ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ঢাকা চট্টগ্রাম ও সিলেটে ইউআরপি ও ইউবিএসপি নামে দুটি প্রকল্প নেয়া হচ্ছে

ভয়াবহ ভূমিকম্প মোকাবেলায় বিশেষ উদ্যোগ ॥ বিশ্বব্যাংক ও জাইকা দেবে ১৮ কোটি ডলার

প্রকাশিত: ০৫:১১, ২০ ডিসেম্বর ২০১৫

ভয়াবহ ভূমিকম্প মোকাবেলায় বিশেষ উদ্যোগ ॥ বিশ্বব্যাংক ও জাইকা দেবে ১৮ কোটি ডলার

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ ভয়াবহ ভূমিকম্প ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশ। যে কোন মুহূর্তে ভূমিকম্পে শহরাঞ্চলের হাজার হাজার বিল্ডিং ধসে পড়ে ঘটতে পারে বহু প্রাণহানি ও সম্পদের ক্ষতি। এ রকম প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে ক্ষয়-ক্ষতি কমিয়ে আনতে উন্নয়ন সহযোগীদের সহায়তায় বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। যৌথভাবে দুর্যোগের হাত থেকে তিন শহর রক্ষায় সহযোগিতা দিচ্ছে বিশ্বব্যাংক ও জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা)। এ সংক্রান্ত দুটি প্রকল্প হচ্ছে আরবান রিজিলিয়ান্স প্রজেক্ট (ইউআরপি) এবং বিল্ডিং সেফটি প্রজেক্ট (ইউবিএসপি)। শনিবার সকালে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ মেজবাহ উদ্দিনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সচিব শাহ কামাল এবং গৃহায়ন ও গণপূর্ত সচিব মোহাম্মদ মঈনুদ্দিন আব্দুল্লাহ। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন এশিয়া প্যাসিফিক ইউনির্ভাসিটির ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর জামিলুর রেজা চৌধুরী। বক্তব্য রাখেন জাইকার চীফ রিপ্রেজেন্টেটিভ মিকিও হেতাদা। ২০১০ সালের সিডিএমপি সূত্র উল্লেখ করে অনুষ্ঠানে জানানো হয়, ঢাকা বিভাগের মধুপুর ফল্টে যদি ৭ দশমিক ৫ মাত্রার ভূমিকম্প হয় তাহলে ঢাকা শহরের ৮৬ হাজার আধুনিক বিল্ডিং ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং ৭২ হাজার বিল্ডিং ধ্বংস হবে। যদি ভূমিকম্পটি রাত দুটায় হয় তাহলে মারা যাবে ৮৮ হাজার মানুষ আর যদি দুপুর দুটায় হয় তাহলে মারা যাবে ৬১ হাজার। চট্টগ্রাম বিভাগের প্লেট বাউন্ডারি ফল্ট-১ এ যদি ৮ দশমিক ৫ মাত্রার ভূমিকম্প হয় তাহলে শহরের ২৫ হাজার বিল্ডিং ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং ১ লাখ ৪২ হাজার বিল্ডিং ধ্বংস হয়ে যাবে। ভূমিকম্পটি যদি রাত দুটায় হয় তাহলে মারা যাবে ৯৫ হাজার মানুষ আর দুপুর দুটায় হলে মারা যাবে ৭৩ হাজার। সিলেট বিভাগের ডাউকি ফল্টে ৮ দশমিক ৫ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে শহরের ১৬ হাজার বিল্ডিং এবং ২৫ হাজার বিল্ডিং ধ্বংস হবে। ভূমিকম্পটি যদি রাত দুটার হয় তাহলে মারা যাবে ১০ হাজার মানুষ আর দুপুর দুটায় হলে মারা যাবে ৬ হাজার। এরই পরিপ্রেক্ষিতে প্রকল্প দুটি বাস্তবায়নে যাচ্ছে সরকার। প্রধান