ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

অভয় বাণী বিজয় উৎসব

জয় হোক জয় হোক শান্তির জয় হোক, সাম্যের জয় হোক

প্রকাশিত: ০৫:৩৮, ১৭ ডিসেম্বর ২০১৫

জয় হোক জয় হোক শান্তির জয় হোক, সাম্যের জয় হোক

মোরসালিন মিজান বড় বড় লোকেদের ভিড়ে জ্ঞানী আর গুণীদের আসরে/তোমাদের কথা কেউ কবে না/তবু এই বিজয়ী বীর মুক্তিসেনা/তোমাদের এই ঋণ কোন দিন শোধ হবে না...। আসলেই তথাকথিত জ্ঞানী গুণীদের যে আসর এখন জমে উঠেছে বাংলাদেশে, সেখানে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান মুক্তিযোদ্ধারা সামান্যই ঠাঁই পান। তৃণমূলের মুক্তিযোদ্ধাদের সামনে আনা হয় না। তাই বলে তাঁদের অবদান ফিকে হয়নি। ঋণ কোনদিন শোধ হবে না। কিছু মানুষ মন থেকে সারা জীবন শ্রদ্ধা জানাবেন মুক্তিযোদ্ধাদের। যুদ্ধ করতে করতে প্রাণ দেয়া শহীদদের স্মরণ করবেন কৃতজ্ঞ চিত্তে। বিজয় দিবসের বেশ কিছু উৎসব অনুষ্ঠান ঘুরে এমন ধারণা হলো। মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে বুধবার গোটা রাজধানীজুড়েই ছিল নানা কর্মসূচী। বিশেষ বিশেষ এলাকাগুলো মুখরিত ছিল দিনভর। পতাকার লাল সবুজে সেজে সকলেই উদ্যাপন করে ঐতিহাসিক মুহূর্ত। প্রথমেই বলতে হয় ছায়ানটের আয়োজনটির কথা। বাঙালীর সাংস্কৃতিক আন্দোলন সংগ্রামে দীর্ঘকাল ধরে নেতৃত্ব দেয়া প্রতিষ্ঠানটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে বর্ণাঢ্য বিজয় উৎসবের আয়োজন করে। ভূমি থেকে অনেক উঁচুতে তৈরি করা হয় মঞ্চ। পতাকার লাল রঙে গড়া মঞ্চের ঠিক নিচের অংশটিও লাল। এখানে সঙ্গীত শিল্পী ও যন্ত্রসঙ্গীত শিল্পীরা বসেন। এর চারপাশে ছিল সবুজের সমারোহ। সবুজ শাড়ি ও পাঞ্জাবি পরা দর্শকরা বসেছিলেন মঞ্চ ঘিরে। পরিবেশনা নিয়ে শিল্পীরা কখনও মঞ্চের ওপরে, কখনও ছিলেন নিচে। তাঁদের সবার পোশাক ছিল লাল। শিল্পীরা নাচ গান ও কবিতার ভাষায় তুলে ধরেন একাত্তরকে। আজকের বাংলাদেশের অশুভ প্রবণতাগুলোও বাদ যায় না তাঁদের পর্যবেক্ষণ থেকে। সব আমলে নিয়েই সাজানো হয় অনুষ্ঠান। চার হাজারের মতো শিল্পী সঙ্গীত পরিবেশন করেন। তবে, আর সব উদ্যাপনের মতো মনে হয় না। শুদ্ধ সঙ্গীত নাচ ও কবিতায় ছিল ভয়কে জয় করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার আহ্বান। গড্ডালিকা প্রবাহ নয়, এখানে আবেগ গভীরতা পায়। দেশের জন্য প্রকৃত অনুভব ফুটে ওঠে। শুরুটা হয় জাতীয় সঙ্গীত ও জাতীয় পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে। মঞ্চের ওপরে তখন ছায়ানট সভাপতি সন্জীদা খাতুন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। নিচের অংশে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছেন শিল্পী দল। তাঁদের সঙ্গে প্রাণভরে জাতীয় সঙ্গীত গান গ্যালারির সাধারণ শ্রোতা। এরপর সমবেত কণ্ঠে গানÑ আমি মারের সাগর পাড়ি দেব বিষম ঝড়ের বায়ে/আমার ভয়ভাঙা এই নায়ে...। নিচে সঙ্গীতের পরিবেশনা। ওপরে এই গানের সঙ্গে নাচ। একটু নতুন। যথেষ্টই অভিনব। তাই বেশ উপভোগ্য হয়ে ওঠে অনুষ্ঠান। দ্বিতীয় গানেও ভয়কে জয় করার প্রত্যয়। অন্যায় অসুন্দরের বিরুদ্ধে লড়াই করার আহ্বান জানিয়ে শিল্পীরা গেয়ে যানÑ আমি ভয় করব না ভয় করব না/ দু’বেলা মরার আগে মরব না, ভাই, মরব না...। গানের সঙ্গে এবারও হলো অনবদ্য নাচ। চারপাশ খোলা মঞ্চে নতুন এক অনুভূতির জন্ম দিয়ে গেলেন শিল্পীরা। পরের পরিবেশনায় আশার বাণী। সমবেত কণ্ঠে ছিলÑ নবীন আশা জাগ্ল যেরে আজ/ নূতন রঙে রাঙা তোদের সাজ...। চিরকালের চাওয়া শান্তি সাম্য। সেই চাওয়ার কথা জানিয়ে শিল্পীরা গাইলেনÑ জয় হোক জয় হোক/শান্তির জয় হোক, সাম্যের জয় হোক/ সত্যের জয় হোক জয় হোক...। পরের গানটিÑ বাংলাভূমির প্রেমে আমার প্রাণ হইলো পাগল/আমি বাংলা-প্রেমে ঢাইলমু আমার দেহ মনের বল গো...। ষষ্ঠ পরিবেশনায় দেশের বন্দনা করেন শিল্পীরা। প্রিয় সুরে গেয়ে যানÑ আমার দেশের মতন এমন দেশকি কোথাও আছে/ বউ কথা কও পাখি ডাকে নিত্য হিজল গাছে...। শেষ গানে শহীদদের স্মরণ। সমবেত কণ্ঠে উচ্চারণÑ লাখো লাখো শহীদের রক্তমাখা/সবুজের বুকে লাল সূর্য আঁকা/আমাদের এই পতাকা...। প্রতিটি গানই সমবেত কণ্ঠে গাওয়া। প্রতিটি গানের সঙ্গেই ছিল নৃত্যের পরিবেশনা। মাঝখানে একটি একক গান নিয়ে মঞ্চে আসেন