ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ষড়যন্ত্রকারীদের সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী

বিষদাঁত ভেঙ্গে দিচ্ছি, দেব

প্রকাশিত: ০৭:৪৮, ১৫ ডিসেম্বর ২০১৫

বিষদাঁত ভেঙ্গে দিচ্ছি, দেব

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রকারীদের বিষদাঁত ভেঙ্গে দেয়ার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করে বলেছেন, একাত্তরের পরাজয় ভুলতে না পারা পাকিস্তানসহ তাদের দোসরদের ষড়যন্ত্র চলছে। কারণ তারা এখনও তাদের পরাজয় ভুলতে পারেনি। কিন্তু ষড়যন্ত্র করে কেউ আর বাংলাদেশের কিছু করতে পারবে না, সফল হতে পারবে না। আমরা ষড়যন্ত্রকারীদের বিষদাঁত একে একে ভেঙ্গে দিচ্ছি এবং ভেঙ্গে দেব। সকল ষড়যন্ত্র মোকাবেলা এবং আত্মসমর্পণ নয়, আত্মমর্যাদা নিয়েই আমরা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি, এগিয়ে নিয়ে যাব। দেশের এই অগ্রযাত্রা কেউ-ই আর রুখতে পারবে না। বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া কোন্ মুখে ও নাটক করতে জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে গেছেন সে ব্যাপারে প্রশ্ন তুলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, একাত্তরে বুদ্ধিজীবীদের ঘাতক আলবদর-রাজাকার-আলশামসদের প্রধানদের মন্ত্রী বানিয়ে তাদের গাড়িতে লাখো শহীদের রক্তস্নাত পতাকা তুলে দিয়েছিলেন এই খালেদা জিয়া। যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষায় আন্দোলনের নামে শত শত মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা করেছেন। কিন্তু তিনি মুখ মুখে জাতীয় স্মৃতিসৌধে বুদ্ধিজীবীদের শ্রদ্ধা জানাতে গেলেন? সেখানে কি নাটক করতে গেছেন? নটঙ্গীপনা তো উনি ভালই জানেন। আসলে তাঁর এই শ্রদ্ধা জানাতে যাওয়া জাতির সঙ্গে ধোঁকা ও তামাশা করা ছাড়া আর কিছুই নয়। সামান্যতম লজ্জা, ঘৃণা ও শরম থাকলে সেখানে তিনি যেতে পারতেন না। আর কিছু মুক্তিযোদ্ধা দেখলাম তাঁর সঙ্গে গেছেন! তাঁরাও কোন্ মুখে এবং কার সঙ্গে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে গেলেনÑ একটু ভেবে দেখার অনুরোধ জানাই। সোমবার রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে আওয়ামী লীগ আয়োজিত আলোচনাসভায় সভাপতির বক্তব্য রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বুদ্ধিজীবী হন্তারক সকল যুদ্ধাপরাধীর বিচারে তাঁর সরকারের দৃঢ় অবস্থানের কথা তুলে ধরে বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের রায় কার্যকরের মাধ্যমে দেশ প্রথম কলঙ্কমুক্ত হয়েছে। এখন একটি করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় কার্যকর হচ্ছে, একধাপ করে এগিয়ে যাচ্ছে ও অভিশাপমুক্ত হচ্ছে বাংলাদেশ। পৃথিবীর কোন শক্তি নেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ করতে পারে। আর দেশের মধ্যে যারা যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাতে চায়, তারাও যুদ্ধাপরাধী। একদিন তাদেরও বিচার হবে। দেশবাসীকে বলব যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষার ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িতদেরও ঘৃণা ও ধিক্কার জানান। যতদিন দেশকে সম্পূর্ণ অভিশাপ ও কলঙ্কমুক্ত করা না যাবে, ততদিন দেশের মঙ্গল হবে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে আলোচনাসভায় বক্তব্য রাখেন উপদেষ্টাম-লীর সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, সভাপতিম-লীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ, শহীদ বুদ্ধিজীবী ডাঃ আবদুল আলিমের কন্যা ডাঃ নুজহাত হালিম চৌধুরী, নগর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এমএ আজিজ, সাধারণ সম্পাদক ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বীরবিক্রম, সাবেক ডাকসু ভিপি ও কেন্দ্রীয় নেতা আখতারুজ্জামান ও খাদ্যমন্ত্রী এ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম। তাঁর প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে অনেকের আশঙ্কার জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমার বিশ্বাস আছে বাংলাদেশের জনগণের ওপর। মৃত্যু নিয়ে আমি ভাবি না, আমার হারানোর কিছু নেই। বাবা-মাসহ সবাইকে হারিয়ে বাংলাদেশের মানুষকেই তো আপন করে নিয়েছি। আমাকে হত্যার জন্য ২১ আগস্ট গ্রেনেড- গুলিসহ অসংখ্যবারই চেষ্টা করা হয়েছে। আমি মৃত্যুকে ভয় করি না। আমার একটাই লক্ষ্যÑ এ দেশের একটি মানুষও যেন গৃহহারা না থাকে, দুই বেলা পেট ভরে খেতে পারেনÑ এটাই আমি চাই। শেখ হাসিনা বলেন, ধার করে ঘি খাওয়ার চেয়ে নিজের শক্তিতে নুন খাওয়াই বড় কথা। ভিক্ষা করে বিলাসিতা নয়, কুঁড়েঘর থাকলে কুঁড়েঘরেই থাকব। তাও কারোর কাছে হাত পাতব না। মাথা নত করব না। বাংলাদেশের মানুষকে সেই চেতনা নিয়েই থাকতে হবে। তিনি বলেন, কোন কাজ করতে গেলে, সিদ্ধান্ত একবার নিলে সেটাই অটল থাকতে হবে। দেশকে অভিশাপমুক্ত করতে হবে। না হলে দেশে শান্তি আসবে না। আমরা দেশকে গড়ে তুলব উন্নত দেশ হিসেবে। যারা দেশের জন্য রক্ত দিয়ে গেছেন তাদের রক্তের মর্যাদা দিতে হবে। লাখো শহীদের রক্তের ঋণ আমাদের পরিশোধ করতেই হবে। