ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

জঙ্গীবাদ বিস্তার ও জাল মুদ্রার ব্যবসায় মদদ দিত ;###;জেএমবি ও তালেবান তৈরিতে অর্থ যোগান দিত ফারিনা আরশাদ

জঙ্গী গোয়েন্দা প্রত্যাহার ॥ গোপনেই কাজটি করল পাকিস্তান

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ২৪ ডিসেম্বর ২০১৫

জঙ্গী গোয়েন্দা প্রত্যাহার ॥ গোপনেই কাজটি করল পাকিস্তান

স্টাফ রিপোর্টার ॥ বাংলাদেশে জঙ্গীবাদের বিস্তার ঘটানোর সঙ্গে জড়িত ঢাকায় পাকিস্তান হাইকমিশনের সেই বহুল আলোচিত মহিলা গোয়েন্দা কর্মকর্তা ফারিনা আরশাদকে প্রত্যাহার করে নিয়েছে পাকিস্তান সরকার। শুধু প্রত্যাহার নয়, তাকে পাকিস্তানেও ফেরত নিয়েছে। পাকিস্তানের এই কূটনীতিকের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে জঙ্গীবাদ বিস্তার এবং জালমুদ্রা ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ করে বাংলাদেশ ও ভারতের অর্থনৈতিক মেরুদ- ভেঙ্গে দেয়া এবং বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দীর্ঘদিনের সুসর্ম্পক নষ্ট করার পরিকল্পনার তথ্যও ফাঁস হয়ে গেছে। এমন অভিযোগের পরেই এই গোয়েন্দা কর্মকর্তাকে প্রত্যাহার করে নিল পাকিস্তান। ইতোপূর্বে চলতি বছরের জানুয়ারিতে এমনই অপরাধে জড়িত থাকার দায়ে মাযহার খান নামে ঢাকায় পাকিস্তান হাইকমিশনের আরেক গোয়েন্দা কর্মকর্তাকে পাকিস্তান সরকার ফেরত নিয়েছে। যদিও বাংলাদেশে পাকিস্তান হাইকমিশন বা বাংলাদেশ সরকারের তরফ থেকে ফারিনা আরশাদের প্রত্যাহারের বিষয়ে কোনকিছুই জানানো হয়নি। বুধবার দুপুরে অত্যন্ত গোপনে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে পাকিস্তান বিমানের একটি ফ্লাইটে তাকে পাকিস্তানে ফেরত নেয় সে দেশটির সরকার। যদিও পাকিস্তানের তরফ থেকে ফারিনার সঙ্গে জঙ্গী সম্পৃক্ততার ঘটনা পুরোপুরি অস্বীকার করা হয়েছিল। পাকিস্তান থেকে ওই ঘটনা অস্বীকারের এক সপ্তাহের মধ্যেই নারী কূটনীতিককে প্রত্যাহার করে দেশটি। ফারিনা আরশাদের সঙ্গে জঙ্গী সম্পৃক্ততার বিষয়টি প্রকাশ হয়ে পড়লে গত ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার পাকিস্তান হাইকমিশন থেকে এক বিজ্ঞপ্তিতে এ ঘটনা পুরোপুরি অস্বীকার করে। পাকিস্তান হাইকমিশনের দেয়া ওই বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছিল, সকল কূটনৈতিকশিষ্টাচার ও সৌজন্য হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়ে বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করতে অশুভ চক্রান্তের কাল্পনিক এই খবর প্রকাশ করা হয়েছে। হতাশার বিষয় হচ্ছে, সেই কর্মকর্তার ছবিও গণমাধ্যমে বেপরোয়াভাবে প্রকাশ করা হয়েছে। তার চরিত্রে অমার্জিত কটাক্ষ করা হয়েছে। এটা কেবল চরিত্র হত্যার ঘৃণ্য চেষ্টাই নয় বরং ওই কর্মকর্তার নিরাপত্তাও বিপন্ন করে তুলেছে। ভ্রাতৃপ্রতিম মুসলিম দেশে ঘটা সর্বশেষ ঘটনা এটি। পাকিস্তান হাইকমিশন প্রত্যাশা করে, একটি শক্তিশালী ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশই পাকিস্তানের শক্তি বাড়াতে পারে, অন্য যে কোন কিছু তা ব্যাহত করবে। ফারিনা আরশাদের চাঞ্চল্যকর এমন তথ্য প্রকাশের সূত্রপাত হয় চলতি বছরের ২৯ নবেম্বর বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত পাকিস্তানী নাগরিক ইদ্রিস শেখ ও মোঃ মকবুল শরীফ এবং আটকেপড়া পাকিস্তানী মোঃ সালাম ও পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের এ্যাসিসটেন্ট ট্রাফিক ইন্সপেক্টর মোস্তফা জামান ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের হাতে গ্রেফতারের পর। গ্রেফতারকৃতরা ভারতীয় ও পাকস্তানী জালমুদ্রা পাচারে জড়িত। তাদের কাছ থেকে ৩টি পাকিস্তানী পাসপোর্ট ও বিপুল পরিমাণ জালরুপী উদ্ধার হয়। পরবর্তীতে ইদ্রিস ও মকবুল ঢাকা মহানগর