ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বিকাশ পাণ্ডে, বিবিসি

ফেসবুক পেজে বিচিত্র মানুষ বিচিত্র কাহিনী

প্রকাশিত: ০৬:৩৭, ১৯ ডিসেম্বর ২০১৫

ফেসবুক পেজে বিচিত্র  মানুষ বিচিত্র কাহিনী

বিশ্বের বৃহত্তম সামাজিক মিডিয়া ফ্ল্যাটফর্ম বলা যেতে পারে ফেসবুককে যেখানে সংবাদ এক অতি প্রচলিত বা নৈমিত্তিক বিষয়। ফেসবুক কিছু কিছু মানুষকে সংবাদ হিসেবে নিয়ে আসে যারা কিনা এই সামাজিক মাধ্যমটি না থাকলে আদৌ কোনদিন সংবাদ হতে পারত কিনা সন্দেহ। এইভাবে এক অতি মূল্যবান সামাজিক দায়িত্ব ও ভূমিকাও পালন করে চলেছে ফেসবুক। ব্রান্ডন স্টান্টনের ‘হিউম্যানস অব নিউইয়র্ক পেজ’ এর কথাই বলা যেতে পারে। সম্প্রতি ফেসবুকের এই পাতাটি পাকিস্তানের একটি দাতব্য প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রায় ২০ লাখ ডলার সংগ্রহ করে রীতিমতো সংবাদে পরিণত হয়েছে। এটি সহজেই ফেসবুকের সবচেয়ে জনপ্রিয় পাতাগুলোর একটি হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে। কি কারণে? কারণ ম্যানহাটনের সাধারণ মানুষদের চেহারা ও কাহিনী তুলে ধরার লক্ষ্য নিয়ে চালু হওয়া এই পাতাটি অন্যান্য দেশ ও নগরীর বহু মানুষকে এমনি ধরনের উদ্যোগ নিতে অনুপ্রাণিত করেছে। অনেকটা এভাবেই চালু হয়েছে কারিশমা মেহতা পরিচালিত ফেসবুক পেজ ‘হিউম্যানস অব বোম্বে’। এই পেজে ক্যারিশমা মুম্বাইয়ের নিষিদ্ধ পল্লী কামাথিপুরায়’ বেড়ে ওঠা কিশোরী সায়রার জীবনকে তুলে এনেছে। সেখানে সায়রা বলেছে : ‘ধর্ষিতা হবার জন্য একদা আমি নিজেকেই দায়ী করতাম। কিন্তু আজ জানি এ আমার দোষ নয়। আমি আমার মতো হাজার হাজার নারীকে অনুপ্রেরণা যোগাতে চাই যারা এতদিন নীরব থেকেছে এবং নিজেদের কলঙ্কিত মনে করেছে। কিন্তু আমরা তো কলঙ্কিত নই।’ সায়রা আরও বলেছেন, নিষিদ্ধ পল্লীতে বাস করা তাঁর মায়ের মতো আরও অনেক নারীর ইচ্ছা অনিচ্ছার ব্যাপার ছিল না। ‘মা একাজটাকে নোংড়া কাজ ভাবছেন এ কারণেই আমি সর্বদা কষ্ট পেতাম। ওটাকে নোংড়া বলে মনে করা হবে কেন? আমি চাই তিনি ও তার মতো আর সবাই জানুক যে তারা যা করছেন তার মধ্যে অন্যায়ের কিছু নেই। কারিশমা মেহতা কামাথিপুরায় গিয়ে সায়রার সঙ্গে দেখা করেন। তার কাহিনী লিখে নেন এবং সায়রা ও তার মতো মেয়েদের স্বেচ্ছাশ্রমে গড়ে ওঠা একটি এনজিওর অর্থ সংগ্রহে সাহায্য করেন। কি বিস্ময়কর ক্ষমতা ফেসবুকের। সায়রার কাহিনী শুনে ফেসবুক পেজটির ৩ লাখ ৭০ হাজার ফ্যান ১৫ ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে ৭৮০০ ডলার দান