অতিথির বক্তব্যে পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল বলেন, আমি স্বাভাবিক মৃত্যু দেখতে চাই। কারও জন্য অস্বাভাবিক মৃত্যু দেখতে চাই না, সবাই চায় তার স্বাভাবিক মৃত্যু হোক। এজন্য আমরা আর একটি রানা প্লাজা দেখতে চাই না। ভুল থেকে শিক্ষা নিতে চাই, আর ভুল করতে চাই না। মন্ত্রী বলেন, সারাদেশে বিশেষ করে ঢাকা শহরে জমির ম্যাপিং করতে হবে। তারপর কোন এলাকায় কেমন বিল্ডিং করা যাবে তা ঠিক করে দিতে হবে। ভূমিকম্পের মতো দুর্যোগের কোন পূর্বাভাস পাওয়া যায় না। তাই দুর্যোগ মোকাবেলা করা না গেলেও আমরা সচেতনতা বৃদ্ধি করে ক্ষয়ক্ষতি কমাতে পারি। এজন্য সচেতনতার বিকল্প নেই। সরকারীভাবে গ্রাম-ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত জমির জোনিং করা প্রয়োজন। কেননা মানুষ মনে করে নিজের টাকায় বিল্ডিং বানাচ্ছি কার কি আসে যায়। এ ধারণা বদলাতে হবে। তিনি বলেন, সরকার উদ্যোগ নিচ্ছে কিন্তু সচেতনতা তৈরিতে সবার সহযোগিতা প্রয়োজন। অনুষ্ঠানে আরও জানানো হয়, আরবান রিজিলিয়ান্স প্রজেক্ট বাস্তবায়নে সহায়তা করবে বিশ্বব্যাংক। এটি বাস্তবায়নে মোট ব্যয় হবে ১৭ কোটি ৯৫ লাখ মার্কিন ডলার। এর মধ্যে বিশ্বব্যাংক দেবে ১৭ কোটি ৩০ লাখ মার্কিন ডলার এবং সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে ব্যয় হবে ৬৫ লাখ মার্কিন ডলার। এ প্রকল্পের মাধ্যমে ঢাকা ও সিলেট শহরের অবকাঠামো শক্তিশালীকরণ যে কোন স্থাপনা যেন দুর্যোগ মোকাবেলায় সক্ষম হয় তা নিশ্চিত করা এবং শহরের দুর্যোগ মোকাবেলায় জনগণের সক্ষমতা বৃদ্ধি করা। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে জরুরী দুর্যোগ মোকাবেলায় ক্যাপাসিটি বৃদ্ধি পাবে। শহরের উন্নয়ন ও নির্মাণ কাজে সচেতনতা বাড়বে। এছাড়া প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনা, বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন এবং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বাড়বে। অন্যদিকে আরবান বিল্ডিং সেফটি প্রকল্পটি বাস্তবায়নে সহায়তা দেবে জাইকা। এটি বাস্তবায়নে জাইকা ব্যয় করবে মোট ১২ দশমিক ১ বিলিয়ন জাপানি ইয়েন। এ প্রকল্পের মাধ্যমে ঢাকা মেট্রোপলিটন ও চট্টগ্রামে বিল্ডিং শক্তিশালীকরণে সহায়তা দেয়া হবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে এই দুই শহরে সরকারী ও বেসরকারী বিল্ডিং শক্তিশালী করতে সহজ শর্তে ঋণ দেয়া হবে। শহরের বিল্ডিংগুলোকে ভূমিকম্প ও যে কোন দুর্যোগ সহনীয় করতে সহায়তা দিতে প্রকল্পটি কার্যকর ভূমিকা রাখবে। অনুষ্ঠানে বক্তারা ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড পুরোপুরি অনুসরণ করে শহরে বিল্ডিং তৈরির প্রতি বিশেষ তাগিদ দেন। এ ক্ষেত্রে বলা হয় রেগুলেটরি বডিগুলোকে শক্তিশালী করতে হবে। জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও গবেষণা কার্যক্রম বাড়াতে হবে। এক্ষেত্রে হাউজিং এ্যান্ড বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউটকে শক্তিশালী করতে হবে এবং ফায়ার সার্ভিস এ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের গবেষণা, যন্ত্রপাতি এবং সম্পদ ও জনবল বাড়াতে হবে। উন্নয়ন সহযোগীদের (বিশ্বব্যাংক, জাইকা, ইউএনডিপি ইত্যাদি) সহযোগিতা বাড়াতে হবে। পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, মানবসৃষ্ট অনাচারে পৃথিবী আজ কঠিন বিপর্যয়ের মুখোমুখি। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে এক ডিগ্রী সেলসিয়াস বেশি। এরই প্রভাবে পৃথিবীর অনেক অঞ্চল পানির নিচে তলিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের সিডর আক্রান্ত এলাকা আজও স্বাভাবিক পর্যায়ে ফিরে আসেনি। বলা হচ্ছে ইতালির একটি শহর পানির ওপর ভাসমান। ২০৩০ সালের মধ্যে পানির, উচ্চতা ত্রিশ ইঞ্চি বেড়ে যাওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবে হিটওয়েভে মারা যাচ্ছে অগণিত মানুষ। তিনি বলেন, গত একশ বছর আগেও তা পরিলক্ষিত হয়নি। গত ছয় মাসে ভারত ও পাকিস্তানে কয়েক হাজার মানুষ হিটওয়েভে প্রাণ হারিয়েছে। আমেরিকায় ১৯৮০ সালে ১০ হাজার, ৮৮ সালে ১৭ হাজার, ইংল্যান্ডে ১৯৮০ থেকে ১৯৯০ সাল এ দশ বছরে ৪০ হাজার, ২০১০ সালে রাশিয়ায় পাঁচ হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। মন্ত্রী বলেন, অতিসম্প্রতি পৃথিবীর ৬১৬টি শহরের ওপর একটি জরিপ চালানো হয় যেখান থেকে উঠে আসে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ভয়াবহ বন্যার চিত্র। ১৯৯৮ সালে ফ্রান্সের নিমস শহর, ২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নিউঅরলিন্স, ২০১০ সালে অস্ট্রেলিয়ার ব্রিসবেন এবং দুসপ্তাহ আগে ভারতের চেন্নাই শহর ভয়াবহ বন্যায় তছনছ হয়ে যায়। দুর্যোগের জন্য কেবল ঢাকা শহর অত্যন্ত ঝুঁকিপ্রবণ নয়। অপরিকল্পিত বিশেষ করে সঠিক মাটি পরীক্ষাসহ যথাযথ বিল্ডিং কোড না মেনে ভবন নির্মাণ করায় গোটা দেশের অপরিকল্পিত ভবনগুলোই ঝুঁকিপ্রবণ। তিনি বলেন, জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত দুর্যোগসহ বেশকিছু দুর্যোগ মোকাবেলা করা কঠিন নয়। তবে এ ব্যাপারে জনসচেতনতা সৃষ্টির পাশাপাশি বিল্ডিং নির্মাণে সকলকে আরও সতর্ক থাকতে হবে। ভবন নির্মাণ সংক্রান্ত সকল শর্ত প্রতিপালন করে ভবন নির্মাণে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জোরালো ভূমিকা গ্রহণ করছে। মন্ত্রী বলেন, বর্তমান বিশ্বে বেশিরভাগ মানুষ শহরাঞ্চলে বসবাস করায় শহরাঞ্চলের ক্ষতি প্রতিটি দেশের জন্য ব্যাপক ক্ষতির কারণ হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। ১৯৫০ সালেও শহরে বসবাস করত শতকরা ৩৩ ভাগ মানুষ। আজ সেটা শতকরা ৫০ ভাগে দাঁড়িয়েছে এবং ২০৫০ সালে এ সংখ্যা শতকরা ৮০ ভাগে দাঁড়াবে।
×