ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

শব্দ মায়াজালের বিস্তার

প্রকাশিত: ০৬:৫৫, ১৮ ডিসেম্বর ২০১৫

শব্দ মায়াজালের বিস্তার

একটি জাতির সাহিত্য সংস্কৃতির কল্যাণের জন্য যুগোপযোগী রূপান্তর প্রয়োজন। জাতির প্রাণস্পন্দন জাগানোর জন্য নিজস্ব ঐতিহ্য ও চেতনাবোধকে শক্তিশালী হিসেবে গড়ে তোলা দরকার। আর এ ক্ষেত্রে উন্নত শিল্প-সাহিত্যের ভূমিকা অপরিসীম। সাহিত্যিকদের কালজয়ী সব সৃষ্টি সাধারণের মাঝে প্রেরণা জুগিয়ে থাকে। রবীন্দ্র-নজরুল পরবর্তীতে বাংলা সাহিত্যে দীর্ঘ সময়ব্যাপী অন্তর্নিহিত শক্তি দিয়ে যে যশধর কবি সাহিত্যিক পাঠক সমাজকে আপন করে নিয়েছেন। তাদের মধ্যে সৈয়দ শামসুল হক অন্যতম। এই শক্তিমান সাহিত্যিক, যিনি কলমকে হাতিয়ার হিসেবে মনে করেন তিনি সৈয়দ হক। যাপিতজীবনকে যিনি শিল্পের হাতে ছেড়ে দিয়েছেন। স্বহস্তে বিনির্মাণ করেছেন শিল্প। জীবনব্যাপী সাধনার ফলে তিনি হয়ে উঠেছেন একজন সত্যিকারের সাধক। হাতভর্তি রয়েছে তাঁর সাধনার ফল। তাঁর সৃজনশীলতার স্বাক্ষর এত বেশি শক্তিশালী যার দরুন তাঁর নামের আগে অনায়াসে চলে এসেছে সব্যসাচী সৈয়দ শামসুল হক। চিন্তায় ভাবনায় সৃজনের শিকড় সন্ধানী একজন কারিগর সৈয়দ হক। শিল্পের অভিনবত্ব এবং জাদুময়ী করস্পর্শে উঠে এসেছে স্বদেশ চেতনা। মুক্তিযুদ্ধসহ বাংলাদেশের ইতিহাস। দেশ সচেতন এই শিল্পীর কলমে নিখুঁতভাবে স্থান পেয়েছে বাঙালীর মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাস। চরিত্র-চিত্রণ করেছেন অভাব অনটনের রাহুগ্রাসেÑ জর্জরিত নিপীরিত লাঞ্ছিত ও নিষ্পেষিতদের। সুদীর্ঘ সময়ব্যাপী শব্দ সংসারে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন এই বরণ্যে সাহিত্যিক। একজন সুসাহিত্যিক হিসেবে তার নাম যশ বা খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে দিগি¦দিক। কালো কালির কারিশমায় শব্দের পর শব্দ গেঁথে চলেছেন এখন অবধি। শব্দ চাষী এই কারিগর নেশা এবং পেশাদারিত্বের সঙ্গেই লিখে চলেছেন দু’হাত ভরে । তাই তো তাঁর হাতে ধরা দিয়েছে শিল্প। বিস্তীর্ণ শব্দ-সমুদ্রের স্বরাঘাতে পাঠকের অন্তরে ঠাঁই পেয়েছেন অনেককাল আগেই। হ্যাঁ, তিনি সৈয়দ হক। বাংলা সাহিত্যের এক বরপুত্রের নাম। সেই কোনকালে লিখেছেন ‘নূরলদীনের সারাজীবন’। জাগো বাহে কোনঠে সবায়? অসাধারণ বচনবঙ্গি। ‘ধবলদুধের মতো জ্যোৎস্না তার ঢালিতেছে চাঁদÑ পূর্ণিমার/ নষ্ট খেত, নষ্ট মাঠ, নদী নষ্ট, বীজ নষ্ট, বড় নষ্ট যখন সংসার।’ ‘নূরলদীনের সারাজীবন সৈয়দ হক’ একটি ইতিহাস, একটি বিপ্লব। এমন একটি চেতনার ডাক শুধু সৈয়দ হকের মতো কলমযোদ্ধারাই দিতে পারেন। উপস্থাপন শৈলিতেই বলে দেয়া যায়, এটা সৈয়দ হকের কর্মযজ্ঞ। তিনি দু’হাত ভরে লিখেছেন বলে কি সব্যসাচী? না। এই সময়ে আমরা সবাই তো হাতের দশ আঙুলের সাহয্যে লিখে থাকি, কী-বোর্ডের বদৌলতে। তাহলে আমরা সবাই কী সব্যসাচী? সম্ভব নয়। সব্যসাচী তকমা শুধুমাত্র সৈয়দ হকের মতো পরিশ্রমী লেখকদের ভাগ্যেই জোটে। যারা জীবনকে বাজি রাখার সক্ষমতা রাখেন। অসীম সাহসী হতে হয়ে। কোন তোয়াক্কা তাঁদের আটকাতে পারে না। একজন সত্যিকারে সাহিত্যিকই মাত্র পারেন অনেক ঘাটÑনালা, নদী পেরিয়ে মহাসুদ্রের কিনারায় পৌঁছাতে। সাহিত্যকে বরণডালায় অর্ঘ্য সাজানোর মতো করে এমনকি সাহিত্যকে জীবনের মূল অনুষঙ্গ হিসেবে গ্রহণ করেই তিনি হয়ে উঠেছেন একজন সৈয়দ হক। এসেছিলেন বাংলাদেশের একপ্রান্ত থেকে! মঙ্গাবাস্তবতার নিমজ্জিত সে এলাকা। আর সেই মঙ্গাপীড়িত মানুষের জীবন কথাই স্থান পেয়েছে সাহিত্যে। শব্দের মায়াজালে বুনন করে চলেছেন। তাঁর সাহিত্যকর্মে ফুটে উঠেছে সে বাস্তবতা বার বার। সাহিত্যের সকল শাখায় বিচরণ করলেন। এমনকি তার এই বিচরণ সফল। হিরকখে র মতো, মুক্তোদানার মতো শব্দের অবচ্ছায়া। তিনি এখন হয়ে উঠেছেন সার্বজনীন। গ্রামীণ সোঁদা মাটির গন্ধে লিখিত ‘মহাশূন্যে পরান মাস্টার’। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং আন্দোলনকে মূল উপজীব্য করে সাহিত্য কর্ম চালিয়ে যাচ্ছেন। ভ্রমণপিপাসু সৈয়দ হক বাংলাদেশের ভেতরে অনবরত ভ্রমণশীল। ভ্রমণের মধ্য দিয়ে ‘বিশাল বাংলা ’গল্প গ্রন্থে এঁকে নিয়েছেন বাংলাদেশের মুখ ও ছবি। বাংলাদেশের মানুষের জীবনের ভাঙ্গাগড়া ও জীবন-অনুভবের বিস্তার রয়েছে তার রচনায়। তিনি বিরামহীন লিখিয়ে চলছেন। অনবরত নির্মাণশীল সৈয়দ হকের যেকোন লেখা নাম ছাড়া কোন পাঠকের চোখে পড়লেই, অনায়াসেই পাঠক মগজে তা অনুরণন ঘটায়Ñ এটা সৈয়দ হকের লেখা। ‘গল্পের কি শেষ আছে? সেই কোন আদ্যিকাল থেকে মানুষ কত লক্ষ কোটি আযুত গল্প বলছে, বানিয়েছে, লিখছে। এখনো তো ফুরায়নি সেই নেশা। কোনকালে ফুরোবে বলেও মনে হয় না। নেশা বটে। মহামাতকের চেয়েও কঠিন এ নেশা।’ গল্পের বয়ান, সৈয়দ হক গল্প সম্পর্কে সৈয়দ হক এমনটিই বলেছিলেন। মহামাতকের এই নেশা আসক্ত হয়েই তো তিনি লিখেছেন এক মহিলার ছবি অনুপম দিন, নিষিদ্ধ লোবান, খেলা রাম খেলে যা, বালিকার চন্দ্রযানসহ আরো অনেক কালজয়ী উপন্যাস। সৈয়দ হক একজন সুসাহিত্যিক তো বটেই তিনি একজন উচ্চতর সাহিত্যিক। একজন ব্যক্তি সৈয়দ হককে বাদ দিয়ে একজন কবি, গদ্যকার, প্রবন্ধকার, উপন্যাসিক এবং কাব্যনাট্যকারের সৃজনের সম্ভার নিয়ে কথা বলাই শ্রেয়। কাব্যনাট্যের ক্ষেত্রে যখন দেখি ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’, ‘গণনায়ক’, ‘নূরলদীনের সারাজীবন’, ‘এখানে এখন ঈর্ষা’, ‘অন্তর্গত’, ‘উত্তরবংশ’সহ আরও অনেক কাব্যনাট্যের রচিয়তা সৈয়দ শামসুল হক। কাব্যনাট্যের ক্ষেত্রে সৈয়দ হককে অদ্বিতীয় বললে কোন প্রকারের অত্ত্যুক্তি হবে না। কবি যখন লিখেন ‘এখনো স্পষ্ট দেখিÑ মনে পড়েÑ পাড়ের নক্শায়/ মায়ের শাড়ির পাড়ে হাঁস উড়ে যাচ্ছে পাখা মেলে,/ নিচে বহে যাচ্ছে নদী, তারপর বাড়ি’। উত্তরবংশ বহুমুখী এই প্রতিভাবান লেখক তাঁর কাব্যনাট্যে মুদ্রণ করেছেন আবহমান বাংলার চিত্রপট। যে চিত্রপটে মুখ ঘষে থাকি বার বার। কাব্যভাষাকে নাটকে রূপান্তিত করে নাটককে মোহময় করে তুলেছেন। সেই সঙ্গে এঁকেছেন বাংলার ইতিহাস। সংগ্রামের বাস্তবতার আলোকে তাঁর আরো একটি কাব্যনাট্য ‘অন্তর্গত’। বিমোহিত কাব্য বয়ানের এই নির্মাতা বাংলা ভাষাকে সৌন্দর্য দান করেছেন দু’হাত ভরে। ফসলী সম্ভারে পরিপূর্ণ সৈয়দ হকের লেখার গুণবিচারের সক্ষমতা, খুব কম ব্যক্তি রাখেন। তিনি বাংলা ভাষার পরিশুদ্ধ এবং দক্ষ একজন সাহিত্যিক। সৃজন সম্ভারে পরিপূর্ণ তাঁর গদ্য। নিখাঁদ শব্দের গাঁথুনিতে গল্প বলে যাওয়া সৈয়দ হকের রচনায় মন্ত্রমুগ্ধের মতো মুখ এঁটে পড়ে থাািক। বার বার পড়েও ক্লান্তিবোধ আসে না। কবিতায় তিনি একজন ইতিহাস নির্মাতা হিসেবে সমকালের সাহিত্যকে নেতৃত্ব দান করছেন। ‘ফিরে এসো বাংলাদেশ/ ফিরে এসো তোমার নদীর কাছে,/ তেরোশ নদীর জল যার আছে তার মতো কে আছে সচ্ছল?’/... ফিরে এসো বাংলাদেশ/ ফিরো এসো তুমি/ শিশিরে ভিজিয়ে পা,/ ঢেঁকির শব্দের দেশে’ ফিরে এসো বাংলাদেশ বাংলাদেশের রূপের বর্ণনা তিনি এভাবেই করেছেন কবিতায়। আকুলতার সঙ্গে বাংলাদেশের পুরনো ঐতিহ্যকে ধারণ করেছেন কাব্যমাধুর্য্যতায়। তাঁর কবিতায় বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি পাই। ‘খররৌদ্র, অনশনে বিপ্লবে প্লাবনে,/ সাপের আড়তে, নীল পাখির চিৎকার’ বৈশাখে রচিত পঙক্তিমালা উপর্যুক্ত কাব্যগ্রন্থে কবি সামগ্রিক বাস্তবতার চিত্র প্রতিস্থাপন করেছেন। শক্তিমান এই কবির কলমের কালি কখনো বয়সের ভারে ন্যুব্জ হয়নি। বরং বাংলাদেশের প্রত্যেকটি আন্দোলন-সংগ্রাম তাঁর লেখাকে সাক্ষী হিসেবে উপস্থাপন করেছেন অনাগত ভবিতব্যের দ্বারে। প্রবাসে দৈববাসের কবিতার একটি লাইন না তুলে ধরলে বোঝা যাবে না তিনি কত বড় সাহসী এক কবি। ‘বস্তুত যদি উদাহরণ টানি কবির সাথে নবীর’ প্রবাসের দৈববাসে একজন কবি কতটুকু সাহসী এবং সাহিত্যের প্রতি অন্তঃপ্রাণ হলে তাঁর উচ্চারণ এত সাহসী হতে পারে! ‘চক্ষু যে খাবল দিয়ে খায় সেই পাখি বসা আছে গাছে,/ অথচ খাড়ায়া থাকি, এক পা’ও কোথায় নড়ি না/ সকল কলস আমি কালঘাটে শূন্য দেইখাছি,/ তারে না দেইখাছি তাই দ্যাখনের চক্ষু দিতে রাজী’ ‘পরানের গহীন ভিতরে, সৈয়দ হক’ মানব জীবন ও জগতের অতলস্পর্শী এই কবির কবিতা অন্তর্নিহিত তাৎপর্য বহন করে। দিব্য দৃষ্টে ধরা দেয় একমাত্র বড় কবিদের ক্ষেত্রেই। চিন্তা মৌলিকতা, হৃদয়স্পর্শী রচনা তিনি সারাজীবন ভরেই লিখছেন। প্রকাশচিন্তা তাঁর অভিনবত্ব। শিল্পচাতুর্যতায় তিনি নান্দনিক। তিনি সব্যসাচী সৈয়দ শামসুল হক।
×