ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

কাজী সেলিম

গৌরনদী মুক্ত হয় ২২ ডিসেম্বর

প্রকাশিত: ০৫:১৫, ২৩ ডিসেম্বর ২০১৫

গৌরনদী মুক্ত হয়  ২২ ডিসেম্বর

(শেষাংশ) কর্নেল সিং ভুরঘাটা হতে গৌরনদী যাত্রা শুরু করার পূূর্বে কিছু ব্রিফিং করলেন সকলকে। ভারতীয় মিত্র বাহিনী তাদের দুটি জীর্ণ ও তিন চারটি ট্রাক ভুরঘাটা কালকিনি প্রান্তে বাজারে রেখে আমরাসহ পদব্রজে গৌরনদী যখন পৌঁছলাম তখন দুপুর বারোটার উপরে। গৌরনদী পৌঁছানোর পর সিদ্ধান্ত মোতাবেক কর্নেল সিং, পাক মেজর ঘটক ও কর্নেল মনসুরসহ ভারতীয় বাহিনীর ছ’জন অফিসার ও কয়েকজন সৈনিককে গৌরনদী কলেজের ভিতর প্রেরণ করলেন। আমরা কর্নেল সিংসহ কলেজ মাঠে অবস্থান করলাম ও অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলাম অবরুদ্ধ পাক বাহিনীর ঘাতক সদস্যরা সম্মুখের বিশাল উন্মুক্ত মাঠে কখন উপস্থিত হবে। প্রায় এক ঘণ্টা কলেজ ভবনের অভ্যন্তরে অবস্থানের পর মেজর ঘটকের নেতৃত্বে কলেজের ভিতর থেকে পাক হানাদার বাহিনীর সকল সদস্য দু’হাত মাথায় রেখে মাঠে অবস্থানরত আমাদের সামনে উপস্থিত হলো। প্রায় তিন/চার প্লাটুন হানাদার সদস্য ও কুড়িজন রেঞ্জার মিলিশিয়া প্রায় পনেরো-কুড়িজন রাজাকার, জামায়াতে ইসলামের ঘাতক আলবদর সদস্য। সারিবদ্ধভাবে লাইনে দাঁড়ানোর পর, স্থানীয় রাজাকার, আলবদর সদস্যদের পৃথক করে অস্ত্রশস্ত্রসহ স্থানীয় মুজিব বাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর নিকট তালিকাসহ সমর্পণ করা হলো এই স্থানীয় ঘাতকদের ভাগ্য নির্ধারণের জন্য। শুধুমাত্র হানাদার নিয়মিত বাহিনী ও রেঞ্জার মিলিশিয়া আত্মসমর্পণের সকল আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে এবার পদব্রজে আমাদের সকলকেই আবার কালকিনির ভুরঘাটা প্রান্তে যাওয়ার পালা। ইতোমধ্যে আমরা ভুরঘাটার হানাদার ঘাতক ফতেহ আলী খান ও ফজল খানকে চিহ্নিত করে আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করে নিলাম। গৌরনদী কলেজ মাঠ হতে দলবদ্ধ হয়ে ঘাতক পাক বাহিনীকে চারদিকে কঠোর সশস্ত্র প্রহরায় হেঁটে যাত্রা শুরু করলাম মাদারীপুরের ভুরঘাটার দিকে। পথিমধ্যে কশবা, টরকী, কটকস্থল, বার্থী অতিক্রম করার সময় দু’পাশের গ্রামের হাজার হাজার স্বাধীন দেশের বিক্ষুব্ধ নর-নারী-শিশু, ঘরবাড়ি ছেড়ে এগিয়ে আসছে আমাদের দিকে। গৌরনদী কলেজের পাক হানাদার বাহিনীর এই আত্মসমর্পণের সংবাদ যেন মুহূর্তের মধ্যেই ইথার তরঙ্গের মতো ছড়িয়ে গেল গোটা গৌরনদীর ও কালকিনির গ্রাম-গঞ্জে। বিজয়ী জনতার আনন্দ, চিৎকার ও গগনবিদারী জয়বাংলা সেøাগান যেন আর বন্ধ হয় না। আমাদের চারদিকে দৌড়ে এসে হানাদারদের উদ্দেশে চিৎকার করে অভিযোগ করতে শুরু করল মহাসড়কের গ্রামগুলো হতে বিক্ষুব্ধ জনতা। তাদের পিতা-মাতা ভাইবোন নিকট আত্মীয়-স্বজনদের পাশবিক ও নির্মম অত্যাচার ও হত্যাকা-ের কথা। মা-বোনদের ধরে নিয়ে পাক মুসলিম সৈন্যরা ইজ্জত হরণ করে পাশবিক নির্যাতন করে হত্যা করার হৃদয়বিদারক নৃশংসতার