হাকিম আবদুল্লাহ আল মাসুদের আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেন। ইদ্রিসের জবানবন্দীর বরাত দিয়ে তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, পাকিস্তানী নাগরিক ইদ্রিসের কাছ থেকে উদ্ধার হয় দেশ-বিদেশে গোয়েন্দা তথ্য আদানপ্রদানের কাজে ব্যবহৃত একটি শক্তিশালী বিশেষ স্পাই মোবাইল। এ ধরনের মোবাইল সাধারণত কোন দেশের রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ব্যবহার করে থাকে। জব্দকৃত মোবাইল ফোনটি উন্নতি প্রযুক্তির মাধ্যমে পর্যালোচনা করা হয়। পর্যালোচনায় ইদ্রিসের মোবাইলটির সঙ্গে ঢাকায় পাকিস্তান দূতাবাসের সেকেন্ড সেক্রেটারি (রাজনৈতিক) গোয়েন্দা কর্মকর্তা ফারিনা আরশাদ ও পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন অসীমের মোবাইল ফোনের সঙ্গে স্বয়ংক্রিয়ভাবে যুক্ত থাকার বিষয়টি ধরা পড়ে। অসীম পাকিস্তানের একটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে রয়েছেন। সূত্র বলছে, ইদ্রিসের জবানীতে বেরিয়ে আসে বাংলাদেশে জঙ্গী তৎপরতায় ঢাকায় পাকিস্তান দূতাবাসের মহিলা গোয়েন্দা কর্মকর্তা ফারিনা আরশাদ ও পাকিস্তানের গোয়েন্দা কর্মকর্তা অসীমের জড়িত থাকার বিষয়টি। ইদ্রিস ১৯৮৫ সালে পাকিস্তানে যান। ১৯৯০ সালে পাকিস্তানী এক নারীকে বিয়ে করে সেখানেই বসবাস করছিলেন। ২০০২ সালে দেশটির ‘পাক-মুসলিম এ্যালায়েন্স’ নামে একটি রাজনৈতিক দলের হয়ে জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিয়ে পরাজিত হন। রাজনীতি করার কারণে পাকিস্তানের বিভিন্ন জঙ্গী গোষ্ঠী ও রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সঙ্গে তার যোগাযোগ গড়ে ওঠে। পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার কতিপয় পদস্থ কর্মকর্তার সঙ্গে বিশেষ সখ্য হয়। ওইসব গোয়েন্দা কর্মকর্তার নির্দেশে ইদ্রিস ২০০৭ সালে বাংলাদেশে এসে জেএমবির সঙ্গে যোগ দেন। পাকিস্তানের বিমানবন্দর দিয়ে বাংলাদেশে আসতে গোয়েন্দা কর্মকর্তা অসীম সহযোগিতা করেন। এই গোয়েন্দা কর্মকর্তার মাধ্যমেই ঢাকায় পাকিস্তান দূতাবাসের গোয়েন্দা কর্মকর্তা ফারিনা আরশাদের সঙ্গে পরিচয় হয় ইদ্রিসের। ফারিনা ও অসীমের সহযোগিতায় গত ২ বছরে ৪৮ বার বাংলাদেশ- পাকিস্তান যাতায়াত করেছেন ইদ্রিস। ইদ্রিসের প্রধান কাজ ছিল বাংলাদেশে জেএমবির কার্যক্রম বৃদ্ধি করা। জেএমবি সদস্যদের ছোট ছোট দলে পাকিস্তানে পাঠিয়ে উচ্চতর প্রশিক্ষণ দিয়ে আবার বাংলাদেশে ফেরত আনা। মূলত বাংলাদেশে জঙ্গীবাদের বিস্তার ঘটানোর লক্ষ্যেই এ কাজটি করছিল ইদ্রিসসহ অন্যরা। সেই সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক মেরুদ- ভেঙ্গে দিতে এবং ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সুদীর্ঘ দিনের সুসম্পর্ক নষ্ট করতেই পাকিস্তানে তৈরি জালমুদ্রা বাংলাদেশে আনত। এসব জালমুদ্রা বাংলাদেশ ভারত সীমান্ত পথে ভারতে পাঠানো হতো। এর সঙ্গে পাকিস্তানের গোয়েন্দা কর্মকর্তা অসীম ও ফারিনা জড়িত। এমন তৎপরতার কারণে ভারতের সীমান্ত রক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) ছাড়াও অন্য গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এতদিন মনে করে আসছিল, বাংলাদেশের জালমুদ্রার কারবারিরাই ভারতে জালমুদ্রা পাচারে জড়িত। সম্প্রতি বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে জালমুদ্রার বিষয়ে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর ও ভারতীয় প্রতিনিধি দলের ঢাকা সফরের পর এ বিষয়ে ভারতের ভুল ভেঙেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে আরও জানা গেছে, পাকিস্তানের গোয়েন্দা কর্মকর্তা অসীমের সূত্র ধরে ইদ্রিসের পরিচয় হয় ঢাকায় পাকিস্তান দূতাবাসের গোয়েন্দা কর্মকর্তা ফারিনা আরশাদের সঙ্গে। বিভিন্ন