ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

টাকা উত্তোলনের পরই মুনাফা কমেছে ফার কেমিক্যালের

প্রকাশিত: ০৪:২৭, ২০ ডিসেম্বর ২০১৫

টাকা উত্তোলনের পরই মুনাফা কমেছে ফার কেমিক্যালের

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ পুঁজিবাজার থেকে টাকা উত্তোলনের পর থেকেই মুনাফা কমেছে নতুন তালিকাভুক্ত কোম্পানি ফার কেমিক্যালের। কিন্তু কোম্পানিটির উত্তোলিত ১২ কোটি টাকা দিয়ে মেশিনারি ক্রয় এবং বিদ্যমান ব্যবসায়িক সক্ষমতা বাড়ানোর কথা। প্রসপ্রেক্টটাসে এমন তথ্য দিয়েই বাজার থেকে কোম্পানিটির পরিচালনা পর্ষদ টাকা তুলেছিল। কিন্তু মুনাফা তো বাড়েনি, উল্টো কমেছে। তালিকাভুক্তির আগের তুলনায় কোম্পানির আয় কমে গেছে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ। যদিও আইপিও অনুমোদনের ক্ষেত্রে কোম্পানিটির পরিচালনা পর্ষদ কিছুটা জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছিল। কারণ বস্ত্র খাতের আরএন স্পিনিংয়ের রাইট শেয়ার কেলেঙ্কারির ঘটনায় বরখাস্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালকও ফার কেমিক্যালের উদ্যোক্তা হিসেবে ছিলেন। কিন্তু আইপিও অনুমোদনের ক্ষেত্রে জমা দেয়া প্রসপ্রেক্টাসে এ তথ্য লুকানো হয়েছিল। পরে অবশ্য ভুল স্বীকার করে মাত্র দুটি পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয়া হলে স্থগিত আইপিওর আবারও চাঁদা উত্তোলনের অনুমোদন দেয়া হয়। কোম্পানিটির বাজার থেকে ১২ কোটি টাকা উত্তোলন করে। এদিকে তালিকাভুক্তির পরই কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ বোনাস শেয়ারগুলো উচ্চ দরে বিক্রি করে দেয়। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের ওয়েবসাইট সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে বোনাস শেয়ার প্রদানের পর কোম্পানির উদ্যোক্তা পরিচালক আবিদ মোস্তাফিজুর রহমান ১০ লাখ ৫ হাজার, রেজাউর রহমান রাজু ১০ লাখ ৪৫ হাজার, লি জুং কুক ৪ লাখ ২ হাজার, কিম জং সুক ৪৪ লাখ ১ হাজার, ফাইয়াজ কাদের ২০ লাখ ৮৩ হাজার, নাসরিন আক্তার বানু ৫ লাখ, জাহাধা খন্দকার ৮০ হাজার, হোসনে আরা বেগম ৫ লাখ, রেজওয়ানা রহমান রিনি ১০ লাখ, শিরিন ফারুক ১৬ লাখ ২০ হাজার, আব্দুল কাদের ফারুক ৩৯ লাখ বোনাস শেয়ার বিক্রয় করেন। মোট ১ কোটি ৬১ লাখ ৩৪ হাজার বোনাস শেয়ার বিক্রি করেন তারা। তারা উচ্চ দরে ঠিকই নিজেদের হাতে থাকা বোনাস শেয়ারগুলো বিক্রি করে টাকা তুলে নিয়েছেন। কোম্পানিটির আইপিও প্রসপেক্টাসে দেয়া তথ্যে দেখা যায়, ২০০৮-০৯ হিসাব বছরে কোম্পানি লোকসান গুনলেও ২০০৯-১০ অর্থবছরে ৩ কোটি টাকা মুনাফা করেছে। পরের হিসাব বছরে (২০১০-১১) মুনাফা করে ৬ কোটি টাকা। ২০১১-১২ অর্থবছরে তা বেড়ে হয় ২১ কোটি টাকা। আর তালিকাভুক্তির আগের হিসাব বছরে অর্থাৎ ২০১২-১৩ অর্থবছরে মুনাফার পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ৪০ কোটি টাকা। দেখা যাচ্ছে, তালিকাভুক্ত হওয়ার আগে ৪ বছর ধারাবাহিকভাবে মুনাফা বেড়েছে কোম্পানির। অনেকটা জ্যামিতিক হারে কোম্পানির মুনাফা বেড়েছে। কিন্তু বাজার থেকে অর্থ সংগ্রহের পরই মুনাফার চিত্র পাল্টে গেছে। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির পর ২০১৩-১৪ হিসাব বছরে মুনাফা হয়েছে ২৮ কোটি টাকা। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে হয়েছে ৩০ কোটি টাকা। এ হিসাবে ২০১২-১৩ হিসাব বছরের তুলনায় ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ১২ কোটি টাকা ও ২০১৪-১৫ হিসাব বছরে ১০ কোটি টাকা মুনাফা কমেছে। অর্থাৎ তালিকাভুক্তির আগের বছরের তুলনায় মুনাফা কমেছে যথাক্রমে ৩০ ও ২৫ শতাংশ। পুঁজিবাজার থেকে অর্থ সংগ্রহের পর কোম্পানির পরিশোধিত মূলধন ও সংরক্ষিত আয় দ্বিগুণ হওয়ার পরও মুনাফার পরিমাণ কমে গেছে। দ্য ইনস্টিটিউট অব কস্ট এ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্টেন্টস অব বাংলাদেশের (আইসিএমএবি) প্রেসিডেন্ট এ এস এম শায়খুল ইসলাম বলেন, বছরের ব্যবধানে একটি কোম্পানির মুনাফায় ৫ শতাংশ পরিবর্তন হতে পারে। যদি মুনাফায় ৪০ কোটি থেকে ৩০ কোটিতে নেমে যায় বা ২৫ শতাংশ কমে যায় তা অস্বাভাবিক। এ জন্য জবাবদিহিতা করা উচিত। এছাড়া দেশের অর্থনীতিতে এমন কোন বিরূপ প্রভাব পড়ে নাই যে ২৫ শতাংশ মুনাফা কমে যাবে। অর্থনীতিবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, কোম্পানিগুলো মুনাফা ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখিয়ে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। কিন্তু পুঁজিবাজারে আসার পরই মুনাফা কমতে থাকে। তাই আইপিও অনুমোদনের আগে আরও ভালভাবে যাচাই-বাছাই করা উচিত। এদিকে আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, কোম্পানিটি ২০১২-১৩ হিসাব বছরে ৮৩ কোটি টাকার শেয়ারহোল্ডার ইক্যুইটি (মূলধন ও সংরক্ষিত আয়) ব্যবহার করে মুনাফা করে ৪০ কোটি টাকা। এ হিসাবে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ১২৩ কোটি টাকার শেয়ারহোল্ডার ইক্যুইটি ব্যবহারে মুনাফা হয় ৫৯ কোটি টাকা। ২০১৪-১৫ হিসাব বছরে ১৬৩ কোটি টাকার ইক্যুইটি ব্যবহারের হিসাবে হয় ৭৮ কোটি টাকা। এ হিসাবে কোম্পানিটি ২০১৩-১৪ হিসাব বছরে ৩১ কোটি ও ২০১৪-১৫ হিসাব বছরে ৪৮ কোটি টাকার মুনাফা কম করেছে। ফার কেমিক্যাল ২০১৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে আইপিওর মাধ্যমে সংগৃহীত অর্থ ব্যবহারের অনুমতি পায়। আইপিও থেকে প্রাপ্ত অর্থ ব্যবহার করতে ১ বছর বা ২০১৫ সালের মাঝামাঝি সময় লেগে যাবে বলে প্রসপেক্টাসে উল্লেখ করা হয়েছে। আইপিওর টাকা ব্যবহার না করতেই কোম্পানি কর্তৃপক্ষ ২০১৩-১৪ হিসাব বছরের জন্য ২০ শতাংশ বা ১৮ কোটি টাকার বোনাস শেয়ার প্রদান করে। এছাড়া ২০১৪-১৫ হিসাব বছরের জন্য ২৫ শতাংশ বা ২৩ কোটি টাকার বোনাস শেয়ার প্রদান করে। আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ফার কেমিক্যালের ২০১৪-১৫ হিসাব বছরে শেয়ার প্রতি নিট অপারেটিং ক্যাশফ্লো ছিল ০.১৩ টাকা। কিন্তু ২৫ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দিতে চাইলে শেয়ার প্রতি ২.৫ টাকা করে লাগত, যা প্রদান করা কোম্পানির সক্ষমতা ছিল না। তবে ২০১৩-১৪ হিসাব বছরে শেয়ার প্রতি ২.০৮ টাকা নিট অপারেটিং ক্যাশফ্লো থাকলেও নগদ লভ্যাংশের পরিবর্তে বোনাস লভ্যাংশ প্রদান করে।
×