চলচ্চিত্র এমন এক গণমাধ্যম, যেখানে দেশের মানুষের চিন্তাচেতনা, আশা-আকাক্সক্ষা আর জীবনবোধের প্রতিফলন হয়। বাঙালীর হাজার বছরের শ্রেষ্ঠকীর্তি মুক্তিযুদ্ধ তাই স্বাভাবিকভাবেই এ দেশের চলচ্চিত্রে উঠে আসার কথা। কিন্তু হাতেগোনা কয়েকটি ছাড়া আমাদের চলচ্চিত্রে মুক্তিযুদ্ধের উজ্জ্বল প্রতিফলন নেই। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, গত চল্লিশ বছরে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে চল্লিশটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয়নি। অবশ্য প্রামাণ্যচিত্র এই হিসাবের বাইরে রাখা হয়েছে। আবার গর্ব করার মতো বিষয় হলো, মুক্তিযুদ্ধ শুরু“হওয়ার আগেই এ দেশে স্বাধীনতার ইঙ্গিত নিয়ে চলচ্চিত্র তৈরি করা হয়েছে। তাই মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র নিয়ে একদিকে যেমন আক্ষেপ আছে, অন্যদিকে আছে অহঙ্কার। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের পর এ দেশের কিংবদন্তি চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান প্রতীকীভাবে নির্মাণ করেন ‘জীবন থেকে নেয়া’ ১৯৭০ সালে নির্মিত ফখরুল আলম পরিচালিত ‘জয়বাংলা’ নামের ছবিটি পাকিস্তানী সেন্সর বোর্ড আটকে রাখে। ১৯৭২ সালে এটি মুক্তি পায়। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের প্রস্ততিপর্বের এ দুটো ফিচার ফিল্মের নাম তাই উল্লেখ করতেই হয়। স্বাধীনতা অর্জনের পর সদ্য মুক্তিযুদ্ধ ফেরত টগবগে তরুণদের মাধ্যমেই বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র নির্মাণ সূচিত হয়। স্বাধীনতার পর মুক্তিযুদ্ধের অবিস্মরণীয় দিনলিপি সেলুলয়েডের ফিতায় বন্দী করার ভাবনা নিয়ে কাজ শুরু“করেন বেশ ক’জন নির্মাতা। মুক্তি পায় মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক প্রথম চলচ্চিত্র চাষী নজরুল ইসলাম পরিচালিত ‘ওরা ১১ জন’। এ ছবির সিংহভাগ কলাকুশলী ও অভিনয়শিল্পী ছিলেন সরাসরি রণাঙ্গনে লড়াই করা মুক্তিসেনা। ১৯৭১ সালে ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন সেই ঐতিহাসিক ভাষণটির কিছু অংশ এই ছবিটিতে দেখানো হয়েছিল। ১৯৭২ সালে মুক্তি পাওয়া এই চলচ্চিত্রের গল্পে ১১ জন মুক্তিযোদ্ধার অদম্য সাহসিকতা ও দেশমাতৃকার জন্য জীবনপণ লড়াইয়ের চিত্র তুলে ধরা হয়, ছবিটির প্রযোজনা করেন মাসুদ পারভেজ, কাহিনী আল মাসুদ।
একই সালে সুভাষ দত্ত নির্মাণ করলেন, ‘অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’। ববিতা অভিনীত সর্বপ্রথম পুরস্কারপ্রাপ্ত ছবি। ছবিটির শূটিং হয়েছে ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টে। ছবিটিতে সামরিক যানবাহন থেকে শুরু করে হেলিকপ্টার পর্যন্ত ব্যবহার করা হয়েছে। কুমিল্লা সেনানিবাসে গিয়ে পরিত্যক্ত এমন একটি ক্যাম্প খুঁজে পেয়েছিলেন যে ক্যাম্পে মুক্তিযুদ্ধের সময় নারীদের ধরে এনে আটকে রেখে নির্যাতন করা হতো। সেই ক্যাম্প থেকেই মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি নিয়েই শূটিংয়ের যাত্রা শুরু করেছিলেন। ১৯৭৩ সলে প্রয়াত চলচ্চিত্রকার আলমগীর কবির নির্মাণ করেন ‘ধীরে বহে মেঘনা’। এতে চলচ্চিত্রকার কাহিনীর সঙ্গে মিল রেখে মুক্তিযুদ্ধের ফুটেজ সরাসরি সার্থকতার সঙ্গে ব্যবহার করেন। একই বছর আরও কিছু মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ছবি হয়েছে। এর মধ্যে আছে খান আতাউর রহমানের ‘আবার তোরা মানুষ হ’, কবীর আনোয়ারের ‘সেøাগান’, আলমগীর কুমকুমের ‘আমার জন্মভূমি’ প্রভৃতি। ১৯৭৪ সালে নারায়ণ ঘোষ মিতা পরিচালিত চলচ্চিত্র ‘আলোর মিছিল। রাজ্জাক-সুজাতা অভিনীত পুরস্কারপ্রাপ্ত ছবি এটি। এ ছবিতে পার্শ্ব চরিত্রে অভিনয় করেন ববিতা। ’৭৪-এর আরও ছবির মধ্যে রয়েছে, মোহাম্মদ আলী পরিচালিত ‘বাংলার ২৪ বছর’, আনন্দ পরিচালিত ‘কার হাসি কে হাসে’। তারপর লম্বা বিরতি।
আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে আমাদের চলচ্চিত্রের অধঃপতন শুরু হয়, যা অব্যাহত থাকে পুরো নব্বই দশক পর্যন্ত। এ সময়টার মাঝেই বিকল্পধারা হিসেবে স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র বলিষ্ঠ হয়ে উঠে। স্বল্পদৈর্ঘ্যরে ছবিতে মুক্তিযুদ্ধ আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রাধান্য ছিল বরাবরই। মোরশেদুল ইসলামের ‘আগামী’, তানভীর মোকাম্মেলের ‘হুলিয়া’ ও ‘নদীর নাম মধুমতি’, নাসিরউদ্দিন ইউসুফের ‘একাত্তরের যীশু’, মোস্তফা কামালের ‘প্রত্যাবর্তন’, আবু সাইয়ীদের ‘ধূসর যাত্রা’ প্রভৃতি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক স্বল্পদৈর্ঘ্যরে আলোচিত ছবি। তানভীর মোকাম্মেলের ‘চিত্রা নদীর পাড়ে’ ছবিটিতেও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তুলে ধরা হয়। একাত্তরে মার্কিন সাংবাদিক লিয়ার লেভিনের ধারণ করা ফুটেজ নিয়ে প্রয়াত চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ ও ক্যাথরিন মাসুদ নির্মাণ করেন প্রামাণ্য ছবি ‘মুক্তির গান’। সামান্য কিছু অংশ বাদে এ ছবির সব দৃশ্যই প্রামাণ্য বলে এই ছবিটিতেই একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক ভিত্তি নির্মাণ করে। দেশজুড়ে এটি প্রশংসিত হয়। দেশের নাগরিক জীবনে প্রামাণ্য ছবি ‘মুক্তির গান’ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধকে ফিরিয়ে আনতে জোরালো ভূমিকা পালন করে।
প্রায় কাছাকাছি সময়ে কয়েকটি শিশুতোষ মুক্তিযুদ্ধের ছবি নির্মিত হয়। যার মধ্যে দেবাশীষ সরকারের ‘শোভনের একাত্তর’, রফিকুল বারী চৌধুরীর ‘বাংলা মায়ের দামাল ছেলে’, জাঁ-নেসার ওসমানের ‘দুর্জয়’, হারুনুর রশীদের ‘আমরা তোমাদের ভুলব না’, বাদল রহমানের ‘ছানা ও মুক্তিযুদ্ধ’, ছটকু আহমেদের ‘মুক্তিযুদ্ধ ও জীবন’, মান্নান হীরার ‘একাত্তরের রঙপেন্সিল’ উল্লেখযোগ্য।
