ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

এলএমজি চালাই চোখ বুজে

প্রকাশিত: ০৬:০০, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৫

এলএমজি চালাই চোখ বুজে

রাজন ভট্টাচার্য ॥ ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় চোখ বন্ধ করে গুলি চালাতেন তিনি। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর ওপর জীবন বাজি রেখে ঝাঁপিয়ে পড়তেন। প্রতিজ্ঞা ছিল, পাঞ্জাবীদের ছাড় নয়। ‘১৯৭১ সালে জুলাই মাসের পর কোন এক সময়ে এক নম্বর সেক্টরের নোয়াখালীর গোতমা বিওপি এলাকায় বাঙালী পুলিশ সদস্যদের হামলা করে বর্বর পাকিস্তানী সেনারা। খবর পেয়ে ছুটে গেলাম। তুমুল যুদ্ধ চলছে। পাকিস্তানী সেনাদের অস্ত্রের দাপটে কাঁপছে পুরো এলাকা। অত্যাধুনিক অস্ত্রের কাছে আমাদের পুলিশ সদস্যরা কার্যত অসহায়। অনেকে গুলি খেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ছিলেন। আমি একা। তাতে কি। চোখ বন্ধ করে এলএমজি তাক করলাম। শুরু হলো গুলি। একটু পর মনে হলো পরিস্থিতি স্বাভাবিক। পাল্টা আক্রমণ কমতে থাকল। তাকিয়ে দেখি নয়জন পাকিস্তানী সেনার লাশ। মনটা খুশিতে ভরে গেল। সেদিন সময় মতো পৌঁছাতে না পারলে আমাদের অনেকেই হয়ত মারা যেতেন।’ এভাবেই ’৭১ সালে রণাঙ্গনের স্মৃতিচারণ করছিলেন মুক্তিযোদ্ধা আবুল ফারুক। মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর বয়স ছিল ৩২ বছর। তখন পুলিশ বাহিনীতে নায়েক হিসেবে কর্মরত ছিলেন তিনি। জনকণ্ঠের সঙ্গে আলাপচারিতায় জানান, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ঢাকায় প্রথম আক্রমণ শুরু করে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে। সেই রাতে ব্যারাকে ঘুমাচ্ছিলেন তিনিসহ অনেকেই। পাক সেনাদের হামলার সময় মানুষের চিৎকার ও পাগলা ঘণ্টার শব্দে ঘুম ভাঙলো। সবাই প্রতিরোধের জন্য তৈরি। দৌড়ে অস্ত্রাগার থেকে থ্রি নট থ্রি রাইফেল নিয়ে আমি ছালাম, জাহাঙ্গীরসহ কয়েকজন পুলিশ লাইনের রেশন গেট এলাকায় অবস্থান নেই। তখন পুরো এলাকা কাঁপছিল পাক নেতাদের অস্ত্রের দাপটে। দূর থেকে দেখলাম আর্মিরা গুলি করতে করতে সামনের দিকে আসছে। আমাদের গেটের কাছে আসার পর আক্রমণ শুরু করি। চোখ বন্ধ করে গুলি। ১০টি গুলির বেশি থ্রি নট থ্রি রাইফেলে ভরা যেত না। অল্প সময়ের মধ্যে গুলি শেষ হয়ে যেত। আবারও ভরতাম। এক পর্যায়ে রাজারবাগের টিনশেড ভবনে ওরা গান পাউডার দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। এতে আমরা ভয় পাই। সবাই জীবন বাঁচাতে ছুটতে থাকেন। দীর্ঘ সময় চলে যুদ্ধ। আগুন দেয়ার পর মসজিদের দিকে যাই। সেখানেও আগুন দেখে ফ্যামেলি কোয়ার্টারের দিকে গেলাম। সেখানে ও অস্ত্রাগারের সামনে শক্তিশালী বোমা ছোড়ে পাক সেনারা। সবাই আতঙ্কিত তখন। হঠাত দেখতে