ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

হারের যন্ত্রণা ভুলতে বাফুফে ভবনে হামলা!

প্রকাশিত: ০৫:০৬, ২৩ ডিসেম্বর ২০১৫

হারের যন্ত্রণা ভুলতে বাফুফে ভবনে হামলা!

স্পোর্টস রিপোর্টার ॥ এ যেন উত্তপ্ত এক রণাঙ্গন। তবে এতে হামলা হয়েছে একতরফা। আর তাতে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে প্রচুর। সেই সঙ্গে তৈরি হয়েছে তীব্র আতঙ্কের। উঠেছে প্রশ্ন। মঙ্গলবার বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে) ভবনে হামলা করে ভবনের জানালার কাঁচ এবং গাড়ি ভাঙ্গা হয়। বেশ কিছু গাছের ডাল কেটে ফেলা হয়। এই হামলা করেছে আরামবাগ ক্রীড়া সংঘের শতাধিক ফুটবল সমর্থক। বিকেলে কমলাপুরের বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ সিপাহী মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত হয় ‘মিনিস্টার ফ্রিজ বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়নশিপ লীগ’-এ বাংলাদেশ পুলিশ এ্যাথলেটিক ক্লাব বনাম আরামবাগ ক্রীড়া সংঘের ম্যাচটি। ঘটনাবহুল ও তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ খেলায় পুলিশ ৩-২ গোলে হারায় আরামবাগকে। জয়ী দলের কোমল হ্যাটট্রিক করেন (৫৪, ৬১ ও ৭৬ মিনিটে)। বিজিত দলের পলাশ জোড়া গোল করেন (৫ ও ৯০+৩ মিনিটে)। এই ম্যাচ শুরুর আগে উভয় দলের পয়েন্ট সমান ছিল (৬ খেলায় ১০)। তবে গোলপার্থক্যে এগিয়ে থাকায় পয়েন্ট টেবিলের শীর্ষ ছিল পুলিশ, তৃতীয় স্থানে ছিল আরামবাগ (সমান পয়েন্ট নিয়ে দ্বিতীয় স্থানে ছিল অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেড স্পোর্টস ক্লাব)। মঙ্গলবারের ম্যাচে জেতায় অগ্রণী ব্যাংক এবং আরামবাগকে আরও পেছনে ফেলে নিজেদের শীর্ষ অবস্থানটা আরও সুসংহত করে ফেলে পুলিশ দল। ৩-১ গোলে আরামবাগ যখন পিছিয়ে, তখন খেলার অন্তিম মুহূর্তে পেনাল্টি থেকে আরামবাগের পলাশ একটি গোল পরিশোধ করেন। রেফারি তখন খেলা শেষের বাঁশি বাজালে হতাশা বাড়ে আরামবাগের সমর্থকদের। তাদের অভিযোগÑ রেফারি জালাল উদ্দিন পুলিশের প্রতি পক্ষপাতমূলক বাঁশি বাজিয়েছেন এবং তিনি ইচ্ছে করেই দ্রুত খেলার সমাপ্তি টেনেছেন। নইলে আরেকটু সময় পেলে আরামবাগ ঠিকই আরেকটি গোল করে ম্যাচে সমতা আনতে পারত। খেলা শেষ হওয়া মাত্র স্টেডিয়ামে উপস্থিত আরামবাগের সমর্থকরা গ্যালারির বেষ্টনী টপকে মাঠে ঢুকে পড়ে এবং হামলা চালায় রেফারি এবং তার দুই সহকারী রেফারির ওপর। সহকারী রেফারি মনির হোসেন তাদের হামলায় আহত হন। তার মাথা ফেটে রক্ত ঝরতে থাকে। অবস্থা বেগতিক দেখে মাঠে উপস্থিত পুলিশরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য আরামবাগের উগ্র সমর্থকদের ওপর নির্বিচারে লাঠি চার্জ করে। এতে অনেকেই আহত হয়। এ প্রসঙ্গে বাফুফের টেকনিক্যাল ডিরেক্টর বিএ জোবায়ের নিপু বলেন, ‘আমার কাছে মনে হয়েছে পুলিশ তখন লাঠি চার্জ একটু বেশি পরিমাণেই করে ফেলেছিল। এটা মেনে নিতে পারেনি আরামবাগের সমর্থকরা। কিন্তু তাই বলে তারা যে এ ঘটনার প্রতিশোধ নিতে বাফুফে ভবনে হামলা চালাবে, এটা অকল্পনীয় ছিল।’ যা হোক, লাঠিচার্জ করার পর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। কিছুক্ষণ পর পুলিশ প্রহরায় স্টেডিয়ামে ছেড়ে চলে যায় দুই দলের খেলোয়াড়রা। সমর্থকরাও বের হয়ে যান। ঘটনাটা শেষ হয়ে যেতে পারত এখানেই। কিন্তু তা হয়নি। একে তো হারের জ্বালা, তার ওপর পুলিশের নির্বিচার লাঠি চার্জ ... সব মিলিয়ে ক্ষোভে ফুঁসছিল আরামবাগের সমর্থকরা। তারা নিজেদের এলাকায় এসে বিষয়টা ছড়িয়ে দেয়। সন্ধ্যার দিকে (ঘড়িতে তখন ৫টা বাজে) শতাধিক আরামবাগের সমর্থক শোরগোল করতে করতে জোর করে বাফুফে ভবনের বাইরের গেট দিয়ে ঢুকে পড়ে ভেতরে। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই তারা সঙ্গে নিয়ে আসা প্রচুর ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে ভেঙ্গে ফেলে বাফুফের ভবনের জানালার কাঁচ, বেশকিছু গাছের ডাল ভেঙ্গে ফেলে। এমনকি ভেঙ্গে ফেলে বাফুফে ভবনে আসা প্রথম আলোর ক্রীড়া সাংবাদিক পবিত্র কু-ুর গাড়িও! এ প্রসঙ্গে পবিত্র কু- ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘মাঠে কি হয়েছে, সেটার সঙ্গে আমার কোন যোগ নেই। তাহলে আমার গাড়ি কেন ভাঙ্গা হলো? যারা এ কাজ করেছে, আমি তাদের কঠোর শাস্তি দাবি করছি।’ যখন হামলা চলছিল, তখন বাফুফে ভবন ছাড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল নেপাল থেকে এএফসি অনুর্ধ ১৪ গার্লস রিজিওনাল চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা জেতা দলের কয়েক নারী ফুটবলার, যারা আসন্ন এসএ গেমসে বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা ফুটবল দলে ডাক পায়নি। তাছাড়া সেই সময় বাফুফে ভবনের আবাসিক হোস্টেলে অবস্থান করছিল বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা ফুটবল দলও। তারা সবাই তখন স্বভাবতই ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন। চরম আতঙ্কিত হয়ে পড়েন বাফুফে ভবনে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও। হামলাকারীরা যেন বাফুফে ভবনের ভেতরে ঢুকতে না পারে, সেজন্য নিচতলার কলাপসিবল গেটটি বন্ধ করে দেয়া হয়। কিন্তু তাতে তালা লাগানোর সময় পাওয়া যায়নি! তবে হামলাকারীরা ভবনের ভেতরে আর ঢোকেনি। বাইরে থেকেই মিনিট দশেকের তা-বলীলা চালিয়ে চলে যায়। বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা দলের কোচ গোলাম রব্বানী ছোটন বলেন, ‘আমরা সবাই, বিশেষ করে মেয়ে ফুটবলারা দারুণ ঘাবড়ে গিয়েছিল। আল্লাহ্র রহমতে কারও কিছু হয়নি। সবাই অক্ষত আছে।’ বাফুফের সহ-সভাপতি বাদল রায় বলেন, ‘বাংলাদেশের ফুটবলের নিয়ন্ত্রক সংস্থার ভবনে ঢুকে এভাবে হামলা করে যাবে, এটা ভাবাই যায় না। কোনমতেই এটা মেনে নেয়া যায় না। অবশ্যই বাফুফে এই ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অচিরেই পদক্ষেপ গ্রহণ করবে, তাদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি দেয়া হবে।’ উল্লেখ্য, এ হামলার পেছনে ইন্ধন যোগানোর জন্য অনেকেই দায়ী করেছেন মতিঝিলের ওয়ার্ড কমিশনার একেএম মমিমুল হক সাঈদকে। কেননা, হামলা শেষ হওয়ার সামান্য আগে তাকে বাফুফে ভবনে ঢুকতে দেখা গেছে। যদিও এই অভিযোগ দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করেছেন সাঈদ। বাফুফের ভবনের পাশেই অবস্থিত মতিঝিল থানা। বিস্ময়কর বিষয় হচ্ছেÑ হামলার সময় তারা সময় মতো ঘটনাস্থলে হাজির হয়নি। পরে অবশ্য তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে এবং বাফুফে ভবনের নিরাপত্তা জোরদার করে। বাফুফে ঘটনার পরপরই মতিঝিল থানায় একটি জিডি করে। এখন দেখার বিষয়, পরবর্তীতে এ ঘটনার জের কতদূর গড়ায়।
×