ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সন্ত্রাস দমনের কৌশল এখনও ঠিক ;###;করেনি জোট ;###;সবখানে আইএসের ঝুঁকি কমবে

প্রতিরোধী পদক্ষেপ ॥ সন্ত্রাসবিরোধী সৌদি জোট সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ অভিমত

প্রকাশিত: ০৪:৩৯, ২১ ডিসেম্বর ২০১৫

প্রতিরোধী পদক্ষেপ ॥ সন্ত্রাসবিরোধী সৌদি জোট সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ অভিমত

নাজনীন আখতার ॥ শিয়া অধ্যুষিত ইরাক, ইরান, সিরিয়ার মতো দেশেই এখন আর শুধু ইসলামিক স্টেট বা আইএসের ভয়াবহতা ও নৃশংসতা সীমাবদ্ধ নেই। এতদিন পর্যন্ত যেসব দেশকে আইএসের জন্য কম ঝুঁকিপূর্ণ মনে করা হতো, সেসব দেশেও বিস্তার লাভ করছে ধর্মকে পুঁজি করা এই উগ্র সন্ত্রাসবাদী সংগঠনটি। তাই আইএসের মতো সন্ত্রাসী জঙ্গী সংগঠনগুলোকে প্রতিহত করার লক্ষ্যে গঠিত সৌদি জোটকে ‘সময় থাকতেই প্রতিরোধ পদক্ষেপ’ বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা। একই মত প্রকাশ করেছেন দেশের বিশ্লেষকরাও। সৌদি জোট স্থল নাকি আকাশ পথকে গুরুত্ব দিয়ে সন্ত্রাসী সংগঠনের বিরুদ্ধে তাদের হামলা, কৌশল বা কর্মপরিকল্পনা সাজাবে তা এখনও জোটের উদ্যোক্তা সৌদি আরব স্পষ্ট করেনি। তাই বাংলাদেশসহ জোটভুক্ত দেশগুলোর সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ভূমিকা কী হবে তাও এখনও নির্ধারণ করা হয়নি। তবে জোট ঘোষণার চারদিন পর রবিবার আইএস সৌদি আরবে আক্রমণের হুমকি দিয়েছে। উল্লেখ্য, গত মঙ্গলবার সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদে এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে সৌদি আরবের ডেপুটি ক্রাউন প্রিন্স, দ্বিতীয় উপ-প্রধানমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী মোহাম্মদ বিন সালমান এই জোটের ঘোষণা দেন। এ বিষয়ে দেশটির রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা সৌদি প্রেস এজেন্সির (এসপিএ) রিপোর্টে বলা হয়, সৌদি আরব নেতৃত্বাধীন এ সামরিক জোটে বাংলাদেশ ছাড়াও জর্দান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, পাকিস্তান (প্রথমে সাড়া না দিলেও দুদিন জোটে অন্তর্ভুক্ত হতে আগ্রহ প্রকাশ করে), বাহরাইন, বেনীন, তুরস্ক, চাঁদ, টোগো, তিউনিশিয়া, জিবুতি, সেনেগাল, সুদান, সিয়েরালিওন, সোমালিয়া, গ্যাবন, গিনি, ফিলিস্তিন, কমোরোস, কাতার, আইভোরিকোস্ট, কুয়েত, লেবানন, লিবিয়া, মালদ্বীপ, মালি, মালয়েশিয়া, মিসর, মরক্কো, মৌরিতানিয়া, নাইজার, নাইজিরিয়া ও ইয়েমেন রয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি দেশ রয়েছে যাদের দেশে ইসলামের মতো অন্যান্য ধর্মের চর্চা রয়েছে সমান তালে। যেমন নাইজিরিয়ায় মোট জনসংখ্যার ৪০ শতাংশই খ্রীস্টান, ১০ শতাংশ রয়েছে ভিন্ন গোষ্ঠী যাদের নিজস্ব পৃথক ধর্মীয় মতবাদ রয়েছে। ইন্দোনেশিয়ার কাছে প্রস্তাব পাঠানো হলেও দেশটি এখনও সম্মতি প্রকাশ না করে জোটের কর্মপরিকল্পনা যাচাই করতে চাইছে। জোটের বাইরে রাখা হয়েছে, ইরাক, সিরিয়া, আফগানিস্তান ও সৌদি আরবের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ ইরানকে। গত বৃহস্পতিবার সিএনএন এই জোট গঠন নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলে, ইসলামী সন্ত্রাসবাদকে রোগ উল্লেখ করে সৌদি আরব ৩৪টি ইসলামী সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশকে নিয়ে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জোট গঠন করেছে। প্রতিবেদনে লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসে মিডল ইস্টার্ন স্টাডিজের অধ্যাপক ফাওয়াজ জর্জ জোট গঠনকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, এতদিন পর্যন্ত ধারণা করা হতো আইএস ইরান ও এর জোটভুক্ত দেশগুলোর চেয়ে আরব রাষ্ট্রগুলোর জন্য কম ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু আইএসের বিধ্বংসী কর্মকা-ে সেই ভুল ধারণা পাল্টে গেছে। আইএস শুধু ইরান, শিয়া অধ্যুষিত ইরাক, সিরিয়ার জন্য হুমকি নয়, তারা সুন্নী অধ্যুষিত দেশগুলোর জন্যও ভয়াবহ। নতুন এই জোট আইএসের বিরুদ্ধে সত্যিকারভাবে লড়াই চালাতে