ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

রকমারি ডাকটিকেট

প্রকাশিত: ০৪:০০, ২৪ ডিসেম্বর ২০১৫

রকমারি ডাকটিকেট

ডা. আল সাফী মজুমদার যে দায়িত্ব নিয়ে পোস্ট অফিসের কাজ শুরু হয়েছিল তা ক্রমান্বয়ে কমে আসছে। ই-মেইল, এসএমএস-এর সহজলভ্যতা, দ্রুততা ডাক বিভাগকে পিছে ফেলে দিয়েছে। তবে খেয়াল করলে দেখা যায়, শুধু ওটাই হেতু নয়। সারা বিশ্বে কুরিয়ার সার্ভিস (ডিএইচএল, ফেডএক্স) এর জনপ্রিয়তা বা গ্রহণযোগ্যতা রাষ্ট্রীয় ডাক বিভাগের কার্যক্রম সংঙ্কুচিত করে ফেলেছে। সরকারী পোস্ট অফিসের উপর মানুষের আস্থা হারিয়ে যাওয়ায় বেসরকারী ডাকব্যবস্থা বা কুরিয়ার সার্ভিসের উপর মানুষের, এমনকি সরকারী অফিসসমূহের নির্ভরশীলতাও দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমার মনে হয়, এই আস্থার সংকটে পড়েই পোস্ট অফিসগুলো ঔজ্জ¦ল্য হারিয়ে ফেলছে। এই বাস্তবতার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ডাক ব্যবস্থার অনুষঙ্গ ‘ডাকটিকেট’-এর উপর দৃষ্টি ফেললে আরেকটি মাত্রা উন্মোচিত হবে। ডাকটিকেটের প্রচলন হয়েছিল ডাকমাসুল আদায়ের মাধ্যম হিসেবে। কালক্রমে ডাক মাসুলের সঙ্গে সঙ্গে ডাকটিকেট একটি শিল্পকলায় পরিণত হয়েছে। ডাকটিকেট শুধু ডাকমাসুল নয়, ইতিহাস। প্রচার-প্রচারণা, গণসচেতনতা, চলমান ঘটনার দলিলÑ নানানভাবে এর ব্যবহার। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ১৯৭১ সালের ২৯ জুলাই ৮টি ডাকটিকেটের ১টি সেট বাংলাদেশের ডাকটিকেট হিসেবে ইস্যু করা হয়। বাংলাদেশ তখন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত কোন দেশ নয়, কিন্তু এই ডাকটিকেটগুলোর প্রকাশ আমাদের দেশের সার্বভৌমত্ব পরিচয় বহনকারী। (পাকিস্তান সরকার এ ডাকটিকেটগুলোর বৈধতা নিয়ে আন্তর্জাতিক পোস্টাল ইউনিয়নের কাছে অভিযোগও করেছিল)। চল্লিশ দশকের শুরুতে আজাদ হিন্দ সরকার উনিশটি ডাকটিকেটের ১ সেট প্রকাশ করেছিল। ’৪৬ সালে দিল্লীতে আজাদ হিন্দ ফৌজের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতা মামলায় অভিযুক্তদের পক্ষে ঐ ডাকটিকেটগুলো প্রদর্শন করে বলা হয়েছিল, অভিযুক্তরা একটি প্রতিষ্ঠিত বৈধ সরকারের অনুগত হিসেবে যুদ্ধ করেছিল। অতএব রাষ্ট্রদ্রোহিতা মামলা চলবে না। বায়াফ্রা নাইজেরিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন ষাট দশকের একটি সাময়িক রাষ্ট্র (চিনুয়া আচেবের ‘দেয়ার ওয়াজ এ কান্ট্রি’ বইটি আচেবের জন্মভূমি বায়াফ্রাকে নিয়ে লেখা)। স্বল্পস্থায়ী ঐ রাষ্ট্র স্বনামে ডাকটিকেট প্রকাশ করেছিল এবং এ ডাকটিকেটগুলোর সংগ্রহ ইতিহাসের স্বল্পস্থায়ী ও রাষ্ট্র আমাদের মধ্যে চিরস্থায়ী করে রেখেছে। স্বাস্থ্যবিষয়ক প্রচার প্রচারণায় ডাকটিকেটের ভূমিকা খুবই উজ্জ্বল। ষাটের দশকে সারা বিশ্বে বিভিন্ন দেশ থেকে ম্যালেরিয়া নির্মূল অভিযানের প্রত্যয় ব্যক্ত করে ডাকটিকেট ইস্যু করা হয়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে শুরু করে সৌদি আরব, ভারত, পাকিস্তান, পাপুয়া নিউগিনি-১০০টির বেশি দেশ ডাকটিকেট প্রকাশ করে। হালে এইডস, সার্স, মার্স এরকম ব্যাধির বিরুদ্ধে সচেতন হওয়ার প্রচারণা নিয়ে ডাকটিকেট ইস্যু করা হয়েছে। ধূমপানের বিরুদ্ধে, মাদকদ্রব্যের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে নানা দেশ ডাকটিকেট ইস্যু করে যাচ্ছে। ১৯৭২ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আহ্বানে বিভিন্ন দেশ হৃদরোগের সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ডাকটিকেট প্রকাশ করেছিল। বিভিন্ন বিখ্যাত ব্যক্তির প্রতিকৃতি নিয়ে ডাকটিকেট সব দেশেই জনপ্রিয়। আমাদের দেশে বঙ্গবন্ধু, শেরে বাংলা, বেগম রোকেয়া, কবি নজরুল, রবীন্দ্রনাথ, শহীদ বুদ্ধিজীবী, বীরশ্রেষ্ঠদের নিয়ে ডাকটিকেট প্রকাশিত হয়েছে। আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন দেশ থেকে প্রিন্সেস ডায়ানা, মাদার তেরেসা, মহাত্মা গান্ধী, আইনস্টাইন প্রমুখের প্রতিকৃতি নিয়ে ডাকটিকেট প্রকাশিত হয়েছে ও হচ্ছে। বিশ্বের সেরা শিল্পীদের শিল্প নিয়ে ডাকটিকেট প্রকাশ করা হয়েছে। ভ্যানগগ, রুবেন্স, রেমব্রান্ড, পাবলো পিকাসো, সালভাদর দালি- এ রকম অনেক শিল্পকর্মের সঙ্গে পরিচিত হয়েছি বিভিন্ন দেশের ডাকটিকেট ছাপা হওয়া শিল্পকর্ম দেখে। আমাদের শিল্পী কামরুল হাসানের বিখ্যাত ‘তিন কন্যা’ শিল্পকর্ম নিয়ে যুগোশ্লাভিয়া ডাকটিকেট প্রকাশ করে শিল্পী কামরুলকে সারা বিশ্বে পরিচিত হওয়ার সুযোগ দিয়েছে। কাজেই পোস্ট অফিস তথা রাষ্ট্রীয় ডাক ব্যবস্থার নাজুকতার মধ্যেও ডাকটিকেটের বৈচিত্র্য ডাকটিকেট সংগ্রাহকদের উৎসাহিত করছে। বাংলাদেশসহ সারা পৃথিবীতে ডাকটিকেট সংগ্রহ, প্রদর্শনী, ক্রয়-বিক্রয় ইত্যাদি কার্যক্রম চলছে। ডাকটিকেট বাঁচিয়ে রাখার জন্যই আমাদের আকাক্সক্ষা পোস্ট অফিস তার মহিমা নিয়ে বেঁচে থাকুক। জয়তু পোস্ট অফিস! নিউ ইস্কাটন, ঢাকা থেকে
×