ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মেজবাহউদ্দিন জওহের

আরব বসন্ত এবং মধ্যপ্রাচ্য সঙ্কট

প্রকাশিত: ০৩:৩৬, ২১ ডিসেম্বর ২০১৫

আরব বসন্ত এবং মধ্যপ্রাচ্য সঙ্কট

(শেষাংশ) তবে সিরিয়ার অপারেশনটা শুরু করার আগেই ঘটনা আরেক দিকে মোড় নেয়। তিউনিসিয়ায় সামান্য একটি ঘটনা থেকে জন্ম নেয় এক অভাবনীয় গণজাগরণের- পশ্চিমা মিডিয়ার কল্যাণে যা আরব স্প্রিং বা আরব বসন্ত নামে বিখ্যাত হয়ে পড়ে। প্রচার করা হয়- এটি নাকি মধ্যপ্রাচ্যের একনায়কদের বিরুদ্ধে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত বিস্ফোরণ। এই বিস্ফোরণের ধাক্কায় একে একে বিদায় নেন- একনায়ক জয়নুল আবেদিন, হোসনি মোবারক, গাদ্দাফি। বাহরাইনের মেজরিটি শিয়া জনগণ ভাবল- এইবার সুযোগ এসেছে। সৌদি বাদশাহদের ধামাধরা বাহরাইনের রাজারা মেজরিটি হওয়া সত্ত্বেও বাহরাইনী শিয়াদের যুগ যুগ ধরে সর্বপ্রকার অধিকার থেকে বঞ্চিত করে রেখেছে। এই সুযোগে তাদের উৎখাত করতে হবে। শুরু হলো গণআন্দোলন। আন্দোলনের তোড়ে বাদশাহর গদি টলটলায়মান। এইবার সৌদি বাদশাহদের (এবং আমেরিকার) টনক নড়ল। তিউনিসিয়া, মিসর ও লিবিয়ায় যখন গণআন্দোলন হয়, তখন আরব বসন্তের দোহাই দিয়ে আমেরিকা আন্দোলনকারীদের পক্ষ নেয়। কিন্তু বাহরাইনের ক্ষেত্রে তাদের পলিসি হয় ঠিক উল্টো। সৌদি নীতি হচ্ছে- দুনিয়া রসাতলে যাক, কিন্তু শিয়াদের কাছে ক্ষমতা দেয়া যায় না। ঘরের কাছের বাহরাইনে শিয়াদের ক্ষমতায় আসা মানে ইরান কর্তৃক বাহরাইন দখল হয়ে যাওয়া। সুতরাং ত্বরিত গতিতে সৌদি ফোর্স বাহরাইনে প্রবেশ করল এবং অমার্জনীয় নিষ্ঠুরতায় বিদ্রোহ দমন করে বাহরাইনের সুন্নি রাজতন্ত্র রক্ষা করল। বেচারা ইরান! নিউক্লিয়ার পাওয়ার হওয়া সত্ত্বেও সৌদি-ইসরাইল-ইউএস অক্ষের বিরুদ্ধে সরাসরি বাহরাইনে হস্তক্ষেপ করতে সাহস পেল না সে। এর পরবর্তী ঘটনা ইয়েমেনে। মধ্যপ্রাচ্যের দরিদ্রতম দেশ হলেও আয়তনে সে বিশাল। হুতি গোত্রের শিয়া জনগোষ্ঠী সুন্নি প্রেসিডেন্ট সালেহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসল এবং রাজধানী সানা দখল করে নিল। সালেহ প্রাণ নিয়ে সৌদি আরবে পালিয়ে গেলেন। সুন্নি শাসন রক্ষা করতে সৌদি আরব সরাসরি ইয়েমেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমে পড়ল, বিমান আক্রমণ করে বহু লোককে হত্যা করল। তবে ইয়েমেনের হুতিরা এত সহজে দমে যাওয়ার পাত্র নয়। এখনও সেখানে যুদ্ধ চলছে। এবার প্রাচীন সভ্যতার লীলাভূমি সিরিয়ায় আসা যাক। সুন্নি মেজরিটি (শিয়া-সুন্নি অনুপাত ১২:৭৫) স্টেট হলেও দেশটিতে কিভাবে যেন