অপকর্মকে অস্বীকার করার মতো ধৃষ্টতাও দেখিয়েছে। ক্ষমা চাওয়ার আহ্বান- বোয়াফ ॥ নতুন প্রজন্মের সামনে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগে খালেদা জিয়াকে ক্ষমা চাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন বাংলাদেশ অনলাইন এ্যাক্টিভিস্ট ফোরাম (বোয়াফ)। সংগঠনের সভাপতি কবীর চৌধুরী তন্ময় বলেন, ৭১’র মুক্তিযুদ্ধের সময় তথ্য সংগ্রহকারী সোভিয়েত বার্তা সংস্থা ‘তাস’, ‘ইউএনআই’ ও ন্যাশনাল জিয়োগ্রাফিকসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও সংস্থা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নিহতের সংখ্যা ৩০ লাখ বলে উল্লেখ করার পরও আজ স্বাধীনতার ৪৪ বছর পর বিএনপির নেত্রী খালেদা জিয়া ‘সংশয়’ প্রকাশ করে নতুন প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করা, সত্যিই দুঃখজনক এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতিকরণ। তিনি আরও বলেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও সাবেক বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার কাছ থেকে এ প্রজন্ম দায়িত্বশীল বক্তব্য আশা করেন, যেখানে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত উন্নয়নশীল বাংলাদেশ বিনির্মাণে এগিয়ে যেতে সহায়তা করবে।
×