ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আলবার্ট মার্টিনের প্রেম

প্রকাশিত: ০৬:৫৪, ১৮ ডিসেম্বর ২০১৫

আলবার্ট মার্টিনের প্রেম

আলী বাকেরের জন্ম ১৯৩৬ সালে ভারতে। তিনি এখন লন্ডনের স্থায়ী বাসিন্দা। তার গল্পে পাশ্চাত্যের জীবনধারার প্রতিচ্ছবি থাকলেও প্রত্যেক গল্পে একজন ভারতীয় চরিত্র অবশ্যই থাকবে। এই চরিত্রটি গল্প বলে নতুবা গল্প সৃষ্টি করে। অক্সফোর্ডে সমাজবিজ্ঞানে লেখাপড়া করেছেন। পাশ্চাত্যের কয়েকটি দেশে অপরাধ এবং মানসিক বৈকল্যের রোগীর ওপর ব্যাপক গবেষণা করে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। কলকাতা থেকে মিসেস এন ব্যানার্জী আলবার্ট মার্টিনকে লিখেছে, সে এক সপ্তাহের জন্য অক্সফোর্ড আসছে, তার জন্য হোটেলের এমন একটি কামরার ব্যবস্থা করতে হবে, যার জানালা পার্কের দিকে খোলা থাকবে। আলবার্ট হোটেলে এমনি একটি কামরার ব্যবস্থা করেন। হোটেলটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান শাখা ভবনের পাশে, বামে একটি পার্ক। পার্কের ধারেই এই ছোট্ট ছিমছাম হোটেলটি অবস্থিত। প্রাচীন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে আলবার্টের লেখাপড়া শেষে আর কোন সম্পর্ক ছিল না কিন্তু শহরটি তার খুব পছন্দ। এর পুরনো সঙ্কীর্ণ রাস্তায় দিনরাত কালো গাউন পরে ছাত্রছাত্রীরা ঘোরাঘুরি করে আর উচ্চস্বরে আলাপচারিতায় মত্ত থাকে। আলবার্টের ভারতীয় ছাত্রছাত্রীদের অধিক ভাল লাগে। ভদ্র, বুদ্ধিমান, মার্জিত এবং তাদের ইংরেজী বলার বিশেষ স্টাইল। কয়েক বছর আগে ভারতের একটি ছোট্ট রাজ্যের নাওয়াবজাদা আলবার্টের হোটেলের সামনে পার্কে ক্রিকেট খেলত। সে অক্সফোর্ড দলের ক্যাপ্টেন ছিল। মাঝে মাঝে ভারতীয় এক সুন্দরী নায়িকাকে তার সঙ্গে দেখা যেত। মেয়েটি যখন হাসত তখন গালে টোল পড়ত, তখন তাকে আরও সুন্দর দেখাত। আলবার্টের মানসীর কথা খুব মনে পড়ে। মানসীর কাছ থেক তার বিচ্ছেদ হয়েছে, তাও অনেকদিন হয়েছে। মানসী যখন অক্সফোর্ডে পড়ত আর তখন আলবার্ট ছিল শহরের একটি বড় হোটেলের ম্যানেজার। সে পার্কে পায়চারী করতে গিয়ে প্রথম মানসীকে দেখেছে। মানসী সবুজ শাড়ি পরেছিল। তার দীর্ঘ লম্বা চুল বাতাসে উড়ছিল। মিউজিয়ামের সামনে ফুটপাথে আলবার্টের কয়েক গজ দূরে হাঁটছিল। মানসীর হাঁটা ও চালচলন দেখে সে মনে মনে খুব খুশি হলো। তার মনের আনন্দ যা ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব। আলবার্ট এগিয়ে গিয়ে সেই শ্যামলা মেয়েটিকে বলেই ফেলল, তোমাকে খুব খুশি মনে হচ্ছে, তোমাকে দেখেই প্রতিটি মৌসুম নতুন মনে হয়। অনেকবার চেষ্টা করেছে, আলবার্ট মানসীকে বলে দেবে, সে তাকে দারুণ ভালবাসে। কিন্তু মানসী তাকে ভালবাসা প্রকাশ করতে দিত না। জুন মাসের শেষে পরীক্ষার পর মানসী ভারতে ফিরে যাবে। অক্সফোর্ডের পুরনো রেল স্টেশনের প্ল্যাটফরমে দাঁড়িয়ে সে মানসীকে বিদায় জানাচ্ছে। মানসী কম্পার্টমেন্টের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে। আলবার্ট তাকে প্রথম যে পোশাকে দেখেছিল আজ মানসী সেই এই পোশাক পরেছে। ‘মানসী তোমাকে একটি কথা এখনও বলতে পারিনি।’ আলবার্ট মানসীর মুখের দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে বলল। মানসী তার লম্বা চুল পেছনে দিকে সরিয়ে নিয়ে বলল, ‘অনেক কথা না বললেও বুঝা যায়।’ আজও তার মাথার বেণী অপূর্ব দেখাচ্ছিল। আর সে ভাবে, ‘আলবার্ট বন্ধু আমার ....ভালবাসা আর সততা কোন সিগারেট বা সাবানের মতো নরম নয় তো যে, তাদের জন্য বড় বড় রঙিন পোস্টার তৈরি হবে। তুমি কি কখনও এ পর্যন্ত কোন বিজ্ঞাপন দেখেছ যে, গোলাপের সুগন্ধ খুবই ভাল।’ আলবার্ট-মানসীর এই প্রাচ্যের দর্শনের উত্তর খুঁজে পায়নি যে, ‘তুমি এখন চলে যাচ্ছো। তবে কোনদিন আর দেখা হবে না।’ মানসীর বিচ্ছেদ বেদনায় আলবার্ট খুব ব্যথিত। ‘এমনও হতে পারে আলবার্ট তুমি পার্কে যাও আর আমাকে স্মরণ করো না। হাল্কা রোদে ফুটন্ত ফুলের দিকে তাকাবে, তখন রাতের শিশিরভেজা গাছের পাতা দেখবে, যখন শুকনো পাতায় পার্কের মাঠ ঢাকা থাকবে, যখন সাদা বরফে গাছের ডালপালা আচ্ছাদিত থাকবে, তখন বুঝে নেবে, আমি তোমার অনেক নিকটে আছি আর তোমার সঙ্গে আলাপ করছি। ট্রেন ধীরে ধীরে এগিয়ে যায়। আলবার্টের হঠাৎ মনে হলো, এখন আর মানসীকে বিদায় জানানোর প্রয়োজন নেই। মানসী ফিরে যাচ্ছে না বরং অক্সফোর্ড তার কাছেই থাকবে। গির্জার ঘণ্টাধ্বনি শোনা যাবে। সূর্যের আলোতে মানসীর চেহারা ঝলঝল করবে। রাতের অন্ধকারে তার কালো চুলের বেণী মিশে যাবে। আসলে ভালবাসা মানুষকে সত্যিই বিশ্বজনীন সৌন্দর্যের পিপাসায় আবর্তিত করে। শহরের সড়কে, গলিতে, নদীর ধারে অথবা পার্কের উন্মুক্ত সবুজ মাঠে আলবার্ট একলা থাকলে তার নিঃসঙ্গ মনে হয় না। এত বছর পর কলকাতা থেকে আসা চিঠি পড়তে গিয়ে আলবার্ট অনুভব করল মিসেস এম ব্যানার্জী তার মানসী। আলবার্ট ভাবে, মানসীর হয়ত এতদিনে বিয়ে হয়ে গেছে এবং ছেলেমেয়ের মা হয়েছে। আলবার্ট মিসেস ব্যানার্জীর থাকার জন্য হোটেলে যাবতীয় বন্দোবস্ত করে। এমন কামরা বরাদ্দ করে যার জানালা পার্কের দিকে খোলা। আর মাত্র একদিন বাকি, মিসেস ব্যানার্জী অক্সফোর্ড এসে পৌঁছবে। তার নামে ইতোমধ্যে একটি চিঠিও এসেছে। আলবার্টের অস্থিরতা বাড়তে থাকে। রাতে সে মিসেস ব্যানার্জীর আসা চিঠি খুলে পড়ে ফেলে। চিঠিটি মিসেস ব্যানার্জীকে তার স্বামী লিখেছে। চিঠির প্রতিটি ছত্রে প্রেম ও ভালবাসার বাণীতে সিক্ত। জীবনে সর্ব প্রথম আলবার্ট ভালবাসার প্রতি অনুরাগের আবেগ দারুণভাবে অনুভব করে। মানসীকে তার স্বামী কেমন ভালবাসে। চিঠি পড়ে মনে হলো, মানসী আগের মতোই সুন্দরী আছে। তার চুল, চোখ, তার হাসির বর্ণনা মানসীর স্বামী এমনভাবে দিয়েছে যেভাবে আলবার্ট একদা তাকে নিয়ে ভাবত, কল্পনা করত। যেদিন সকালে মিসেস ব্যানার্জী আসার কথা, আলবার্ট সারা হোটেল ফুল দিয়ে সাজিয়েছে। কারণ সে দিন তার প্রিয়তমা মানসীর সঙ্গে তার দেখা হবে। তার সঙ্গে পার্কে বেড়াতে যাবে। মানসী এখনও পার্কের কথা ভোলেনি। সকাল ১১টায় একটি ট্যাক্সি হোটেলের সামনে এসে হাজির হয়। শুধু সবুজ রঙের শাড়ির আঁচল তার নজরে পড়েছে। আলবার্টের বুক ধড়ফড় করছিল, দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম। আবেগের তাড়নায় আলবার্টের নীল চোখে অশ্রু দেখা দেয়। সে রুমালে চোখ মুছে নেয়। ‘মাফ করবেন, আমার নাম মিসেস ব্যানার্জী। মিসেস এম ব্যানার্জী। আপনার হোটেলে আমার একটি কামরা রিভার্জ আছে।’ ভারতীয় উচ্চারণে হিন্দী ভাষায় মহিলা তার কাছে জানতে চায়। আলবার্ট পেছনে ফিরে তাকায়। ভদ্র মহিলা কিন্তু তার সেই মানসী নয়। মহিলার উচ্চতা মানসী থেকে খাটো। চোখগুলো ছোট ছোট। দেহের রং মোটামুটি। গড়ন তেমন আকর্ষণীয় নয়। আলবার্ট পেছনে ফিরে তাকায় আর কামরার চাবি ভদ্র মহিলার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, আপনার কামরা দোতলায়, কামরা থেকে পুরো পার্ক দেখা যায়। আপনার নামে একটি চিঠিও এসেছে। নিশ্চয় আপনার স্বামীর চিঠি। জানি না, আপনার অনুপস্থিতিতে এতদিন তার কিভাবে কাটবে। মিসেস ব্যানার্জীর আওয়াজ মানসীর মতো মিষ্টি ছিল না। ভদ্র মহিলা যখন সিঁড়ি বেয়ে হোটেলের দোতলায় যাচ্ছে, তখন আলবার্ট ভাবছে, একজন ভদ্র মহিলা স্বামীর চোখে মানসীর মতো সুন্দরী কিভাবে হয়ে ওঠে তা সে বুঝতে পারে না।
×