পারে কী না তা ভবিষ্যতই বলতে পারবে। তবে এই জোট গঠনের মাধ্যমে আইএসের হামলার ঝুঁকি কমানোর চেষ্টা করা হচ্ছে উল্লেখ করে ফাওয়াজ জর্জ বলেন, সিরিয়া ও ইরাক ছাড়াও কম-বেশি সব আরব রাষ্ট্রেই আইএসের সমর্থক রয়েছে। বিশেষ করে সৌদি, কুয়েত, লেবানন ও জর্দানে। তাই দেশগুলো আইএসের বিষয়ে ঝুঁকি কমাতে চাইছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, এর আগেও আইএস ইস্যুতে অনেক আরব রাষ্ট্রকে লো প্রোফাইলে থেকে তাদের দমনে সাড়া দেয়ার বিষয়টি উচ্চারিত হয়েছে। নতুন জোটেও একইভাবে বিষয়টি রাখা হয়েছে। সিএনএনের প্রতিবেদনে বলা হয়, আইএসসহ সন্ত্রাসী সংগঠনকে দমন করতে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন একটি জোট বিমান হামলা চালানোসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। সেক্ষেত্রে আরব দেশগুলোর অনুপস্থিতির বরাবরই সমালোচনা করে আসছিল পশ্চিমা দেশগুলো। এই জোট গঠনের মাধ্যমে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে মুসলিম দেশগুলোরও একটি পদক্ষেপ শুরু হলো। এ প্রসঙ্গে সৌদি আরবের ডেপুটি ক্রাউন প্রিন্স, দ্বিতীয় উপ-প্রধানমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী মোহাম্মদ বিন সালমান বলেন, সন্ত্রাসবাদের এই রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য ইসলামী বিশ্ব একটি জোটে এক সঙ্গে কাজ করবে। সন্ত্রাসবাদের বিস্তারের কারণে অনেক দেশ এখন ভুক্তভোগী। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, ইরাক ও সিরিয়ার দায়েশ, সিনাই, ইয়েমেন, লিবিয়া, মালি, নাইজিরিয়া, পাকিস্তান, আফগানিস্তান। এই দেশগুলোতে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে কঠোর লড়াইয়ের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। এই ক্ষেত্রে সন্দেহাতীতভাবে জোট সমন্বয় করে কাজ করবে। জোটের যৌথ অপারেশন সেন্টার হবে রিয়াদভিত্তিক। সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে অপারেশনে কী ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হবে সে বিষয়টি স্পষ্ট না করলেও সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী আদেল আল জুবায়ের জানান, পদক্ষেপের ক্ষেত্রে দুটি লক্ষ্যকে সামনে রাখা হবে। একটি হচ্ছে নিরাপত্তা এবং অন্যটি সামরিক। জোটভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে তথ্য, প্রশিক্ষণ, সরঞ্জামসহ প্রয়োজনীয় সব কিছু বিনিময় হবে। চরমপন্থীদের বার্তার বিরুদ্ধে তরুণদের জন্য আদর্শগত ও উজ্জীবিত বার্তা পৌঁছাতে জোটভুক্ত দেশগুলোর ইসলামী চিন্তাবিদ, শিক্ষাবিদ, রাজনৈতিক নেতাসহ বিশেষজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত করা হবে। আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে কী ধরনের বার্তা পৌঁছতে পারলে তরুণরা চরমপন্থীদের বিরুদ্ধাচারণ করবে। সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কী কী সহায়তা প্রয়োজন হবে তা নির্ভর করবে জোটভুক্ত দেশগুলো থেকে কী ধরনের অনুরোধ আসে এবং দেশগুলোর সহায়তা দেয়ার সদিচ্ছার ওপর। প্রত্যেকটি দেশ থেকে আলাদা আলাদাভাবে সিদ্ধান্ত আসতে হবে যে, তারা কী ভূমিকা রাখবে, কখন ভূমিকা রাখবে এবং কোন আকার ও ফর্মে তারা ভূমিকা রাখবে। এদিকে জোটে অন্তর্ভুক্তি নিয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানায়, নির্দিষ্ট করে আইএসবিরোধী নয়, সব ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকা-ের বিরুদ্ধে কাজ করবে এ জোট। সৌদি বাদশার এই উদ্যোগ সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে থাকা দেশগুলোকে আরও সমন্বিতভাবে কাজ করতে উৎসাহিত করবে। বাংলাদেশের এই জোটে যোগ দেয়াকে অত্যন্ত ইতিবাচক উল্লেখ করে সাবেক রাষ্ট্রদূত ওয়ালিউর রহমান রবিবার জনকণ্ঠকে বলেন, আইএস এমন একটি উগ্র সংগঠন যারা ইসলাম ও কোরান বিশ্বাস করে না। তারা ইসলামের নামে ভয়াবহ অন্যায় করে চলছে। ইসলামকে ধ্বংস করছে। ইসলামকে রক্ষা করতে এই আইএসকে ধ্বংস করতেই হবে। বাংলাদেশসহ জোটভুক্ত দেশগুলো এতে কার্যকর ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যায়। তিনি