কথা। জনগণের অভিযোগের ভিত্তিতে মনে হচ্ছিল যেন হাতের অস্ত্রের সম্পূর্ণ ম্যাগাজিনটি ওদের একেকজনের মাথা-নিশানা করে শেষ করে দেই। কর্নেল সিং, পাকি কর্নেল মনসুর ও মেজর ঘটক আমাদের সকলের সম্মুখে জোর কদমে ভুরঘাটার দিকে অগ্রসরমান। এবার আমরা মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের হাতের অস্ত্র দিয়ে ঘাতক বাহিনীর প্রতিটি শরীরের বিভিন্ন দিকে সজোরে আঘাত শুরু করলাম। একবার লাইনের পিছন দিক থেকে আঘাত খেয়ে মাঝে গিয়ে আত্মরক্ষা ও লুকানো শুরু করল, মাঝখান থেকে ঘাতক সেনারা আবার পিছনে আসতে শুরু করল। এইভাবে প্রায় ঘণ্টাখানেক লাইনের অভ্যন্তরে পাক হানাদার খুনীদের নিঃশব্দ চাপা মাইর ও আঘাতে জর্জরিত কিছু ঘাতক সদস্য মাটিতে বসে পড়লে সহযোদ্ধারা পুনরায় অস্ত্রের আঘাতে আবার উঠে হাঁটা শুরু করল। আমরা যখন কসবা ব্রিজ অতিক্রম করে টরকী বাসস্ট্যান্ডের নিকট পৌঁছলাম তখন আমাদের পরিকল্পনা মোতাবেক আমি ভারতীয় একজন রাজপুত ক্যাপ্টেনের সঙ্গে হাঁটা অবস্থায় কথাবার্তা ও গল্পের মাধ্যমে বশ করা শুরু করলাম, আলাপ-আলোচনায় বুঝলাম যে সে একজন দক্ষ, চতুর ও পেশাগত সৈনিকসুলভ দৃঢ় ও অটুট মনোবলের অধিকারী সামরিক অফিসার। আমি এবার আমার অন্তরে লালিত মনোবাসনাটি প্রকাশ করে ঘাতক ফতেহ আলী ও ফজল খানের নেতৃত্বে ভুরঘাটা, গোপালপুর ও কালকিনি ও ঐ পারে গৌরনদীতে নিরীহ, নিরপরাধ মানুষ হত্যা, নারী-নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও ধ্বংসযজ্ঞের বিবরণীসহ ওদের দু’জনকে আমাদের কাছে হস্তান্তর করার দাবি, অনুরোধ আকারে পেশ করলাম, রাজপুত ক্যাপ্টেনটি আমার কথা শুনে খুবই মর্মাহত ও ব্যথিত হলেন, আমাকে জানালেন যে বিষয়টি আমি লাইনের সম্মুখে কর্নেল সিংয়ের সঙ্গে আলোচনা করে তোমাদের জানাচ্ছি, এই বলে লাইনের সম্মুখে গিয়ে কর্নেল সিংয়ের সঙ্গে শলা-পরামর্শ করে আমাকে জানালেন যে বিষয়টি খুবই গুরুতর স্পর্শকাতর এই কারণে যে, তুমি হয়ত জান যে জেনেভা কনভেনশন মোতাবেক ওরা আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। ওদের নিরাপত্তাসহ সকল কিছুই এখন আমাদের ওপর অর্পিত। তার কথায় কেউ সন্তুষ্ট হলো না। আমি বললাম, তোমাদের ভুরঘাটার ওপর দিয়ে মাদারীপুর যেতে হবে। জনগণের দাবি যদি তোমরা রক্ষা না করতে পার তবে, তোমাদের নিরাপত্তার ব্যাপারে আমরা নিশ্চয়তা প্রদান করতে পারি না। প্রয়োজনে তুমি আবার কর্নেল সিংয়ের সঙ্গে আলোচনা কর। এবার কর্নেল সিং আমাদের কথোপকথন শুনতে পেয়ে হাত উঁচু করে সামনে থেকে ধৈর্য ধারণ করতে বলার মতো একটা সঙ্কেত দিলেন। রাজপুত ক্যাপ্টেন কর্নেল সিংয়ের সঙ্গে আলাপ শেষে ফিরে এসে ঘাতক পাক বাহিনীর ফতেহ আলী খান ও ফজল খানকে আমাদের কাছে হস্তান্তরের বিষয়ে অপারগতার কথা ইনিয়ে-বিনিয়ে প্রকাশ করলেন। আমি বললাম যে, এই দুই পাক ঘাতক যদি মনে কর তোমার দেশের তোমারই এলাকায় ঠিক একই ধরনের মানবতাবিরোধী অন্যায় অপকর্ম করে তোমার পরিবার, আত্মীয়স্বজন, গ্রামবাসীদের নৃশংসভাবে হত্যা, নারী নির্যাতন ও