শিয়া রাজবংশ পুরুষানুক্রমিকভাবে শাসন করে যাচ্ছে (ঠিক ইরাক-বাহরাইনের বিপরীত ব্যাপার)। বর্তমান প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের পিতা হাফিজ আল আসাদ বহুযুগ সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট ছিলেন। বাশারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে আমেরিকা ও সৌদি মদদে সুন্নি বিদ্রোহীরা সেখানে যুদ্ধ শুরু করল এবং বিস্তীর্ণ অঞ্চল দখল করে নিল; কিন্তু বাশারের সেনাবাহিনীকে একেবারে পরাস্ত করতে পারল না। বাশারকে রক্ষা করতে ইরান এবং ইরাকের শিয়া জনগোষ্ঠী, লেবাননের হিজবুল্লাহ বাহিনী স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে এলো এবং বাশারের প্রতি নানাভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিল। কারণ বাশারের পতন মানে সিরিয়াতেও ইউএস-ইসরাইল-সৌদি এই ত্রয়ী শক্তির প্রভাব চিরস্থায়ী হওয়া, যা ইরান কোনভাবেই মেনে নিতে পারে না। সিরিয়ায় আরব বসন্ত শুরু হয় ২০১১ সালের বসন্তকালে। বছরের পর বছর যুদ্ধ করেও যখন কিছুতেই বাশারকে হঠানো গেল না তখন সুন্নি বিদ্রোহীরা এক নতুন স্ট্র্যাটেজি গ্রহণ করল। আইএস বা ইসলামী স্টেট গঠিত হলো, যার খলিফা বা আমিরুল মুমেনিন হলেন আবু বকর আল-বাগদাদী। বিশ্বের সব মুসলমানকে এই মুসলিম খেলাফতের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করার আহ্বান জানানো হলো। ভাল ফলও পাওয়া গেল, সুন্নি মুসলমানরা যেন নবজীবন ফিরে পেল। বিশ্বের সমস্ত দেশ হতে জিহাদিরা সিরিয়ায় যেয়ে ভিড় জমাল, তালেবান, আল-শাবাব, বোকো হারাম ইত্যাদি জিহাদি গোষ্ঠী আইএসের আনুগত্য স্বীকার করে বিবৃতি প্রচার করল। একের পর এক জনপদ, তেলক্ষেত্র আইএসের করায়ত্ত হলো। খলিফা তার দখলকৃত ভূমিতে শরিয়তী আইন চালু করলেন, পশ্চিমা ‘কাফেরদের’ গলা কাটা, যুদ্ধে বন্দী হওয়া নারীদের যৌনদাসী হিসেবে বিলিবণ্টন করা, প্রাচীন ঐতিহাসিক স্থাপত্যসমূহ ধ্বংস করা, নারীদের ঘরের বাইরে যাওয়ার নিষেধাজ্ঞা ইত্যাদি হাম্বলী আইন কড়াকড়িভাবে চালু করা হলো। এসব খবর যখন পশ্চিমা মিডিয়াতে প্রচার হতে থাকল, ওবামা সরকার একটু বেকায়দায় পড়ে গেল। তারা আইএসকে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিসেবে তালিকাভুক্ত করে এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করল। তবে আমেরিকার এই ঘোষণা নিহায়তই কাগুজে বিবৃতি বলেই মনে হয়। কারণ এত বড় একটা সুপার পাওয়ারের বিরুদ্ধে বছরের পর বছর যুদ্ধ করার ক্ষমতা আইএসের থাকার কথা নয়। কার্যত দেখা গেল, আমেরিকার যুদ্ধ ঘোষণার পরও আইএসের প্রতাপ একটুও কমেনি, আজ তারা এক স্থান থেকে বিতাড়িত হয়, কাল আরও গুরুত্বপূর্ণ কোন অঞ্চল দখল করে। এ যেন বাশারকে দুর্বল করার জন্য আরেক পাতানো খেলা। আইএস প্রকৃতপক্ষে ইউএস-সৌদির মানসপুত্র, একটু সমঝে চলার জন্য তাকে চোখ রাঙ্গানো চলে কিংবা ধমক দেয়া যায়, তাকে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করা যায় না। আইএস ধ্বংস হলে রাশিয়ার দালাল চিরশত্রু বাশারকে হঠানো যাবে না। একটু দেরিতে হলেও আমেরিকার এই পলিসি বুঝতে পারে লৌহমানব পুতিন। সুতরাং মধ্যপ্রাচ্যে তার শেষ বন্ধু বাশারকে রক্ষা করতে তিনি সরাসরি যুদ্ধে নামার ঘোষণা দিলেন এবং সিরিয়াতে রুশ সেনাবাহিনী পাঠালেন। এবার আমেরিকাকে একটু দুশ্চিন্তাগ্রস্ত বলে মনে হচ্ছে। সোভিয়েত রাষ্ট্র ভেঙ্গে গেলেও রাশিয়াকে যথেষ্ট ভয় পায় যুক্তরাষ্ট্র। পশ্চিমা শক্তিগোষ্ঠীকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে কিছুদিন আগেই ক্রিমিয়া দখল করে নিয়েছে সে। অর্থনৈতিকভাবে একটু দুর্বল হলেও বিশ্বের সবচেয়ে বৃহৎ আণবিক শক্তিধর দেশ রাশিয়া। জ্বালানি তেলের মজুদেও সে বিশ্বের এক নম্বরে। ওদিকে আরেক সুপার পাওয়ার চীনের মতিগতিও ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। সিরিয়া ইস্যুতে সে রাশিয়ার পক্ষেই থাকবে বলে অধিকাংশ সামরিক বিশ্লেষক মনে করেন। পশ্চিমা শক্তি যত ক্ষমতাধরই হোক না কেন, চীন-রাশিয়ার যৌথ শক্তির সামনে তা নিতান্তই নস্যি। এত কিছুর পরও সহজে আমেরিকা মাঠ ছেড়ে দেবে বলে আশা করলে ভুল হবে। আইএস ধ্বংস হওয়া মানে যুক্তরাষ্ট্রের পরাজয়। সুতরাং আইএসকে রক্ষা করতে তারা যে প্রাণান্ত চেষ্টা করবে, নানা রকম ছলচাতুরির আশ্রয় নেবে তা প্রায় নিশ্চিত করেই বলা যায়। তার লক্ষণ ইতোমধ্যেই দিগন্তে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়া রণাঙ্গনে ঋ-১৫ঈ যুদ্ধ বিমান ডেপ্লয়ের ঘোষণা দিয়েছে। এই বিমানগুলো শুধুমাত্র আকাশ থেকে আকাশে (ধরৎ ঃড় ধরৎ) ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে থাকে। আইএসের কোন প্লেন নেই। তা’হলে ঋ-১৫ঈ বিমানগুলো কাকে লক্ষ্য করে মিসাইল ছুড়বে? এর লক্ষ্যবস্তু যে নিশ্চিতভাবে রাশিয়ান বিমান, সে পূর্বাভাসের জন্য কোন সামরিক বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। সুতরাং আফগানিস্তানের মতো সিরিয়া যুদ্ধও দীর্ঘস্থায়ী হবে বলেই মনে হয়। তবে আফগানিস্তানের মতো ততটা নিঃসঙ্গ বোধ করবে না রাশিয়া। কারণ পার্শ্ববর্তী দুটো শক্তিশালী দেশ ইরান ও ইরাকের বিপুল শিয়া জনগোষ্ঠীর সাপোর্ট থাকবে তাদের প্রতি। তবে সিরিয়া যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র জিতুক কিংবা রাশিয়া জিতুক, দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে আল্টিমেট লুজার হবে সিরিয়ার জনগণ। শেষ কথা- আরব অঞ্চলে মুসলমানদের মধ্যে শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্ব অনেকটাই চিরায়ত এবং এই শত্রুতার উপশম হওয়ার কোন সম্ভাবনা আছে বলে মনে হয় না। এই ধর্মীয় বিভাজনের সুযোগ নিয়ে মুসলমান মুসলমানে বিভেদ আরও উস্কে দিয়ে সেখানে একচ্ছত্র প্রভাব টিকিয়ে রাখার রাজনীতি করছে আমেরিকা ও তার ইউরোপীয় মিত্ররা। এমন নয় যে, কেবলমাত্র সুন্নিরাই তাদের প্রিয়পাত্র। মিসরের প্রখ্যাত জাতীয়তাবাদী নেতা নাসের ছিলেন সুন্নি; কিন্তু তিনি পশ্চিমাদের তল্পিবাহক না হয়ে স্বদেশের মঙ্গল চিন্তা করতেন এবং ইঙ্গ-মার্কিন চোখ রাঙ্গানির তোয়াক্কা না করে সুয়েজ খাল জাতীয়করণ করে ইঙ্গ-মার্কিন কোম্পানির হাত থেকে সুয়েজকে মিসরের দখলে নিয়ে নেন। ফলে নাসের পশ্চিমা শক্তির পরম শত্রুতে পরিণত হন। সুয়েজ ইস্যু নিয়ে ইঙ্গ-মার্কিন বাহিনী মিসরকে আক্রমণও করে বসে, তবে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন মিসরের পক্ষে সরাসরি যুদ্ধে নামার হুমকি দিলে ইঙ্গ-মার্কিন বাহিনী পশ্চাৎপসারণ করতে বাধ্য হয়। ইরানের বাদশাহ রেজা শাহ পাহলভী ছিলেন আমেরিকার একান্ত অনুগত। শিয়া হওয়া সত্ত্বেও তখন ইরান ছিল পাশ্চাত্যের বিশ্বস্ততম বন্ধু। বর্তমানকালে মুসলিম জগতে সবচেয়ে কট্টর ইসলামী মতবাদ হচ্ছে ওয়াহাবিজম বা সালাফিজম। এই মতবাদের জন্মভূমি সৌদি আরব। অষ্টাদশ শতকের এক ইসলামী স্কলার- মোহম্মদ বিন আব্দুল ওয়াহাব (১৭০৩-১৭৯২) এই কট্টর মতবাদ প্রচার করেন এবং ইবনে সৌদ নামক রিয়াদের এক গোত্রপতির সহায়তায় সমস্ত আরব উপদ্বীপে এই মতবাদ প্রতিষ্ঠা করেন। ওয়াহাবী মতবাদের ভিত্তিতেই সৌদি রাজবংশের গোড়াপত্তন এবং সঙ্গতভাবেই ওয়াহাবী ইসলাম সৌদি আরবের অফিসিয়াল ধর্মমত। আল কায়েদা, আল শাবাব, বোকো হারাম, মুসলিম ব্রাদারহুড ইত্যাদি গোষ্ঠী সালাফিজম ফলো করেই তাদের জিহাদি কার্যক্রম পরিচালনা করছে। অথচ সৌদি আরব হচ্ছে আমেরিকার বিশ্বস্ততম বন্ধু। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, কে শিয়া কে সুন্নি আমেরিকার কাছে সেটি কোন বিচার্য বিষয় নয়। কাকে সাপোর্ট দিলে আমেরিকা তথা ইসরাইলের স্বার্থ রক্ষিত হবে, কিভাবে সেক্টরিয়ান ভায়োলেন্স সৃষ্টি করে মুসলমান রাষ্ট্রগুলোকে আরও দুর্বল করা যাবে- সেই বিবেচনায়ই পাশ্চাত্যের মধ্যপ্রাচ্যনীতি প্রণীত হয়। ভুললে চলবে না যে, মুজাহেদিন, তালেবান, আল