ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

অপূর্ব কুমার কুণ্ডু

কাব্য নাটক প্রেমপত্র

প্রকাশিত: ০৭:৪০, ১৭ ডিসেম্বর ২০১৫

কাব্য নাটক প্রেমপত্র

তিন বাক্যে তিনশ’ বাক্যের মানে, চরিত্রের বিস্তার না ঘটিয়ে নিজের মধ্যে দিয়ে অভিব্যক্তি প্রকাশের দায়ভার আর আগাম ভবিষ্যতের কথা যিনি বলেন তিনি অন্যতম দক্ষ কবি। তীব্র অভিঘাত থাকে তার কাব্যে। অনেকটা সেভাবে একটা নাটকের মঞ্চায়ন যদি স্বল্প সময়ে অধিক কথা বলতে পারে, অসংখ্য চরিত্র ছাড়াই এক কিংবা দুই চরিত্রের মধ্যে দিয়ে নাট্যকারের মরমী বক্তব্য যদি প্রকাশ পায় আর ভবিষ্যৎ সঙ্কটের আগাম যদি ন্যূনতম একটা সমাধান ঘটে তবে তাকে সাহিত্যের আদলে বলা চলে মঞ্চায়নের কাব্য কিংবা মঞ্চকাব্য। অনেকটা সেরকম মঞ্চকাব্য নাটক প্রেমপত্র। ভৈকম মুহম্মদ বশীরের গল্প অবলম্বনে, নাট্যকার শ্যামল ভট্টচার্যের নাট্যরূপে, সেলিম রেজা সেন্টু ভাবিত ও প্রয়োগকৃত, প্রাকৃতজন প্রযোজিত নাটক প্রেমপত্র মঞ্চস্থ হলো গত ১১ ডিসেম্বর শিল্পকলা একাডেমির স্টুডিও হলে। ইমেইল আর এমএস এসের আধুনিক সংযোগ সময়ে হাতে লেখা একটি পত্রের মধ্যে দিয়ে একটি ব্যাকুল হৃদয়ের আর্তি আর নাট্যাবসানে দুটি হৃদয়ের মিলনের অভিব্যক্তির নাটক প্রেমপত্র। প্রেমপত্রতো দূরের কথা ঘৃণা-প্রেম-বিদ্বেষ কোন ক্যাটাগরির পত্র আদৌ হয় কিনা সেটা ভেবেই লেখা পত্র কেটে কুটি কুটি করে চলে ব্যাংকের কেরানী অথচ নিরীহ প্রেমিক বয়সে যুবক রিচার্ড। তার প্রেম তথা আরধ্য দেবী বাড়ির মালিক কন্যা ব্যক্তিত্ব সম্পূর্ণ তটিনী। তটিনীর ব্যক্তিত্বের দৃঢ়তা আর রিচার্ডের মানষিক ভংগুরতার মাঝে প্রেমপত্র প্রেমের প্রকাশ ঘটালেও তটিনীর তাচ্ছিল্যে রিচার্ডের প্রেম গন্তব্যহীন। গন্তব্যে পৌঁছানোর সুযোগ আসে, সৎমায়ের অত্যাচারে নিষ্পেষিত তটিনীর জন্য একটি চাকরি খোঁজার সুযোগ রিচার্ড পেলে। কর্পোরেট হাউসে চাকরি জোটে না ঠিকই তবে রিচার্ড-তটিনী নিজেরাই নিজেদের মতো দেখা-শোনাটাকেই একটা চাকরি হিসেবে মেনে নেয়। পাঁচ মাসের ব্যবধানে রিচার্ডের চাকরির বদলি ঘটলে তটিনীর যাবার প্রশ্নে সংশয় তৈরি হলে রিচার্ডের আকুলতায় তটিনী সাড়া না দিয়ে পারে না। পারস্পরিক আচার, রুচি এবং বিশ্বাসকে অক্ষণœ রেখে দুটি আকুল হৃদয়ের ব্যাকুলতার অবসানের মধ্যে দিয়ে যুগল জীবন এগিয়ে চলে প্রেমপত্রের কাব্য ডানায় ভেসে ভেসে। নাট্যকারদের নাটকে নাটকীয়তা অপেক্ষা স্লোগানধর্মিতা আর ইমপ্রোভাইজেশনের বাড়বাড়ন্ত সময়ে শ্যামল ভট্টাচার্যের নাটকে শব্দের চাতুরি নেই আছে সংলাপের সুরময়তা আর মূল্যবোধের সম্মাননা। প্রেমপত্রের লেখনী দিয়ে যে নাটকের শুরু সে নাটক জীবন পথের অসংখ্য অলি গলি ঘুরে পুনঃরায় প্রেমপত্রের লেখনীর মধ্যে দিয়ে জীবনের রাজপথে ওঠে সেটাই নাট্যকারের শৈল্পিক দক্ষতা। দক্ষতা ছিল বলেই সেলিম রেজা সেন্টু একটা দীর্ঘ সময়জুড়ে দুই বাংলার থিয়েটার পত্রিকা সম্পাদনা করেছন। চৌকষ বুদ্ধি আছে