অত্যাচার নৃশংসতা চালাত, তখন তোমার মধ্যে প্রতিশোধ নেয়ার কি ধরনের প্রতিক্রিয়া হতো? গৌরনদী কলেজ হতে কালকিনি ভুরঘাটা বাজার পর্যন্ত হাঁটা রাস্তা যেন আর শেষ হয় না। রাস্তার চারদিকে কয়েক হাজারের মতো জনতা চারদিকের গ্রামগুলো থেকে মহাসড়কে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। জনতার উচ্চারিত ‘জয় বাংলা’ সেøাগান ও হানাদার ঘাতকদের বিরুদ্ধে ধিক্কার ধ্বনি চলছে। সার্বিক পরিস্থিতি ও পরিসমাপ্তি যখন আমাদের অনুকূলে হবে না। এই বাস্তবতা উপলব্ধি করে আমার সহযোদ্ধারা ঘাতক বাহিনীর হেঁটে চলা সদস্যদের র‌্যাপিড এ্যাকশনের মাত্রা যেন আরও তীব্র থেকে তীব্রতর করে তুলল। ফলে আত্মসমর্পণকৃত ঘাতক সদস্যরা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে একেকজন জীবন বাঁচাতে আমাদের হাত-পা ধরে বিভিন্নভাবে কাকুতি-মিনতি জানাতে লাগল। গৌরনদী হতে কালকিনির ভুরঘাটা প্রান্তের রাস্তা প্রায় শেষ পর্যায়ে। খুনী ভুরঘাটা ক্যাম্পের হানাদার বাহিনীর ফতেহ আলী খান যখন লাইনের প্রায় শেষের দিকে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছিল, তখন আমি ওর ঠিক পিছনে গিয়ে অবস্থান নিয়ে আমার হাতের এসএলআরটি দু’হাতে উপরে তুলে মাথার ঠিক নিচে মেরুদ- লক্ষ্য করে ‘জয় বাংলা’ বলে শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে আঘাত হানলাম। আঘাতের প্রচ-তায় ফতেহ আলী খান চিৎকার করলে সম্মুখে ভারতীয় কর্নেল পিছন ফিরে শুধু বললেন, ‘মাৎ মারনা’। পাক হানাদার কর্নেল মনসুর ও মেজর ঘটক পিছনে না তাকিয়ে জোড় কদমে হেঁটে চলছে যত দ্রুত সম্ভব ভুরঘাটা পর্যন্ত পৌঁছতে ও উত্তেজিত জনতা ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের হাত থেকে পরিত্রাণের লক্ষ্যে। কর্নেল সিংয়ের চিৎকার সংবলিত নির্দেশে কোন কর্ণপাত বা ভ্রƒক্ষেপ না করে ইল্লাহ বাসস্ট্যান্ড হতে ভুরঘাটা বাজার পর্যন্ত পথটুকুতে সহযোদ্ধারা পায়ে চলন্ত অবস্থায় ঘাতক পাক বাহিনীর সদস্যদের ওপর দুই হাতে অবিরাম আঘাতের ওপর আঘাত চালিয়ে যাচ্ছিলেন। অবস্থা বেগতিক ও নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় ভারতীয় কর্নেল সিংয়ের নির্দেশে ভারতীয় বাহিনী আমাদের অনুরোধ করলেন যেন স্থানীয় জনগণকে সামলাতে তাদের সহযোগিতা করি। আমি তখন রাজপুত ক্যাপ্টেনকে বলেছিলাম, এই বিক্ষুব্ধ জনতা জেনেভা কনভেনশনের কোন মর্মবাণী জানে না বা বোঝে না, ওরা একমাত্র বোঝে ওদের নিকট আত্মীয়-স্বজনদের হত্যাকারীরা এখন ওদের সামনে, সুতরাং এই খুনী জালিমদের পাপাচারকৃত অপকর্মের বিরুদ্ধে ওরা এ্যাকশন চালাচ্ছে। আমরা মুক্তিযোদ্ধারা জয় বাংলা সেøাগান উচ্চারণ করে ভারতীয় মিত্র বাহিনীকে ভুরঘাটা হতে বিদায় দেয়ার প্রাক্কালে ভারতীয় কর্নেল সিং ও রাজপুত ক্যাপ্টেন আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিলেন, আর পাকি কর্নেল মনসুর ও মেজর ঘটক তখন জীপের অভ্যন্তরে ঘাপটি মেরে বসেছিল ভীতসন্ত্রস্ত ইঁদুরের মতো। লেখক : মুক্তিযোদ্ধা ও গবেষক
×