প্রতিষ্ঠানের সাধারণ সম্পাদক বিশিষ্ট নজরুল সঙ্গীত শিল্পী খায়রুল আনাম শাকিল। তাঁর কণ্ঠে ছিল একাত্তরে গাওয়া খুব জনপ্রিয় গান। শেখ লুতফর রহমানের লেখা ও আবুবকর সিদ্দিকের সুরে শিল্পী গেয়ে শোনান ‘বিপ্লবের রক্ত রাঙা ঝান্ডা ওড়ে আকাশে’ গানটি। বিশাল মঞ্চে একা হারমোনিয়াম বাজিয়ে গেয়ে শোনান এ গান। তারও আগে কবিতার ভাষায় বাংলাদেশ বিরোধীদের এই ভূখ- ছেড়ে যাওয়ার আহ্বান জানান মোহাম্মদ জহিরুল হক খান। একাধিকবার দেয়া হয় জয় বাংলা সেøাগান। নাতিদীর্ঘ আয়োজনের শেষ হয় জাতীয় সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে। সব মিলিয়ে একটি আন্তরিক প্রয়াস। প্রতিবছরের ধারাবাহিকতায় এবারও সকালে বিজয় শোভাযাত্রার আয়োজন করে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট। ‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পথে-জঙ্গীবাদকে দাঁড়াও রুখে’ সেøাগানে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করেন সংস্কৃতি কর্মীরা। শুরু হয় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে। সকাল সোয়া ১০টায় বিশিষ্ট নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার এই শোভাযাত্রার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। এ সময় সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ, সাধারণ সম্পাদক হাসান আরিফ, নাট্যজন ঝুনা চৌধুরী প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। শোভাযাত্রা থেকে সকল ষড়যন্ত্র উপক্ষো করে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি কার্যকর করায় সন্তোষ প্রকাশ করা হয়। সেই সঙ্গে বাংলাদেশ বিরোধী ষড়যন্ত্র রুখে দেয়ার লক্ষ্যে সকলকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানান সংস্কৃতিসেবীরা। বক্তব্যের পক্ষে শোভাযাত্রায় বিভিন্ন প্রতীক বহন করা হয়। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে শুরু হয়ে দোয়েল চত্বর, কদম ফোয়ারা, শাহবাগ, চারুকলা হয়ে টিএসসিতে এসে সংক্ষিপ্ত সমাবেশের মধ্য দিয়ে শেষ হয় জোটের বিজয় শোভাযাত্রা। বিকেলে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, রায়েরবাজার শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধসহ শহরের বেশ কয়েকটি স্থানে চলে জোটের বিজয় উৎসব। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পাশাপাশি এদিন বেশ কিছু আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। বেশিরভাগ আলোচনায় বাঙালীর আত্মত্যাগের ইতিহাস উঠে আসে। কান্নার ইতিহাস বর্ণনা করা হয়। এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ছিল জাতীয় জাদুঘর। এখানে যাদের প্রাণপণ লড়াইয়ে বিজয় অর্জিত হয়েছিল সেই মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে আসা হয়। ‘১৯৭১ : ঢাকার গেরিলা অপারেশন’ শীর্ষক আলোচনায় বক্তা ছিলেন ঢাকা অপারেশনে অংশ নেয়া মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুল আলম বীরপ্রতীক ও এম এ রশিদ। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন ঢাকা অপারেশনের অন্যতম গেরিলা নাসির উদ্দীন ইউসুফ। তার আগে স্বাগত বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক ফয়জুল লতিফ চৌধুরী। বিজয়ের দিনে বাঙালীর সৌর্য বীর্য ও সাহসের কথাগুলোকে সামনে আনায় ধন্যবাদ পেতে পারে জাদুঘর কর্তৃপক্ষ। এদিন ‘মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলা একাডেমি’ শীর্ষক আলোচনার আয়োজন ছিল বাংলা একাডেমিতে। এ বিষয়টিও কিছুটা নতুন বটে। বিষয়ের ওপর প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন কবি পিয়াস মজিদ। আলোচনা করেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. এ কে এম গোলাম রব্বানী এবং সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নিশাত জাহান রানা। সভাপতিত্ব করেন বাংলা একাডেমির সভাপতি ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। বক্তারা মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মধ্য দিয়ে যে স্বাধীন, প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র পাওয়া হয়েছে তার পেছনে বাংলা একাডেমি ও বাংলা সাহিত্যের ভূমিকা তুলে ধরেন।
×