সময় ফারিনা আরশাদ তার নিজস্ব গাড়ি নিয়ে বায়তুল মোকাররম এলাকায় যেতেন। যাওয়ার আগে ইদ্রিসকে খবর দিতেন। ইদ্রিস যথারীতি ফারিনা আরশাদের গাড়িতে চড়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আদান-প্রদান করতেন। জঙ্গী তৎপরতার সার্বিক বিষয়াদি সম্পর্কে ফারিনাকে বিস্তারিত জানাতেন। ফারিনা ইদ্রিস আলীকে নিয়মিত অর্থ দিতেন। মূলত পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের হয়ে ফারিনা আরশাদের মাধ্যমে বাংলাদেশে কাজ করছিলেন। ২০১২ সাল থেকেই গ্রেফতারকৃত বাবুল নামে এক এজেন্টের মাধ্যমে ফারিনার সঙ্গে ইদ্রিস আলীর যোগাযোগ গড়ে ওঠে। দীর্ঘদিন যোগাযোগ থাকলেও চলতি বছরের শুরু থেকে ফারিনার সঙ্গে ইদ্রিসের ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চলতি বছরের ৫ জানুয়ারি থেকে বিএনপির ডাকা টানা প্রায় তিন মাসের দেশব্যাপী চলমান সহিংসতার পেছনেও ফারিনা আরশাদের ভূমিকা রয়েছে। ফারিনা ইদ্রিসের মাধ্যমে এ খাতেও অর্থায়ন করেছে। সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার নীলনক্সা হিসেবে ইদ্রিস ছাড়াও ফারিনা নিজস্বভাবে অন্তত ২৬ জনকে এজেন্ট হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন। এদের মধ্যে ৪ জন সরাসরি আইএসআইয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এজেন্টদের অধিকাংশই পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে এসে গার্মেন্টস ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। ইতোপূর্বে ঢাকায় পাকিস্তান দূতাবাসের ভিসা কর্মকর্তা মাযহার খানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ও ভারতে জালমুদ্রা ছড়িয়ে দিয়ে দেশ দুইটি অর্থনৈতিক মেরুদ- ভেঙে দেয়া এবং জঙ্গীবাদ বিস্তারের অভিযোগ ওঠে। মাযহার খানকে প্রত্যাহার করে পাকিস্তানে ফেরত নেয়ার পর থেকে ফারিনা আরশাদ এ কাজটি করে আসছিলেন। ইদ্রিসের পাকিস্তানের করাচীতে ইকরাহ্ নামের একটি মাদ্রাসা রয়েছে। ওই মাদ্রাসার ছাত্রদের নিয়মিত তালেবান জঙ্গী সংগঠনে পাঠানো হয়। পাকিস্তানেই মাদ্রাসাটির একাধিক শাখা আছে। সূত্র বলছে, গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে আব্দুস সালাম মূলত পাকিস্তানী এজেন্ট। ২০১৩ সালের জুলাইতে তিনি পলাতক আরেক আইএসআই এজেন্টের সঙ্গে পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের এক মন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাত করে মোটা অঙ্কের টাকা আনেন। সেই টাকায় বাংলাদেশে জেএমবির কার্যক্রম বাড়ানো, রোহিঙ্গাদের জেএমবিতে ভেড়ানো এবং তাদের ট্রেনিং দিতে পাকিস্তানে পাঠানোর কাজটি চলছিল। ইতোমধ্যেই বহু রোহিঙ্গাকে পাকিস্তান থেকে জঙ্গী প্রশিক্ষণ দিয়ে বাংলাদেশে ফেরত পাঠিয়েছে তারা। পাকিস্তানে অবস্থিত রোহিঙ্গা আবদুল কুদ্দুস গ্রেফতারকৃত মকবুলের সহযোগিতায় বহু রোহিঙ্গাকে পাকিস্তান থেকে জঙ্গী ট্রেনিং দিয়ে কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ায় পাঠিয়েছে। বিষয়টি ফারিনার জানা। ফারিনা ইংরেজী, উর্দু ও বাংলায় অনর্গল কথা বলতে পারায় সহজেই তিনি যে পাকিস্তানী নাগরিক তা ধারণা করা মুশকিল ছিল। এসব কারণ ছাড়াও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের ফাঁসি কার্যকরের পর ঢাকায় পাকিস্তান দূতাবাস ও পাকিস্তানের দায়িত্বশীলদের কথাবার্তা ব্যাপক সমালোচনার ঝড় তোলে। যার প্রেক্ষিতে সম্প্রতি হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ফেরত পাঠানো হয়েছে স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের সিনিয়র জয়েন্ট ডিরেক্টর আসমা খালিদকে। এ ব্যাপারে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম জনকণ্ঠকে জানিয়েছেন, ইদ্রিসের জবানবন্দীতে পাওয়া তথ্য যাচাই-বাছাই করে দেখা হচ্ছে।
×