বলেই কর্পোরেট মিডিয়া ব্যক্তিদের গল্পের নাট্যরূপ দিতে তার গভীর ভালবাসা। দোদুল্যমানতা আছে বলেই সম্মানী ব্যক্তিদের সম্মাননা দেয়ার কথা বলে হঠাৎ নিরুদ্দেশ। তথাপি তার জীবনের প্রস্তুতি এবং প্রয়োগ নাটকের অঙ্গনকে ঘিরে। ফলে সারা নাটকজুড়ে তিনি রিচার্ড হয়ে ইনিয়ে বিনিয়ে তটিনীকে ভালবাসার কথা বলতে যেয়েও দীর্ঘ সময় বলতে পারে না কিংবা যখন বলে তখন প্রায় হাইপার টেনশনে মরণদশা। তথাপি সেলিম রেজা সেন্টু রুপি রিচার্ড যে তটিনীকে ভালবাসে এটা তো নির্মম বাস্তবতা। কত সাধারণ আয়োজনে বিশালের উপস্থাপন যে করা চলে তা তিনি করেছেন। ফয়েজ জহিরের মঞ্চে ঘর বাহির বোঝা যায়। তটিনীর পোশাকের উজ্জ্বলতা ফোটাতে সঙ্গতিপূর্ণ তার আলোও রোমান্সের আবহ আনে। রাফায়েল আহসানের পোশাক পরিকল্পনায় প্রেম আছে, আধুনিকতা আছে আবার অতি বাড়াবাড়ি নেই। ‘মাঝে মাঝে তব দেখা পাই...’ গানের প্রয়োগ রাফায়েল আহসানের দূরদৃষ্টির প্রয়োগ। ধ্রুব এষের নামাঙ্কনে প্রেমের ধ্রুপদী ভাব এবং পত্রের নস্টালজিয়া যুগপৎ ঘটে। ঘটাবার বেশিকিছু করার ছিল না সূত্রধর চরিত্রে রাফায়েল আহসান ও ফরহাদ হোসেনের অভিনয়ে। তথাপি তারা যে সংভংচং না করে সর্বচ্চো মনোযোগ দিয়েছে প্রক্ষিপ্ত সংলাপের রসাস্বাদনে এখানেই সাধুবাদ। সাধুবাদ, টিকিট বিক্রি থেকে আরম্ভ করে পোস্ট প্রডাকশানের সর্বদিকে খেয়াল রেখেও রিচার্ড চরিত্রে অভিনেতা সেলিম রেজা সেন্টুর অভিনয় নিমগ্নতা দেখে। চতুর না কিন্তু বুদ্ধিদীপ্ত বোকামী, কর্পোরেট না কিন্তু রুচিশীল জীবন যাপন, কামুক না কিন্তু ব্যাকুলতার পিয়াসী, দাম্ভিক না কিন্তু আত্মভিমানী, ডক্টরেট না কিন্তু জীবন বোধের অধিকারী, দেবদাস না কিন্তু প্রেমে অবিচল প্রভৃতি রিচার্ডের বৈশিষ্ট ফুটিয়ে তোলায় অভিনেতা সেলিম রেজা সেন্টু অনবদ্য-নান্দনিক এবং মাত্রা নিয়ন্ত্রিত। মাত্রা নিয়ন্ত্রিত কিন্তু মাত্রা পরিমাপে কুয়াশা ও ধোয়াশায় ফেলে পুরো নাটকটাকে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সুতার দড়ির উপর দিয়ে হেঁটে চলবার মতো টান টান রাখায় তটিনী চরিত্রে বিস্ময় কর অভিনয় অভিনেত্রী ফারজানা করিমের। ম্যাজিশিয়ানের খেলা মিথ্যা কিন্তু ম্যাজিশিয়ান সত্য যেমন তেমনি অবস্থান ফারজানা করিমের। অভিনেত্রী ফারজানা করিম রুপি তটিনী ব্যাকুলতাকে আড়াল করছেন তাচ্ছিল্যতা দিয়ে, আগমনকে প্রতিষ্ঠা দিচ্ছেন ধাক্কা দিয়ে, চাকরির প্রার্থী হচ্ছেনÑ চাকরির দাতাকে কাজ পাইয়ে দিয়ে, দূরে ঠেলে দিচ্ছেন স্পর্শানুভূতির আবেদন বজিয়ে রেখে, বিবাদীর হয়ে জেরা করছেন বিচারপতির আসল অলঙ্কৃত করে, বোল্ড আউট করছেন ব্যাটসম্যান হয়ে, নরম হৃদয়কে আবৃত রাখছেন নিজস্ব ব্যক্তিত্বর স্পর্শে, আত্মসমর্পণ করছেন আত্মসম্মানের ঝরনা তলে। অভিনেত্রী ফারজানা করিমের মঞ্চ উপস্থিতি যেন মঞ্চাভিনেত্রীদের বঞ্চনার বিপরীতে বিদ্রোহীর প্রতিভুরূপে। বাদ-বিবাদের বিপরীতে আত্মায় উপলব্দির নাটক প্রেমপত্র।
×