১৯৯৪ সালে কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ এগিয়ে আসেন মুক্তিযুদ্ধের ছবি নির্মাণে। নিজের লেখা উপন্যাস অবলম্বনে তার পরিচালনায় নির্মিত প্রথম ছবি ‘আগুনের পরশমণি’। ১৯৯৮ সালে নির্মিত হুমায়ূন আহমেদের দ্বিতীয় ছবি ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ পুরোপুরি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক না হলেও এতে মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গ এসেছে। কথাশিল্পী সেলিনা হোসেনের উপন্যাস অবলম্বনে চাষী নজরুল ইসলাম ১৯৯৮ সালে নির্মাণ করেন আরেকটি মুক্তিযুদ্ধের ছবি ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’। ২০০২ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত প্রয়াত চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ নির্মিত ‘মাটির ময়না’ ছবিটিও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় নির্মিত একটি উল্লেখযোগ্য ছবি।
পরিচালক চাষী নজরুল ইসলাম ২০০৪ সালে কথাসাহিত্যিক রাবেয়া খাতুনের উপন্যাস অবলম্বনে তৈরি করেন ছবি ‘মেঘের পর মেঘ’। ২০০৪ সালে আরও দুটো উল্লেখযোগ্য মুক্তিযুদ্ধের ছবি নির্মিত হয়। কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ তৈরি করেন ‘শ্যামলছায়া’ এবং অভিনেতা তৌকীর আহমেদ নির্মাণ করেন ‘জয়যাত্রা’। দুটো ছবিতেই মুক্তিযুদ্ধের খ- খ- চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। ২০০৯ সালে মুক্তি পাওয়া তানভীর মোকাম্মেলের ‘রাবেয়া’ মুক্তিযুদ্ধের আরেকটি উল্লেখযোগ্য ছবি। কারিগরি ও শৈল্পিক দিক থেকে এসব ছবির মান আগেরগুলোর তুলনায় উন্নত হলেও স্বীকার করতে হবে যে, এই চলচ্চিত্রগুলোর কোনটিই দেশের প্রকৃত চলচ্চিত্র দর্শকদের কাছে পৌঁছতে পারেনি। আবার কয়েক বছর বিরতির পর চলতি বছর মুক্তিযোদ্ধা নির্মাতা নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু ‘গেরিলা’ নামে মুক্তিযুদ্ধের ছবির কাজ শুরু করেন। সৈয়দ শামসুল হকের ‘নিষিদ্ধ লোবান’ উপন্যাস অবলম্বনে এ ছবির চিত্রায়ন করেন, একইভাবে মুহম্মদ জাফর ইকবালের উপন্যাস অবলম্বনে মোরশেদুল ইসলাম নির্মিত করেন মুক্তিযুদ্ধের ছবি ‘আমার বন্ধু রাশেদ’ এবং অন্যটি হলো তরুণ পরিচালক রুবাইয়াত হোসেন নির্মিত ‘মেহেরজান’। খালিদ মাহমুদ মিঠুর পরিচালিত ‘গহীনে শব্দ’। যুদ্ধপরবর্তী সময়ে একজন মুক্তিযোদ্ধা ভিক্ষুককে নিয়ে এর গল্প। ছবিতে মুক্তিযোদ্ধার চরিত্রে অভিনয় করেছেন মাসুম আজিজ, সোহেল আরমান পরিচালিত ‘এই তো প্রেম, ইলাজার ইসলাম পরিচালিত ‘দীপ নেভার আগে’। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের এক মহাকাব্য। এই কাব্যের খলিত চিত্রই এখন পর্যন্ত নির্মিত ছবিগুলোতে ফুটে উঠেছে। তবে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে একটি মহৎ চলচ্চিত্র দেখার প্রত্যাশায় আজও প্রহর গুনছেন দেশের মানুষ। কিন্তু যে হারে মুক্তিযুদ্ধের ছবি নির্মাণ কমে যাচ্ছে, তাতে আগামী বছরগুলোতে কয়টি মুক্তিযুদ্ধের ছবি পাওয়া যাবে তা নিয়ে সন্দেহ রয়েই যায়।
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: