ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মানব উন্নয়ন সূচকে এগোতে পারেনি বাংলাদেশ ॥ জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচী রিপোর্ট

প্রকাশিত: ০৪:৪০, ২১ ডিসেম্বর ২০১৫

মানব উন্নয়ন সূচকে এগোতে পারেনি বাংলাদেশ ॥ জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচী রিপোর্ট

কূটনৈতিক রিপোর্টার ॥ বিভিন্ন খাতে অগ্রগতি হলেও ২০১৫ সালের জাতিসংঘ মানব উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান অপরিবর্তিত রয়েছে। ১৮৮টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪২তম। শূন্য দশমিক ৫০৩ পয়েন্ট নিয়ে বাংলাদেশ প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তান, নেপাল ও মিয়ানমারের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে। তবে বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে ভারত ও ভুটান। এছাড়া সূচকে মধ্য আয়ের দেশের তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশ। রবিবার রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) সম্মেলন কক্ষে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচী (ইউএনডিপি) ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) যৌথভাবে ২০১৫ সালের মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন প্রকাশ করে। অনুষ্ঠানে ইআরডি সচিব মোহাম্মদ মেজবাহ উদ্দিন, অর্থনীতিবিদ ড. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ, বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী ড. রবার্ট ওয়াটকিনস, বাংলাদেশে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচীর প্রতিনিধি পলিন তামাসিস, বাংলাদেশের জাতিসংঘ মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন অফিসের পরিচালক ড. সেলিম জাহান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। প্রতিবেদনে বলা হয়, গত দুই দশক ধরে মানব উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান ভাল। অন্যদিকে পাকিস্তান খারাপ করছে। ভারতের অবস্থান এবার বেড়ে ১৩০তম হয়েছে। ভুটানের অবস্থান ১৩২তম। গত বছর ভারত ও পাকিস্তানের অবস্থান ছিল যথাক্রমে ১৩৫ ও ১৪৬। মানব উন্নয়ন সূচকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শ্রীলঙ্কার অবস্থান সবচেয়ে ভাল। দেশটি বর্তমানে ৭৩তম স্থানে রয়েছে। এবারের সূচকে নেপাল, পাকিস্তান ও মিয়ানমারের অবস্থান যথাক্রমে ১৪৫, ১৪৭ ও ১৪৮তম। বাংলাদেশের পয়েন্ট শূন্য দশমিক ৫০৩। তবে আগের বছর ছিল শূন্য দশমিক ৫৬৭ পয়েন্ট। বাংলাদেশ আগের বছরের চেয়ে এবারের সূচকে অগ্রগতি করলেও অবস্থান অপরিবর্তিত রয়েছে। অন্যান্য দেশও বিভিন্ন খাতে অগ্রগতি করেছে। সে কারণে অগ্রগতি হলেও সূচকের অবস্থান অপরিবতির্ত রয়েছে বলে জানিয়েছেন ঢাকার জাতিসংঘের কর্মকর্তারা। জাতিসংঘ মানব উন্নয়ন সূচকে শূন্য দশমিক ৬৭ পয়েন্ট নিয়ে সবার ওপরে রয়েছে নরওয়ে। এর পরের অবস্থানে রয়েছে অস্ট্রেলিয়া, সুইজারল্যান্ড, ডেনমার্ক, নেদারল্যান্ড, জার্মানি, আয়ারল্যান্ড, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, নিউজিল্যান্ড এবং সিঙ্গাপুর। মানব সূচক উন্নয়নে সবার নিচে রয়েছে নাইজার, সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক, ইরিত্রিয়া, চাদ, বুরুন্ডি ইত্যাদি। প্রতিবেদনে বলা হয়, পৃথিবীর ৭৩০ কোটির মধ্যে ৩২০ কোটি মানুষই কোন না কোন চাকরিতে নিযুক্ত। অবশিষ্ট মানুষ বিভিন্ন সেবামূলক, সৃষ্টিশীল ও স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজ করছে। তবে নিম্ন মানব উন্নয়ন পরিবেশে জীবন যাপনকারী মানুষের সংখ্যা ১৯৯০ সালে ৩০০ কোটি থেকে ২০১৪ সালে ১০০ কোটিতে নেমে এসেছে। ১৯৯০ ও ২০১৫ সালের মধ্যবর্তী সময়ে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে আয়ভিত্তিক দারিদ্র্য দুই-তৃতীয়াংশ কমে এসেছে। বিশ্বব্যাপী দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ১৯০ কোটি থেকে ৮৩ কোটি ৬০ লাখে নেমে এসেছে। শিশুমৃত্যুর হার অর্ধেকের বেশি কমেছে। ৫ বছরের কম বয়সী শিশু মৃত্যুর সংখ্যা ১২ কোটি ৭০ লাখ থেকে ৬০ লাখে নেমে এসেছে। এই সময়ের মধ্যে বিশ্বের জনসংখ্যা ৫৩০ কোটি থেকে ৭৩০ কোটি হয়েছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, গত দুই দশক ধরে বাংলাদেশ বিভিন্ন খাতে প্রতি বছর এক দশমিক ৫৫ শতাংশ হারে উন্নতি করেছে। মানুষের মৌলিক চাহিদাসহ সার্বিক গুরুত্বপূর্ণ খাতের ওপর ভিত্তি করে এ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। সূচকে মধ্য আয়ের