করেন। মেহতা জানান, ‘হিউম্যানস অব নিউইয়র্ক পেজ’-এর জনপ্রিয়তায় অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি মুম্বাইয়ে একই ধরনের পেজ চালু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তাই বলে পেজটা এতখানি জনপ্রিয় হয়ে দাঁড়াবে আশা করেননি। তিনি বলেন, ‘আমাদের মাঝে বাস করে অথচ কদাচিৎ তাদেরকে আমাদের চেনার সুযোগ ঘটে এমন লোকদের কাহিনীই আমি ছাপতে চেয়েছি। গতানুগতিক ধারার কাহিনী নয়। তবে আমি স্বাভাবিক মানব আবেদনধর্মী কাহিনীরই সন্ধান করে থাকি।’ তা করতে গিয়ে কি কোন সমস্যা হয় না? হয় না তা নয়Ñ স্বীকার করেন মেহতা। ‘মুম্বাই এক কর্মব্যস্ত শহর। মাঝে মাঝে জনগণের তরফ থেকে প্রতিরোধ এসেছে। তবে তাদের সঙ্গে কথা বলতে হয়েছে এবং বুঝাতে হয়েছে আমরা আসলে কি করছি।’ মেহতার নির্দিষ্ট কোন দৈনন্দিন রুটিন নেই। তাঁর কাজ স্রেফ শহরময় ঘুরে বেরিয়ে চেহারা ও কাহিনীর সন্ধান করা। তিনি বলেন, ‘ভারি অবাক ব্যাপার হলো আমরা ইন্টারনেট যুগে বাস করি অথচ নিজেদের প্রতিবেশীদের ব্যাপারে তেমন কিছুই জানি না। এই মনমানসিকতাকে বদলে দেয়াই আমার এই পেজের উদ্দেশ্য। এবং সেই সঙ্গে মুম্বাইয়ের বিভিন্ন চেহারাও আমি দেখানোর চেষ্টা করে আসছি।’ এই উদ্দেশ্য সাধনের পথে ‘হিউম্যানস অব বোম্বে’ একা নয়। দিল্লী, ব্যাঙ্গালোর ও চেন্নাইয়েও একই ধরনের ফেসবুক পেজ চালু হয়েছে। যেমন ‘হিউম্যানস অব ব্যাঙ্গালোর’ পেজ। এর প্রশাসক শ্রেয়া বিত্তালদেব বলেছেন, ‘তাঁর প্রিয় কাহিনী হলো এমন একজন মানুষকে নিয়ে যে নিজে ঈশ্বর বিশ্বাস করে না অথচ এক মন্দির প্রাঙ্গণে ধর্মীয় পুস্তিকা ও ছবির দোকান চালায়। হিউম্যানস অব ব্যাঙ্গালোর পেজে এই লোকটির উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে : ‘লোকে ধর্মের দাম নিয়ে তথা এখানে যা কিছু বিক্রি করা হচ্ছে তার দাম নিয়ে কখনও প্রশ্ন তোলে না। শুধু কেনে। গণেশের ছবি যদি একশ’ রুপী দামেও বেচি তবুও ওরা কোন প্রশ্ন তুলে না। ২শ’ রুপী দামে বেচলেও ওরা কিনবে।’ লোকটি শ্রেয়াকে জানায় যে লোকে ভিন্ন ছবি বা ভিন্ন ধরনের মঙ্গলসূত্রের অনুরোধ নিয়ে তাঁর কাছে আসছেই। তা থেকে ধারণা করা যায় যে তারা এখনও ধর্মকে সন্ধান করার চেষ্টা করে চলেছে। এ ধরনের কাহিনীগুলোই বিত্তালদেবকে তাঁর ফেসবুকের এই পেজ চালু করতে প্রেরণা যুগিয়েছে। তিনি বলেন, লোকে আসলে অখ্যাত অপরিচিত ব্যক্তিদের জীবন ও সংগ্রামের নানান কাহিনী পাঠ করে দেখার জন্য সময় বের করার ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠছে। এসব কাহিনী পড়লে এই সমাজে তাদের নিজেদের আর অপরিচিত বা ব্রাত্যজন বলে মনে হবে না। হিউম্যানস অব বোম্বের আদলে নয়াদিল্লীতে কৃতিশর্মা চালান হিউম্যানস অব নিউ দিল্লী পেজ। দিল্লীর বাসিন্দা হিসেবে যাদের মধ্যে সমাজ থেকে এক ধরনের বিচ্ছিন্নতাবোধ কাজ করে তাদের একে অপরের মধ্যে এবং বৃহত্তর পরিসরে তাদের ও সমাজের বাকি অংশের মধ্যে সেতুবন্ধ রচনার চেষ্টা করার প্রয়োজন থেকেই এই পেজের আবির্ভাব। কৃতিশর্মার কাছে সাধারণ মানুষের কাহিনীগুলো বেশ কৌতুহলোদ্দীপক। তাঁর প্রিয় একটি কাহিনীর জন্ম হয়েছিল নিম্নোক্ত সংলাপ থেকে : ‘আগে আমি আমস্টার্ডামে বাস করতাম। এখন এখানে বাঁশি বিক্রি করি।’ ‘তা আমস্টার্ডাম ছাড়লেন কেন?’ ‘একটা সময় আমার সব ছিল। সুন্দর জীবন ছিল কিন্তু তারপর সেই সুন্দর জীবন সবটাই হারিয়ে গেল এবং আমি এখানে চলে এলাম। তারপর আর কখনই আমস্টার্ডামে ফিরে যাবার বা অন্য কোথাও যাবার ইচ্ছা হয়নি। জীবনে কিছু কিছু জিনিস স্থায়ীভাবে থেকে যায়। অন্যগুলো অতটা নয়। আপনার কাছে সবচেয়ে মূল্যবান এমন কিছু যদি কেড়ে নেয়া হয়, তাহলে তো আপনার মানবাত্মাটাই ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায়।’ ‘কাকে ওখানে রেখে এসেছেন?’ ‘স্ত্রীকে ভীষণ ভালবাসতাম। কখনও আমাদের মধ্যে ঝগড়া মারামারি হতো না। এর চেয়ে ভাল সম্পর্ক ও সংসার জীবন আর হতে পারত না। তারপর আমি সঙ্গীতের জন্য আমস্টার্ডামে যাওয়ার সুযোগ পেলাম। ও আমাকে যেতে নিষেধ করল। হাতে পায়েও ধরল। বলল, তাঁকে ঐ অবস্থায় রেখে চলে গেলে সে মারা যাবে। আমি শুনলাম না। ওখানে চলে গেলাম এবং বউটাও মারা গেল।’ হিউম্যান্স অব ইন্ডিয়া ফেসবুক পেজ চালান রবিন কানকারওয়াল। মানুষের মজার মজার কৌতূহলোদ্দীপক সব কাহিনী অন্যদের কাছে পরিবেশনের মধ্যে যে আলাদা এক আনন্দ আছে একথা বিশ্বাস করেন তিনি। তার পাতায় পরিবেশিত সাবেক সেনা অফিসার লক্ষ্মীকান্ত শার্কের কাহিনী তার কাছে দারুণ প্রেরণাদায়ক মনে হয়েছে। এক দুর্ঘটনায় লক্ষ্মীকান্ত তার বাম পা ও বাম হাত হারিয়েছিলেন। তাই বলে তিনি হাল ছেড়ে দেননি। গাড়ি চালাতে ভালবাসতেন। দুর্ঘটনার পরও লং ড্রাইভে যাওয়ার নেশা ছাড়তে পারেননি। লক্ষ্মীকান্ত বলেন, ‘আমার প্রতিদিনের যাত্রায় এমন সাহস ও বীরত্বের স্বাক্ষর রাখতে চাই যা আগে আর দেখা যায়নি। তিনি বলেন, আমি একজন ধর্মবিশ্বাসী মানুষ। আমার হৃদয়ে সর্বদাই আছে ভালবাসা, মুখে আছে মৃদুহাসি। যা করা সব থেকে ভাল আমি সেটাই করিÑ জীবনকে উপভোগ করিÑ প্রতিটি ঘণ্টা, প্রতিটি মুহূর্ত, প্রতিটি দিন।’
×