কায়েদা এবং হালের আইএস সবই আমেরিকার তৈরি, আমেরিকার মানসপুত্র। মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম রাষ্ট্রগুলো যদি শিয়া-সুন্নি বিভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধ হয়, পাশ্চাত্যের জন্য তা এক চরম হুমকি। কারণ অফুরন্ত প্রাকৃতিক সম্পদের ভা-ার মুসলিম রাষ্ট্রগুলো পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়াই না করলে মার্কিনীদের সমরাস্ত্রের ফ্যাক্টরিগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। শুধু তাই নয়, ঐক্যবদ্ধ মধ্যপ্রাচ্য তথা ঐক্যবদ্ধ মুসলিম জগত বিশ্বের প্রধানতম সুপার পাওয়ার হয়ে দাঁড়াবে, যা ইসরাইল তথা গোটা পশ্চিমা শক্তির কাম্য হতে পারে না। অবশ্য এ জন্য ঢালাওভাবে আমেরিকা, ইসরাইল কিংবা অন্য পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোকে দোষারোপ করে লাভ নেই। প্রত্যেক জাতিই তাদের নিজেদের স্বার্থ বিবেচনা করে অন্য রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক নির্ধারণ করে। ব্যতিক্রম শুধু মুসলমান জাতি। সাম্প্রদায়িক বিভেদের দেয়াল তুলে নিজেরা নিজেদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে, মারামারি করে মরছে। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে যদি আর কেউ তাদের রাষ্ট্রীয় ফায়দা হাসিল করে তবে তাকে দোষ দিয়ে লাভ কী? তা’হলে প্রশ্নÑ মুসলমানদের এই অনৈক্য, এই বিভেদ কি কোনদিন শেষ হওয়ার নয়? উত্তরটা কঠিন মনে হলেও ততটা কঠিন হয়ত নয়। বিগত চৌদ্দ শ’ বছরের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, কোন রাষ্ট্রনায়ক যখন ধর্মীয় মতবাদকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে না এনে ব্যক্তিগত চর্চা হিসেবে কোণঠাসা করে রেখেছেন, তিনিই সফলকাম হয়েছেন। উদাহরণ- খলিফা আল মামুন, হারুনুর রশীদ, তুরস্কের মুস্তফা কামাল পাশা। অটোমান খলিফাদের ধর্মভিত্তিক রাজতন্ত্র তথা খিলাফত আমলে তুরস্ক এতটাই পিছিয়ে পড়ে যে, তুরস্ককে ‘ইউরোপের রুগ্ন মানব’ নামে আখ্যায়িত করা হতো। মুস্তফা কামাল পাশা খিলাফত প্রথা বিলুপ্ত করে তুরস্ককে একটি সেক্যুলার স্টেট হিসেবে ঘোষণা দেন। তুরস্কের সমস্ত ধর্মীয় মাদ্রাসা বিলুপ্ত করে আধুনিক স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয়। মেয়েদের অবরোধের ধর্মীয় আবরণ ভেঙ্গে বাইরের কর্মক্ষেত্রে নিয়ে আসা হয়। ফলে অচিরেই তুরস্ক একটি শক্তিশালী নেশন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ধর্মকে যখনই রাষ্ট্রীয় চালিকাশক্তি বানানো হয়েছে, তখনই সেই