দেশের তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশ। মধ্য আয়ের দেশের তালিকায় যে ৩৯টি দেশ রয়েছে বাংলাদেশ সেখানে ৩৭তম। বাংলাদেশের নিচে রয়েছে কম্বোডিয়া ও সাও তোমো এ্যান্ড প্রিন্সিপে। ২০১৫ সালের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বৈশ্বিকভাবে নারীরা পুরুষদের চেয়ে ২৪ শতাংশ কম আয় করে। বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক ও ব্যবস্থাপক এমন পদে রয়েছেন ২৫ শতাংশ নারী। তবে বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানের উঁচু পদের ৩২ শতাংশে কোন নারী নেই। আর রাষ্ট্রীয় জাতীয় আইনসভার একক বা নিম্ন কক্ষে এখনও মাত্র ২২ শতাংশ আসন নারীর দখলে রয়েছে। শিশুশ্রমের বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, সারা বিশ্বে এখনও ১৬ কোটি ৮০ লাখ শিশুশ্রমিক রয়েছে। এই সংখ্যা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ১১ শতাংশ। এদের মধ্যে ১০ কোটি ছেলে ও ৬ কোটি ৮০ লাখ মেয়ে। শিশুশ্রমিকদের মধ্যে প্রায় অর্ধেকে বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত। বিশ্বে আয়, সম্পদ ও অসমতার কথা উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্তমানে বিশ্বের জনসংখ্যার ৮০ শতাংশের অধিকারে বিশ্বের সম্পদের মাত্র ৬ শতাংশ রয়েছে। ২০১৬ সালের মধ্যে এই অনুপাত ৫০ শতাংশের জন্য এক শতাংশে গিয়ে ঠেকবে। এছাড়া দক্ষিণ এশিয়া ও সাব সাহারা অঞ্চলে জনসংখ্যা বেশি হওয়ার কারণে শ্রমের সুযোগ, সেবার চাহিদা ও সেবাদানকারীর সংখ্যায় ঘাটতি দেখা দেবে। একই কারণে সামাজিক সুরক্ষায় নীতিমালা গ্রহণে মানব উন্নয়নের ক্ষেত্রে বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, মানব উন্নয়ন সূচক হলো মানব উন্নয়ন তিনটি মৌলিক উপাদানের সমন্বয়ে একটি সামগ্রিক সূচক। মানুষের গড় আয়ু, জ্ঞান অর্জনের সক্ষমতা ও জাতীয় মাথা পিছু আয় অনুযায়ী জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের সক্ষমতার পরিমাপ। প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতিসহ সার্বিক উন্নয়নে চালকের আসনে রয়েছে তৈরি পোশাক ও শ্রমিক রফতানি। এছাড়া ক্ষুদ্র উদ্যোক্তরাও দেশের সার্বিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে। বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষা, মাতৃমৃত্যু হার, স্যানিটেশন ইত্যাদি ক্ষেত্রে সাফল্য দেখিয়েছে। তিনি বলেন, অনেকেই বলে থাকেন, বাংলাদেশ নিম্ন মধ্য আয়ের দেশ। তবে এটা ঠিক নয়। বাংলাদেশ এখন মধ্য আয়ের দেশ। তিনি বলেন, মাথাপিছু আয় বাদে অন্যান্য সূচকে বাংলাদেশ অনেক দেশের চেয়ে ভাল করেছে। এছাড়াও বিভিন্ন খাতে স্বল্প ব্যয়ের প্রযুক্তি ব্যবহারে বাংলাদেশের সফলতা উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য রোল মডেল হতে পারে বলে মন্তব্য করেন। অনুষ্ঠানে ইআরডির সিনিয়র সচিব মেজবাহ উদ্দিন বলেন, মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন আমাদের অনেক বড় অর্জন। জিডিপি প্রবৃদ্ধি ও সামাজিক নিরাপত্তা খাতে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং সামাজিক উন্নয়নে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে রোল মডেল। দেশে শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠা হয়েছে, অতি দারিদ্র্যতা নিরসন হয়েছে। অনুষ্ঠানে এক প্রশ্নের উত্তরে ড. সেলিম জাহান বলেন, বিশ্বে আমাদের অবস্থান ১৪১ না ১৪২ এটা বড় কথা নয়, বড় কথা আমাদের সার্বিক অগ্রগতি সামনের দিকে ধাবিত হচ্ছে। আমরা ভালভাবে সব সূচকে এগুচ্ছি। হয়ত অন্য দেশ আরও ভাল করছে। জাতি হিসেবে আমাদের সার্বিক অগ্রগতি ভাল। আমরা যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছি-আগামী পাঁচ বছরে মধ্য আয়ের দেশ থেকে উচ্চ মধ্যবিত্ত দেশে পরিণত হব। তিনি আরও বলেন, প্রযুক্তি খাতে আমাদের সাফল্যকে সঠিকভাবে ব্যবহার করে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক খাতে উন্নতি করতে হবে। তবে প্রযুক্তির উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল হলেও চলবে না। অনুষ্ঠানে জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি রবার্ট ওয়াটকিনস বলেন, বিশ্বজুড়ে সম্পদ রয়েছে। তবে সেই সম্পদের যথাযথ ব্যবহার করতে হবে। সম্পদের যথাযথ ব্যবহার হলে দারিদ্র্যতা কমে আসবে বলে তিনি মন্তব্য করেন। উল্লেখ্য, ১৯৯০ সালে জাতিসংঘ প্রথমবারের মতো বৈশ্বিক মানব উন্নয়ন সূচক প্রকাশ করে। এরপর গত ২৫ বছর ধরে সংস্থাটি বিশ্বজুড়ে ধারাবাহিকভাবে এই প্রতিবেদন প্রকাশ করে আসছে।
×