ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বাজিতপুর মুক্ত করার স্মৃতিচারণ করলেন মুক্তিযোদ্ধা আবু শামা

গ্রেনেড ছুড়ে পাক সেনাদের বাঙ্কার গুঁড়িয়ে দেই

প্রকাশিত: ০৬:৩৮, ১৮ ডিসেম্বর ২০১৫

গ্রেনেড ছুড়ে পাক সেনাদের বাঙ্কার গুঁড়িয়ে দেই

রাজন ভট্টাচার্য ॥ ‘কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর থানাটি ওই অঞ্চলের সদর দফতর হিসেবে ব্যবহার করত পাক-সেনারা। এখানে মুক্তিযোদ্ধাসহ মুক্তিকামী মানুষদের ধরে এনে চালাত নির্মম নির্যাতন। ১৯৭১ সালের ২৭ অক্টোবর আমরা থানায় হামলা করার পরিকল্পনা করি। পাকিস্তানীদের বাঙ্কারে গ্রেনেড ছুড়ে মারার দায়িত্ব দেয়া হয় আমাকে। মুহূর্তের মধ্যে লক্ষ্য ঠিক করে তা গুঁড়িয়ে দিলাম। বাঙ্কারে থাকা সবকটা পাক সেনা মারা গেল। কিন্তু পাশের একতলা ছাদের ওপর আমপাতা দিয়ে ঘেরা আরেকটি বাঙ্কার থেকে আমার মাথায় গুলি করে পাকিস্তানী সেনারা। হেলমেট থাকায় গুলি লাগেনি। এক পর্যায়ে একটি বুলেট এসে লাগে বুকের ডানপাশে। মাটিতে লুটিয়ে পড়ি। তখন মর্টারের গোলা দিয়ে সুবেদার বজলুর রহমান ছাদের ওপরে থাকা বাঙ্কারটি গুঁড়িয়ে দেন। জীবন বাজি রেখে সেদিনের সম্মুখ যুদ্ধে ১৭ পাক সেনাসহ দেশীয় প্রায় ৭০ জন রাজাকার নিহত হয়। তখন প্রায় দেড় শতাধিক রাজাকার এই ক্যাম্পে ছিল। বাকিরা পালিয়ে যায়। এই যুদ্ধের মধ্য দিয়ে সরারচর ও বাজিতপুর শত্রুমুক্ত হয়। এরপর এই এলাকায় আর কখনই পাক সেনারা প্রবেশ করতে পারেনি’। এভাবেই মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করছিলেন যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ আবু শামা। জনকণ্ঠের সঙ্গে দীর্ঘ আলাপচারিতায় যুদ্ধদিনের কথা তুলে ধরেন এই পুলিশ যোদ্ধা। দেশ মাতৃকার টানে যিনি নয়মাস লড়েছেন পাক সেনাদের বিরুদ্ধে। চষে বেড়িয়েছেন গ্রামের পর গ্রাম। নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বহুবার। তবুও অদম্য সাহস নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছেন পাক সেনাদের বিরুদ্ধে। গুলি লাগার পর নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নেই ॥ তিনি জানান, যুদ্ধে গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর সহযোদ্ধা হাবিলদার ইদ্রিস মিয়া, নায়েক আবদুল হাই এবং অধ্যাপক ইয়াকুব মিয়া আমাকে উদ্ধার করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। আমরা নিরাপদ স্থানে গিয়ে আশ্রয় নেই। খবর পেয়ে বাজিতপুর থানার দৌলতপুর গ্রামে আমাকে দেখতে যান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠন ও প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান। তিনি ডাক্তারদের বলেন, যে কোন মূল্যে আমাকে বাঁচাতে। উন্নত চিকিৎসা দিয়ে দ্রুত সারিয়ে তুলতে। তাঁর কথাগুলো এখনও মনে পড়ে। ১৬ ডিসেম্বরের পর তিনি আবারও আমাকে দেখতে চান। বিজয়ের পর বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে কিশোরগঞ্জের জেলা প্রশাসক জি আকবর খানের হাতে অস্ত্র জমা দেই। ফিরে আসি রাজারবাগ পুলিশ লাইনে। তখন পুলিশ কর্মকর্তারা আমার বুকে ও হাতে ব্যান্ডেজ দেখতে পান। তাদের নির্দেশে আমাকে রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে ছয়মাস চিকিৎসা করানো হয়। ২৫ মার্চ কালো রাত্রির গল্প ॥ মুক্তিযুদ্ধের সময় আবু শামা ঢাকার রাজারবাগ পুলিশ লাইনে কনস্টেবল হিসেবে অস্ত্রাগারের দায়িত্বে ছিলেন। তিনি জানান, ২৫ মার্চ কালো রাত্রির প্রায় এক সপ্তাহ আগে থেকেই বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা থেকে শুরু করে নানা মাধ্যমে রাজারবাগ পুলিশ লাইন আক্রমণের খবর আসছিল। যে কোন সময় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী হামলা করতে পারে। এমন আশঙ্কা থেকেই গোপনে গোপনে প্রতিরোধের চিন্তা। কিন্তু তখনকার রাজারবাগে কর্মরত পুলিশ অফিসারদের অনেকেই ছিলেন পাকিস্তানের অনুগত। যে কারণে কর্মকর্তাদের কাছ থেকে প্রতিরোধের সহায়তা মেলেনি। তাই কয়েকজন কনস্টেবল মিলে পাকিস্তানী সেনাদের প্রতিহত করার পরিকল্পনা নেই। বঙ্গবন্ধুর সাত মার্চের ভাষণই ছিল আমাদের প্রতিরোধের মূল প্রেরণা। তিনি জানান, কালো রাত্রিতে রাজারবাগ হামলা শুরু করে পাকিস্তানী সেনারা। কনস্টেবল মফিজের কাছ থেকে চাবি ছিনিয়ে এনে একটি অস্ত্রাগার খুলে দেই। অপরটি গুলি চালিয়ে ব্যর্থ হয়ে শাবল দিয়ে ভেঙ্গে ফেলি। যে যার মতো করে অস্ত্র নিয়ে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ল। আমিসহ কয়েকজন রাজারবাগের মূল ভবন চার তলার ছাদে অবস্থান নেই। ২৮ মার্চ মুক্তি ॥ ২৫ মার্চ রাতের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, সাড়ে তিনটার দিকে আমাদের সঙ্গে থাকা গুলি শেষ হয়ে যায়। ছাদের ওপর ট্যাঙ্কের পাশে সহকর্মী শাজাহান ভাই, গিয়াসউদ্দিন, আবদুল হালিমসহ কয়েকজন লুকিয়ে থাকি। পাক সেনারা আমাদের খুঁজে বের করে ইস্ট পাকিস্তান পুলিশ (ইপিপি) ব্যাচ খুলে নির্মম নির্যাতন চালায়। রিজার্ভ অফিসের পাশে দ্বিতীয় তলায় প্রায় দেড় শতাধিক পুলিশ সদস্যকে তালাবদ্ধ করে বাইরে প্রহরা বসিয়ে রাখে। ২৮ মার্চ বিকেলে তৎকালীন ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার ইএ চৌধুরী পাকিস্তানী সেনাদের সঙ্গে কথা বলে আমাদের মুক্ত করেন। মুক্তদের মধ্যে একটি অংশ গে-ারিয়া পুলিশের মিল ব্যারাকে যান অপর অংশের পুলিশ সদস্যদের আগামী দিন থেকে রাজারবাগে এসে পাক সেনাদের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে বলা হয়। আমরা কয়েকজন মিল ব্যারাকে না গিয়ে গে-ারিয়ার আশপাশের গ্রামে পালিয়ে যাই। গ্রামবাসী আমাদের চিকিৎসা ও খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করেন। তাদের সহযোগিতার কথা এখনও মনে পড়ে। সেখান থেকে প্রায় ছয়দিন পায়ে হেঁটে কিশোরগঞ্জ জেলার বাজিতপুর উপজেলার পীরপুর গ্রামের নিজ বাড়িতে যান শামা। এর আগেই খবর রটে রাজারবাগের কোন পুলিশ সদস্য বেঁচে নেই। তিনি বলেন, বাড়ি পৌঁছানোর পর আমাকে দেখে পরিবারের সদস্য থেকে শুরু করে গ্রামবাসী কাঁদতে থাকেন। তাদের চোখে মুখে খুশির শেষ ছিল না। তারপর বুকে আরও সাহস জমে। মুক্তিযুদ্ধে যাব ঠিক করি। হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াব। দেশ মাতৃকার টান আর লাল-সবুজ পতাকা ছিনিয়ে আনতে অংশ নেন মুক্তিযুদ্ধে। এপ্রিলের শুরুর দিকে অনারারী ক্যাপ্টেন অব. সুবেদার মেজর নূরুল আজিম চৌধুরী ও সুবেদার বজলুর রহমানের নেতৃত্বে তিন নম্বর সেক্টরের অধীনে যুদ্ধে নামেন তিনি। আমার জন্য বাবাকে অত্যাচার করেছিল পাক সেনারা ॥ যুদ্ধে যাবার অপরাধে তিনবার আমাদের বাড়িসহ পুরো গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া হয়। বাবাকে বারবার নির্যাতন করে পাক সেনা ও দেশীয় কিছু রাজাকার। এরপর আর কথা বলতে পারছিলেন না যুদ্ধাহত এই বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু শামা। ডুকরে কাঁদছিলেন তিনি। বারবার যেন শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল। বাবা মোঃ আঃ রশিদ ভূঞাকে নির্যাতন করায় সবচেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছেন। এতোটা কষ্ট, যা জীবনে কখনই পাননি তিনি। তাই মন থেকে এক মুহূর্তের জন্যও সেই স্মৃতি সরাতে পারছেন না। যতোটা কষ্ট পাননি নিজের বুকে বুলেট লাগার পরও। অনেক কষ্টে সেদিনের ঘটনা জানালেন। বলেন, যুদ্ধে যাবার পর আমার সন্ধান চালাচ্ছিল পাক সেনাসহ রাজাকাররা। একদিন দেশীয় এক রাজাকার পাক সেনাদের দেখিয়ে দিল আমার বাবাকে। বলল এই ব্যক্তি শামার বাবা। ওরা বাবার কাছে আমার সন্ধ্যান চায়। বাবা বলেন, জানি না। এরপর শুরু হয় বর্বর নির্যাতন। উন্নত চিকিৎসা প্রয়োজন মুক্তিযোদ্ধা শামার ॥ ৬৫ বছর বয়সে অসুস্থতার কাছে অনেকটাই হারতে বসেছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা শামা। ডায়াবেটিসে আক্রান্তের খবর জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, জটিল অনেক ব্যাধি শরীরে বাসা বেঁধেছে। দুটি চোখও আক্রান্ত। ভাল দেখি না। দুটো কিডনি এখন বিকল হওয়ার পথে। তিনি বললেন এই মুহূর্তে আমার উন্নত চিকিৎসা জরুরী। কিন্তু চিকিৎসা করানোর সাধ্য নেই তাঁর। উন্নত চিকিৎসার জন্য সরকার এগিয়ে আসলেই হয়ত এই বীর মুক্তিযোদ্ধা আরও কিছুদিন বেঁচে থাকবেন।
×