ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

জামাত জঙ্গিদের নিশানায় ভারত

প্রকাশিত: ১৮:৫৪, ১৫ ডিসেম্বর ২০১৫

জামাত জঙ্গিদের নিশানায় ভারত

অনলাইন ডেস্ক ॥ বাংলাদেশে অভীষ্ট সিদ্ধ হলে জেএমবি জঙ্গিদের পরবর্তী লক্ষ্য ছিল ভারত। এনআইএ-র এক কর্তা সোমবার জানান, খাগড়াগড় বিস্ফোরণের তদন্তে পাওয়া নথিপত্র থেকে স্পষ্ট— রাজ্যের তিনটি জেলা নদিয়া, মুর্শিদাবাদ ও বীরভূমে খিলাফত প্রতিষ্ঠা ছিল জেএমবি-র লক্ষ্য। এনআইএ-র বক্তব্য, হত্যা ও নাশকতা ঘটিয়ে বাংলাদেশের নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে শরিয়তি আইন প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যেই পশ্চিমবঙ্গে বহু জঙ্গি ডেরা ও বর্ধমানের খাগড়াগড়-সহ একাধিক জায়গায় বোমা-বিস্ফোরকের কারখানা তৈরি করেছিল জেএমবি (জামাতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ)। বাংলাদেশে সাফল্য মিললে জেএমবি ধীরে ধীরে ভারতেও সেই লক্ষ্যে এগোতে বলে খাগড়াগড় বিস্ফোরণ মামলার দ্বিতীয় সাপ্লিমেন্টারি (অতিরিক্ত) চার্জশিটে ইঙ্গিত দিয়েছে এনআইএ। সোমবার কলকাতার মুখ্য বিচার বিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে প্রায় ৩৫০ পাতার ওই অতিরিক্ত চার্জশিট পেশ করেছে এনআইএ। এনআইএ-র দাবি, বাংলাদেশ জেএমবি-র মূল নিশানা হলেও ভারতে শাখাপ্রশাখা বিস্তার করে নিজেদের পরিকল্পনায় আরও এগোতে চেয়েছিল জেএমবি। এনআইএ-র একটি সূত্র জানাচ্ছে এই দ্বিতীয় অতিরিক্ত চার্জশিটই খাগড়াগড় মামলার চূড়ান্ত বা ফাইনাল চার্জশিট। এর পর বিচার প্রক্রিয়া যত শীঘ্র সম্ভব শুরু করে দেওয়ার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। এই মামলায় এখনও পর্যন্ত ৬৬ হাজার ৭৫৩ পাতার নথি আদালতে জমা দিয়েছে এনআইএ । এর আগে গত ৩০ মার্চ এনআইএ এই মামলায় চার্জশিট দেয়। তার পর ২৩ জুলাই গোয়েন্দারা প্রথম সাপ্লিমেন্টারি চার্জশিটটি জমা দেন। বর্ধমান শহরের খাগড়াগড়়ের এক জঙ্গি ডেরায় ২০১৪-র ২ অক্টোবর দুর্ঘটনামূলক বিস্ফোরণে দু’জনের প্রাণ যায়। ওই ডেরায় বিস্ফোরক এবং দেশি গ্রেনেড, সকেট বোমা ও বুলেটের মতো মারণাস্ত্র তৈরি হতো। এক সপ্তাহ ঘুরতে না ঘুরতেই কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের নির্দেশে ওই ঘটনার তদন্তভার যায় এনআইএ-র হাতে। তদন্তে নেমে হদিস মেলে পশ্চিমবঙ্গকে কেন্দ্র করে এক জঙ্গি নেটওয়ার্কের, যার শাখা ছড়িয়ে ছিল পড়শি রাজ্য অসম ও ঝাড়খণ্ডেও। তদন্তকারীদের দাবি, জেএমবি-র উদ্দেশ্য ছিল, বাংলাদেশের পর এ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে নাশকতা ঘটানো ও ভারতের গণতান্ত্রিক পরিকাঠামো নড়বড়ে করে দেওয়া। এ জন্য কী রকম প্রস্তুতি ছিল? গোয়েন্দাদের মতে, খাগড়াগড়ে পুরোদস্তুর বোমা তৈরির কারখানা গড়ে তোলা, সহজে বশীভূত হয় এমন লোকদের মগজধোলাই, তাদের থেকে বেছে নতুন নতুন জেএমবি-র সদস্য নিয়োগ, বর্ধমানের শিমুলিয়া ও মুর্শিদাবাদের মুকিমনগরের মতো মাদ্রাসা এবং আরও কয়েকটি গোপন ডেরায় তাদের প্রশিক্ষণ, শিমুলিয়া ও মুকিমনগর-সহ কয়েকটি মাদ্রাসার দরিদ্র পড়ুয়াদের সাহায্যের জন্য অর্থ সংগ্রহ— এই সবই ছিল পরিকল্পনার অঙ্গ। তবে শেষ পর্যন্ত খাগড়াগড়ের ডেরায় বিস্ফোরণ ও তদন্তে পর পর ধরপাকড়ে সব বানচাল