বলেন, বিশ্বের যে কোন প্রান্তে শান্তিরক্ষার বিষয় যদি হয়, তবে বাংলাদেশ সেখানে সৈন্য, সরঞ্জামসহ সামরিক সহায়তা পাঠাতেই পারে। এটা কোনভাবেই দেশের সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়। তিনি বলেন, ইতোমধ্যে ইন্দোনেশিয়ায় একটি সংগঠন কোরানের প্রকৃত ব্যাখ্যা ও আদর্শ ইংরেজীসহ বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ করে লাখ লাখ কপি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিয়েছে। সৌদি আরব সেভাবেই আইএসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য ৩৪ দেশকে জোটভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কূটনৈতিক কৌশলের দিক দিয়ে বাংলাদেশ এ জোটে যোগ দিয়ে সঠিক কাজ করেছে। সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশের একটি বিশাল শ্রমবাজার রয়েছে। সেটিও বিবেচনায় রাখতে হবে। এই জোটে যোগ দেয়া প্রসঙ্গে সরকারের অবস্থান ব্যাখ্যা করে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মোঃ শাহরিয়ার আলম সাংবাদিকদের জানান, সৌদি সরকারের পররাষ্ট্রন্ত্রী আদেল আল জুবায়ের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীকে টেলিফোন করে জোটের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবে ওই উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার আনুষ্ঠানিক অনুরোধ করেন। বাংলাদেশ তার অনুরোধে সাড়া দিয়েছে এবং প্রাথমিকভাবে জোটে যোগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। জোটটি সম্পর্কে বাংলাদেশ আরও বিস্তারিত জানতে চেয়েছে। এ নিয়ে পরবর্তী সময়ে জাতীয় সংসদে আলোচনা হবে। জোটে যোগ দিলে বাংলাদেশ আইএসের হুমকির মুখে পড়বে কী না সে প্রশ্নে প্রতিমন্ত্রী বলেন, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আইএস দমনে যে যুদ্ধ পরিস্থিতি বিরাজ করছেÑ এই উদ্যোগ সেটির সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। সব রকম সন্ত্রাসবাদ ও সহিংস উগ্রপন্থার বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণ করেছে। সে জন্যই সৌদি সরকার বাংলাদেশকে ওই জোটে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। সার্ক এবং প্রতিবেশী বিভিন্ন দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় যোগাযোগের মাধ্যমে বাংলাদেশ বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে জয়ী হয়েছে। এবার ওআইসিভুক্ত অন্য মুসলিম দেশের সঙ্গে বাংলাদেশ এই জোটে যোগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এদিকে সিএনএনের প্রতিবেদনে জোটভুক্ত দেশগুলো আইএসের বিরুদ্ধে আক্রমণের ক্ষেত্রে কতটা সক্রিয় থাকবে তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আইএসের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানে যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্ব দিচ্ছে (এই জোটে রয়েছে ৬৫টি দেশ)। ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে যেসব হামলা চালানো হয়েছে তার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও ইউরোপের কয়েকটি দেশের সহায়তায় ৮০ শতাংশ বোমা হামলা চালিয়েছে। মধ্যপ্রাচ্য ও আরব বিশ্বের ১০টি দেশও রয়েছে। তবে দেশগুলো কতটি বোমা হামলা চালিয়েছে তা জানাতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। পেন্টাগনের হিসাব অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন জোটে থাকা ৬টি আরব দেশ ইরাক ও সিরিয়ায় কোন বোমা হামলাই চালায়নি। বাহরাইন ও জর্দান গত কয়েক মাসে একটিও বোমা ফেলেনি। আর সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত এক মাসে একটি বোমা ফেলেছিল। এদিকে সৌদি জোট গঠনের ঘোষণা আসার চারদিন পর রবিবার আইএস সৌদি আরবে হামলার হুমকি দিয়েছে। রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, জোটের সদস্যভুক্ত ৩৪টি দেশকে ‘নির্বোধ ও বোকা’ উল্লেখ করে আইএস বলেছে, আল্লাহর অনুমতি নিয়ে বলা যায়, এই জোটের মধ্য দিয়েই ইসলামের মাটিতে অত্যাচারী শাসক সরকারগুলোর পতন শুরু হবে।
×