রাষ্ট্রের পতন হয়েছে। উদাহরণ- দিল্লীর বাদশাহ আকবর ও আওরঙ্গজেব। মহামতি আকবর উপলব্ধি করেন যে, বিপুল হিন্দু মেজরিটির একটা ভূখ- ইসলামী শরিয়তী আইন মোতাবেক পরিচালনা করা সম্ভব নয়। এই দেশটিকে সফলভাবে পরিচালনা করতে হলে রাষ্ট্রকে ধর্মনিরপেক্ষ হতেই হবে। আকবরের ধর্মনিরপেক্ষ নীতির ফলে ছোট্ট মুঘল সাম্রাজ্য আফগানিস্তান হতে ব্রহ্মদেশ (মিয়ানমার) পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়েছিল এবং এক সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়েছিল। ভিত্তিটা এতটাই মজবুত হয়েছিল যে, দিল্লীর বাদশাহকে পৃথিবীর বাদশাহ বলে সম্মানিত করা হতো- ‘দিল্লীশ্বর জগদীশ্বর’। আকবরের পর দুই জেনারেশন (জাহাঙ্গীর ও শাজাহান) মোটামুটি তার নীতিতেই অটুট ছিলেন। ফলে মুঘল সাম্রাজ্যে তেমন কোন গোলযোগ দেখা যায়নি। কিন্তু থার্ড জেনারেশনের বাদশাহ আওরঙ্গজেব ছিলেন কট্টর সুন্নি মতাবলম্বী। তিনি রাজ্যে তার ধর্মীয় মতবাদ কঠোরভাবে প্রয়োগ করেন। ফলশ্রুতিতে রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে ওঠে, যা নিভাতে তাকে সারা জীবন যুদ্ধের ময়দানে কাটাতে হয় এবং যুদ্ধরত অবস্থায়ই তিনি মারা যান। আওরঙ্গজেবের উত্তরসূরিরা আর কেউই সেই ভাঙ্গন রোধ করতে পারেননি। কয়েক জেনারেশন পরেই সুবিশাল মুঘল সাম্রাজ্য ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। রাষ্ট্র সবার, ধর্ম যার যার- এই নীতির মধ্যেই মধ্যপ্রাচ্যের রাষ্ট্রগুলোর প্রগতি ও ঐক্যের বীজ নিহিত। অন্যথায় সুন্নিরা শিয়াদের বিরুদ্ধে ও শিয়ারা সুন্নিদের বিরুদ্ধে তরবারি শান দিতেই থাকবে এবং জিহাদের নামে কাফের হত্যার নাম নিয়ে আল কায়েদা, তালেবান, লস্কর, মুজাহেদিন, বোকো হারাম ইত্যাদি নিত্যনতুন ব্যানারে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর আবির্ভাব ঘটবে; সুন্নিরা শিয়াদের মারবে, শিয়ারা সুন্নিদের বিরুদ্ধে লড়াই করবে ও রাষ্ট্রীয় ভিত দুর্বল থেকে দুর্বলতর হবে। সেই সুযোগে সুবিধাবাদী বৈশ্বিক মোড়লরা অবাধে তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হবে। এই বোধ যতদিন পর্যন্ত মধ্যপ্রাচ্যের জনগণের মধ্যে জাগ্রত না হবে ততদিন পর্যন্ত সেখানে রক্তপাত বন্ধ হওয়ার কোন সম্ভাবনা আছে বলে মনে হয় না। বৃহৎ শক্তিবর্গ আপোসের মাধ্যমে এই অঞ্চলকে ভাগবাটোয়ারা করে স্ব স্ব প্রভাববলয় নির্ধারণ করে হয়তো সাময়িকভাবে যুদ্ধ বন্ধ করবে ঠিকই, তবে আত্মসম্মান বিকিয়ে অন্যের প্রভাববলয়ে আত্মসমর্পণ করে কোনমতে টিকে থাকার মধ্যে কোন গৌরব নেই। তা ছদ্ম দাসত্বের নামান্তর মাত্র।
×