পাই পুলিশ ব্যারাকের সামনের মাঠে নিহত পুলিশ সদস্য, সাধারণ মানুষ ও বাবুর্চিদের লাশ এনে জড়ো করছে পাঞ্জাবীরা। ভোরের আগে আগে দেয়ালের ওপর তাঁরকাটার বেড়া ডিঙ্গিয়ে কোন রকমে পালাই। সেখান থেকে চামেলীবাগ পুলিশের রিজার্ভ অফিসে গিয়ে দেখি লোক নেই। পোশাক খুলে স্থানীয় একজনের দেয়া ছেঁড়া জামা ও লুঙ্গি পরি। অস্ত্র ফেলে সেগুনবাগিচা হয়ে আলাউদ্দিন রোড দিয়ে হাজারো মানুষের লাইনে হাঁটতে থাকি। অনিশ্চিত গন্তব্য। হাতে কোন টাকা নেই। রাস্তায় রাস্তায় মানুষের দেয়া খাবার খেতাম। তখন বড়লোকরা খুব একটা এগিয়ে আসেনি। সাধারণ ও গরিব মানুষই বেশি সহযোগিতা করত। হেঁটে আটদিন পর মুন্সীগঞ্জ গেলাম। হেলালসহ আরও দুই সিপাহী আমার সঙ্গে ছিলেন। নদীতে মাঝিকে গিয়ে বললাম আমরা তিনজন বিপদে পড়েছি। তিন আনাও হাতে নেই। আমাদের পার করে দাও। মন গলল মাঝির। বললো সব মাপ। টাকা লাগবে না। তিনি আমাদের নদী পার করে বেলতলী উঠিয়ে দিলেন। সেই মাঝির কথা এখনও ভুলতে পারেননি ফারুক। এ কথা মনে হতেই হাউমাউ করে কাঁদছিলেন। নির্বাক ছিলেন কিছু সময়। বললেন, মাঝির দেনা শোধ করা হোল না। দেখাও হলো না তাঁর সঙ্গে। কানে বারবার ধ্বনিত হয় ‘মাপ’ কথাটি। তারপর আবারও পায়ে হেঁটে বাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলার জমশেদপুরের বর্ণিল গ্রামের নিজ বাড়িতে গেলাম। এবার ভিন্ন রকম বিপদ আবুল ফারুকসহ গ্রামবাসীর। স্থানীয় রাজাকাররা আক্রমণ করতে আসল। অনেকেই ভয় পেলেন। এগিয়ে গেলাম। সাহসি মানুষদের নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুললাম। সেদিন গণপিটুনিতে ছয়জন দেশীয় রাজাকারকে হত্যা করি। কিছুদিন বাড়িতে থাকার পর ভারতের কৃষ্ণনগরে পুলিশ হেড কোয়ার্টারে চলে যাই। সেখানের পুলিশ কর্মকর্তা এম আই তালুকদার আমাদের জিজ্ঞেস করলেন যুদ্ধে যাব কিনা। সবাই হ্যাঁ বললাম। আমরা এক প্লাটুন লোক ট্রেনিং শেষে এক নম্বর সেক্টরে যোগ দেই। জুন-জুলাই মাসে নোয়াখালীর বেলুনিয়াসহ আশপাশের এলাকায় যুদ্ধ করি। নবেম্বর মাসে ফেনী নদীর ওপর ঝুলন্ত ব্রিজ রক্ষার দায়িত্ব দেয়া হয়। আমাদের এলাকায় পাকবাহিনীকে খুব একটা প্রবেশ করতে দেইনি। এই এলাকা কার্যত মুক্ত ছিল। পাকবাহিনীর অত্যাচারে যারা গ্রাম ছেড়েছিলেন ১৬ ডিসেম্বর দেখি তারা ফিরে আসছেন। পাকিস্তানী সেনারা গাড়ি নিয়ে ঢাকার দিতে যাচ্ছিল। মুখে মুখে রটে গেল পাক সেনাদের আত্মসমর্পণ ও দেশ স্বাধীন হওয়ার কথা। তিনি জানান, মুক্তিযুদ্ধের পর চট্টগ্রাম সরকারী কলেজে অস্ত্র জমা দেই জানুয়ারি মাসে। ২১ জানুয়ারি ঘোষণা আসে ১০ দিন ছুটি শেষে পুলিশে যোগ দেয়ার। ফেব্রুয়ারিতে যোগ দেই। ১৯৯৮ সালে ইন্সপেক্টর পদে অবসরে যান আবুল ফারুক। যুদ্ধের সময় বহুবার মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছেন তিনি। বিশেষ ঘটনা হিসেবে তিনি বলেন, ছাগলনাইয়া এলাকার ফরিমাটিলা এলাকায় একবার সাধারণ মানুষের ওপর পাকবাহিনীর নির্মম অত্যাচার চলছিল। মানুষের আর্তচিৎকারে ভারি হয়ে উঠছিল আকাশ বাতাস। বাঁচার আকুতি করছিলেন অনেকে। তখন পাষ-রা হাসছিল। এসব দেখে সহ্য করতে পারিনি। গোয়েন্দাগিরির সময় এ চিত্র চোখে পড়ে। একা চললেও শরীরে অস্ত্র লুকিয়ে রাখতাম। এক পর্যায়ে পাকিস্তানীদের ওপর গুলি চালাতে শুরু করি। বুলেট দিয়ে ওদের ঝাঁজরা করে দেই। মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসি সেদিন। জীবনে চাওয়া পাওয়ায় কিছু নেই এই বীর মুক্তিযোদ্ধার। রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি চান না তিনি। তবে সরকার স্বেচ্ছায় দিলে আপত্তি নেই বলেও জানান। তিনি বলেন, আর কখনও যুদ্ধ হবে না। আমি মুক্তিযোদ্ধা। এটাই আমার সবচেয়ে বড় পরিচয়। এজন্য আমি গর্বিত। অনেকের অর্থ বিত্ত ও ক্ষমতা আছে। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধার পরিচয় নেই। দেশ ও মানুষকে নিয়ে প্রত্যাশা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সবাই যেন ভাল থাকে। শান্তিতে থাকে। এর চেয়ে চাওয়ার আর কিছুই নেই। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আরও আগেই মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার শুরুর প্রয়োজন ছিল। বিলম্ব হয়ে গেছে। এতে ক্ষতিও হয়েছে অনেক। দেশবিরোধী শক্তির শেকড় এখন অনেক গভীরে। তিনি বলেন, যতদিন সব রাজাকারের বিচায় না হয়; ততদিন পর্যন্ত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার কাজ চালিয়ে যেতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে কোন রাজাকারের ঠাঁই হবে না। ওদের সবাইকে খুঁজে বের করে বিচারের আওতায় আনতে হবে। রাজাকারদের সন্তানদের বাংলাদেশের নাগরিকত্ব বাতিলেরও দাবি জানান এই মুক্তিযোদ্ধা। ৭৬ বছর বয়সে এখন স্মৃতিশক্তি তেমন প্রখর নয়। যুদ্ধকালীন সময়ের অনেক কথাই ভুলে গেছেন। কিছু মনে আছে। যা নিজেকে সব সময় তাড়িয়ে বেড়ায়। অসুস্থতা কাবু করার চেষ্টা করলেও মনের জোর কমেনি একটুও। সম্প্রতি স্ট্রোক করে ডান হাত ও পা কার্যত অবশ। কথাও স্পষ্ট নয়। তাতে কি। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতের সেই দুঃসহ স্মৃতির কথা মনে পড়লে উত্তরার বাসা থেকে ছুটে আসেন রাজারবাগ পুলিশ লাইনে। সবকিছু মনে করার চেষ্টা করেন। ব্যবসায়ী তিন ছেলের সঙ্গে রাজধানীর উত্তরার সাত নম্বর সেক্টরের সাত নম্বর বাসায় থাকেন তিনি। বছরে এক থেকে দু’বার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে যান। বললেন, আমি ভাল আছি। সুখে আছি। পরিবারের সবার আদর ভালবাসায় শান্তিতে জীবন কাটছে। এভাবেই বাকি জীবন কাটাতে চান বীর এই সৈনিক।
×