হয়ে যায় বলে গোয়েন্দাদের দাবি। গোয়েন্দারা অবশ্য জেনেছেন়, খাগড়াগড় বিস্ফোরণের পরেও ফেরার কুশীলবরা মূলত টেলিফোনের মাধ্যমে ভারত থেকে বাংলাদেশের সঙ্গীদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে গিয়েছে । যেমন, নুরুল হক মণ্ডল ওরফে নইম। যাকে এই বছরের ১৮ জুন হাওড়া স্টেশনের কাছ থেকে গ্রেফতার করা হয়। ধরা পড়ার আগে নইম জেএমবি-র চাঁই হাতকাটা নাসিরুল্লা, কওসর, কদর কাজীদের সঙ্গে ফোনে কথা চালিয়ে গিয়েছে বলে দাবি গোয়েন্দাদের। তাঁরা নইমের দু’টি ঠিকানা পেয়েছেন, একটি মুর্শিদাবাদের ডোমকল, অন্যটি বীরভূমের বোলপুরের মুলুক গ্রামে। কিন্তু গোয়েন্দাদের একাংশের সন্দেহ, নইম আসলে বাংলাদেশেরই নাগরিক। এনআইএ-র এসপি বিক্রম খালাটে বলেন, ‘‘এ দিন জমা দেওয়া দ্বিতীয় অতিরিক্ত চার্জশিটে এক জনের নাম রয়েছে।’’ সেই এক জনই হল নুরুল হক মণ্ডল ওরফে নইম। এসপি জানান, এই নিয়ে খাগড়াগড় বিস্ফোরণ মামলায় ২৮ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট পেশ করল এনআইএ। এ বার চার্জশিটে সকলের বিরুদ্ধে নতুন কিছু অভিযোগ আনা হয়েছে। তার মধ্যে একটি হল, ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২৫ নম্বর ধারা। এশিয়ায় ভারতের কোনও মিত্র দেশের বিরুদ্ধে কেউ যুদ্ধ ঘোষণা করলে তার বিরুদ্ধে এই অভিযোগ আনা হয়। এনআইএ-র আইনজীবী শ্যামল ঘোষ ও তমাল মুখোপাধ্যায় জানান, খাগড়াগড় মামলার অভিযুক্তরা ভারতে বসে বাংলাদেশে নাশকতার ছক কষেছিল। মায়ানমারও ছিল তাদের নিশানায়। গোয়েন্দাদের বক্তব্য, মায়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিমদের ক্ষোভকে কাজে লাগাতে চেয়েছিল জেএমবি। শ্যামলবাবু ও তমালবাবু জানান, অভিযুক্তরা জাল ভারতীয় পাসপোর্ট, রেশন কার্ড, ভোটার কার্ড, আধার কার্ড তৈরি করেছিল বলে তাদের বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৪৬৮ ও ৪৭১ নম্বর ধারাতেও অভিযোগ আনা হয়েছে। এনআইএ জানায়, ২৮ জনের মধ্যে ১৮ জন এখন জেলে। বাকি ১০ জন এখনও অধরা, তাদের ন’জনের বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি করা হয়েছে। তবে এনআইএ জানায়, খাগড়াগড় বিস্ফোরণ মামলায় মোট অভিযুক্তের সংখ্যা ৩৭। অর্থাৎ ন’জনের বিরুদ্ধে এখনও চার্জশিট দেওয়া হয়নি। এনআইএ সূত্রের খবর, এই মামলায় এখনও পর্যন্ত ৪০০ জনকে সাক্ষী হিসেবে পাওয়া গিয়েছে। কেন্দ্রীয় এই তদন্তকারী সংস্থাটি জানাচ্ছে, নুরুল হক ওরফে নইম বাংলাদেশে গিয়ে ঢাকার যাত্রাবাড়ি ও মিরপুর এলাকায় দেড় মাস ছিল। দুই জেএমবি চাঁই তালহা ওরফে বশির ও কওসর ওরফে বোমারু মিজান সেখানে তাকে বোমা তৈরির তালিম দিয়েছিল। এই বশির ওরফে তালহাই হল জেএমবি-র ‘আমির’, বর্তমানে জেলে বন্দি সইদুর রহমানের ছেলে। তালহাকে বাংলাদেশ পুলিশ ২৭ জুলাই ঢাকায় গ্রেফতার করে। তদন্তকারীরা জানান, তালহার শিষ্য নইমের কাছ থেকে উদ্ধার হওয়া জিনিসপত্র থেকে জানা গিয়েছে— ওসামা বিন লাদেন, মোল্লা ওমর, বাংলা ভাইয়ের মতো জঙ্গি নেতার বক্তৃতার ভিডিও-ও নিয়মিত দেখত সে। একই সঙ্গে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার, আত্মঘাতী হামলা ও আইইডি বিস্ফোরণের নানা ভিডিও সিডি-ও পাওয়া গিয়েছে নইমের কাছে। সূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা
×