ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ওয়াইজ করণি

মিয়ানমারে গণতন্ত্রে অনিশ্চয়তা

প্রকাশিত: ০৬:৩৯, ২৩ ডিসেম্বর ২০১৫

মিয়ানমারে গণতন্ত্রে অনিশ্চয়তা

মিয়ানমারে নির্বাচন হয়েছে। আউং সান সুচির দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছে। নয়া সরকার গঠনের বিষয়ে জেনারেলদের সঙ্গে আলোচনায় বসেছেন সুচি। তথাপি মিয়ানমারের রাজনৈতিক ভবিষ্যত এখনও পর্যন্ত পরিষ্কার নয়। মিয়ানমারের সংবিধানে পার্লামেন্টের নিম্নপরিষদের চার পঞ্চমাংশ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ব্যবস্থা আছে। সেই নির্বাচনে বিস্ময়কর সংখ্যক আসনে বিজয়ী হয়েছে এনএলডি। তাতে পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করার যথেষ্ট সুযোগ আছে দলটির। তারপরও অনিশ্চয়তা কাটছে না। ১৯৯০ সালের নির্বাচনেও দলটি বিপুল সংখ্যক আসনে বিজয়ী হয়েছিল। বলা যেতে পারে ভূমিধস বিজয়। তথাপি দলটিকে শাসক সেনাবাহিনীর কাছ থেকে ক্ষমতা নিতে দেয়া হয়নি। বর্তমানে যে নামসর্বস্ব সিভিলিয়ান সরকার আছে তাতে এখনও সেনাবাহিনীর প্রাধান্য অটুট আছে। এ মাসে সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে সুচির বেশ কয়েকদফা বৈঠকে এমন আশ্বাস দেয়া হয়েছে যে এবার সেনাবাহিনী নির্বাচনী রায়ের প্রতি সম্মান জানাবে। তথাপি বেশ কিছু প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। যেমন সুচি ও তার দলকে কতটা ক্ষমতা দেয়া হবে। নির্বাচন পরবর্তী প্রায় একমাস দীর্ঘসূত্রতা করার পর ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট সাবেক জেনারেল থেইন সেইন ও সেনাপ্রধান সিং অং হালেইং ক্ষমতার উত্তরণ নিয়ে আলোচনার জন্য সুচির সঙ্গে স্বল্পস্থায়ী বেশ কয়েক দফা বৈঠকে বসেন। তারপর গত ৪ ডিসেম্বর সাবেক জান্তার ‘সিনিয়র জেনারেল’ ৮২ বছর বয়স্ক থান সোয়ের সঙ্গে সুচির দীর্ঘ এক বৈঠক হয়। ঘটনাটা নানা দিক দিয়ে বেশ উল্লেখযোগ্য। প্রথমত, ধারণা করা হয় যে থান সোয়ে ২০১১ সালে থেইন সেইনের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে অবসরে গেলেও নেপথ্যে এখনও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছেন। যদিও সাম্প্রতিককালে কখনও তাকে পর্দার অন্তরাল থেকে উঁকি দিতে দেখা যায়নি। দ্বিতীয়ত, থান সোয়ে সম্পর্কে নিশ্চিতভাবে তেমন কিছু জানা না গেলেও সুচির প্রতি তাঁর ব্যক্তিগত ও প্রায় কুসংস্কারমূলক বিরোধিতার কথা সর্বজনবিদিত। মিয়ানমারের ক্ষমতায় আসতে সুচিকে বাধা দেয়ার ব্যাপারে তিনি যে বদ্ধপরিকর ছিলেন এটাও সবার জানা। সুচি যে থান সোয়ের সঙ্গে বৈঠকে বসেছিলেন সেটাই এক দারুণ চমক লাগানো খবর। খবরটি তাঁর কিছু অনুগতকেও বিব্রত ও ব্যথিত করবে। কারণ থান সোয়ের অপশাসনে দীর্ঘদিন যন্ত্রণাভোগ করেছে বর্মীরা। থানসোয়ের উদ্দীষ্টভোগী ও কৃপা প্রার্থীরা একদিকে সম্পদের পাহাড় গড়েছে এবং অন্যদিকে মিয়ানমার এশিয়ার অন্যতম দরিদ্র দেশ হিসেবে থেকে গেছে। ক্ষমতায় থাকাকালে থানসোয়ে নির্মমভাবে ভিন্নমত দমন করেছিলেন, সুচিকে গৃহবন্দী রেখেছিলেন এবং তাঁর অনেক অনুসারীকে কারাগারে রেখে নির্যাতন করেছিলেন। জাতিগত বিদ্রোহ দমন করতে গিয়ে তার সৈন্যরা গ্রামকে গ্রাম আগুন লাগিয়ে ছাড়খার করেছিল, নারীদের ধর্ষণ করেছিল, শিশুদের বাধ্যতামূলক শ্রমে নিয়োগ করেছিল। কিন্তু সুচি কখনও এর বিরুদ্ধে বদলা নেয়ার কথা বলেননি। বর্মার স্বাধীনতা সংগ্রামের বীর নেতা অংসানের কন্যা বরং সেনাবাহিনীর সম্পর্কে শ্রদ্ধার সঙ্গে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন এই সেনাবাহিনী তার বাবার সৃষ্টি। সুচি যে প্রতিহিংসার কথা বলছেন না তার রাজনৈতিক তাৎপর্য আছে। ক্ষমতার শান্তিপূর্ণ উত্তরণ নির্ভর করছে জেনারেলদের মধ্যে এই আস্থা ও বিশ্বাস সৃষ্টির ওপর যে তাদেরকে জেলে যেতে হবে না। তাদের দেয়া সংবিধানে তারা নিজেদের স্বার্থরক্ষার কিছু ব্যবস্থা রেখেছেন যেগুলো ক্ষমতার সত্যিকারের উত্তরণ হতে হলে বাদ দিতে হবে। যেমন সুচির কথা মনে রেখে তারা সংবিধানে এমন বিধান রেখেছেন যে, মা ব্রিটিশ নাগরিক হয়ার কারণে সুচি প্রেসিডেন্ট হতে পারবেন না। তাছাড়া সেনাবাহিনীর জন্য পার্লামেন্টের এক-চতুর্থাংশ আসন সংরক্ষিত রাখার এবং সংবিধান পরিবর্তন করতে হলে তিন-চতুর্থাংশের বেশি সদস্যের সমর্থন লাভের বিধান রাখা হয়েছে। আরেকটি ব্যবস্থা হলো প্রতিরক্ষা, সীমান্ত ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রিসভার এই তিনটি দফতর সেনাবাহিনীর চাকরিরতদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে। এতসব ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করে রাখার পর সেনাবাহিনী যে সেগুলো সহজে ছাড়তে চাইবে না এটা বলাইবাহুল্য। বাস্তবেও সেনাবাহিনী সুচিকে ক্ষমতা ভাগাভাগির যে প্রস্তাব দিয়েছে তাতে এনএলডির হাতে খুব বেশি কিছু ছেড়ে দেয়া হচ্ছে না। তারপরও সুচির দল ক্ষমতার উত্তরণের ব্যাপারে আশাবাদী। তাদের মতে ক্ষমতা যাই থাক, আগে অন্তত শান্তিপূর্ণভাবে গণতন্ত্রে উত্তরণ ঘটুক এবং বেসামরিক শাসকরা তাদের পা রাখার জায়গা খুঁজে পাক। তারপর দেখা যাবে যে জেনারেলরা ধীরে ধীরে দৃশ্যপট থেকে সরে দাঁড়াবে। এটাই যদি গন্তব্য হয় মনে রাখতে হবে যাত্রাপথ থাকবে কন্টকাকীর্ণ। পর্যবেক্ষকরা মনে করেন এ অবস্থায় সুষ্ঠুভাবে ক্ষমতায় যাবার জন্য এনএলডিকে এমন এক মাঝামাঝি পথ বের করতে হবে যেখানে দ্রুত পরিবর্তনের জন্য উৎফুল্ল সমর্থকদের প্রত্যাশার রাশও টেনে ধরা যায় আবার অন্যদিকে ক্ষমতা, সম্পদ ও প্রভাব প্রতিপত্তি ক্ষুণœ হওয়া সম্পর্কে সেনাবাহিনীর আশঙ্কাও অতখানি থাকে না। তবে সেই পথটি শেষ পর্যন্ত বের হবে কিনা এবং হলেও কিভাবে হবে তা নিয়ে এখনও পর্যন্ত অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে। সূত্র : দি ইকোনমিস্ট
×