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আত্মত্যাগের মর্যাদা রক্ষা করতে স্বাধীনতার সুফল জনগণের ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে হবে। শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানানোর নামে খালেদা জিয়া জাতির সঙ্গে তামাশা করেছেন মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীদের হত্যাকারী রাজাকার-আলবদরদের মন্ত্রিসভায় স্থান দিয়েছিলেন খালেদা জিয়া। আজ তিনি কোন্ মুখে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মৃতিসৌধে যান? তাঁর লজ্জা হওয়া উচিত। শ্রদ্ধা জানানোর নামে জাতির সঙ্গে উনি তামাশা করেছেন। আর যিনি (খালেদা জিয়া) জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হত্যাকারীদের মন্ত্রিসভায় জায়গা দিয়েছেন, তাঁর সঙ্গে কীভাবে সেখানে যান মুক্তিযোদ্ধারা। তাদের বিষয়ে মানুষকে আরও সচেতন হওয়া উচিত। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে দেশের উন্নতি হয়। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদ্যোগ নেয়। কিন্তু বিএনপি সরকার তা বাতিল করে দেয়। খালেদা জিয়া যুদ্ধাপরাধী ও বঙ্গবন্ধুর খুনীদের মদদ দেন। ২০০৯ সালে সরকার গঠন করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে ট্রাইব্যুনাল গঠন করে বিচার শুরু করি। অনেকের বিরুদ্ধে বিচারের রায় হয়েছে, রায়ও কার্যকর করা হয়েছে। তিনি বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির রায় কার্যকরের আগে প্রচ- আন্তর্জাতিক চাপ সহ্য করতে হয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের যাতে বিচার ও রায় কার্যকর না হয় সেজন্য বিশ্বের বড় বড় কেউ কেউটে যারা আছেন তারা টেলিফোন করেছেন এ বিচার বন্ধ করতে। এমনকি বিচার প্রক্রিয়া নিয়েও প্রশ্ন তোলার চেষ্টা হয়েছে। গণহত্যাকারীদের মানবাধিকার নিয়ে তারা কথা বলেন! কিন্তু আমরা একটা আদর্শ নিয়ে রাজনীতি করি। কোন ষড়যন্ত্রই যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষা করতে পারেনি, পারবেও না। সত্যের জয় অনিবার্য। শত ষড়যন্ত্র ও বাধা মোকাবেলা করেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করছি, বিচার করব। বিএনপি-জামায়াত জোটের কঠোর সমালোচনা করে শেখ হাসিনা বলেন, ২০১৪ সালে নির্বাচন বন্ধ করার নামে শত শত মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা ও আহত করা হলো। ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হলো সারাদেশে। সেই সময় আমাদের মধ্যেও অনেকের আত্মবিশ্বাস কম ছিল বলে অনেক কথা বলেছে। ঘরে-বাইরে লড়াই করেই আমাদের নির্বাচন করতে হয়েছে। তিনি বলেন, আবার নির্বাচনের পরেই ঠিক ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে শুরু হলো মানুষকে পুড়িয়ে মারার রাজনীতি। তখনও প্রায় দেড় শ’র মতো মানুষকে হত্যা করা হলো। আসলে এসবের মূল উদ্দেশ্য ছিল যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানো এবং দেশকে পেছনের দিকে নিয়ে যাওয়া। এমনকি সর্বশেষ দুই যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির রায় হওয়ার পরই বিএনপি নেত্রী লন্ডন থেকে দ্রুত দেশে ফিরে এসেছিলেন। মনে করেছিলেন আন্দোলন করে এ বিচার কার্যক্রম ঠেকাবেন। কিন্তু তা তিনি পারেননি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশ কিছুদূর এগিয়ে গেলেই নানা দিক থেকে বাধা আসে। আসলে দেশে কিছু লোক আছেন যারা দেশের মানুষ শান্তিতে থাকলে অশান্তিতে ভোগেন। আজকে দেশের মানুষ খেতে পারছে, বিদ্যুত উৎপাদন বাড়িয়েছি, দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নতি হয়েছে, দেশ সবদিক থেকে এগিয়ে যাচ্ছেÑ এটাই তাদের দুঃখ। কারণ তারা চান না বাংলাদেশ কখনও মাথা উঁচু করে দাঁড়াক। মহান মুক্তিযুদ্ধের লাখো শহীদের রক্তের সঙ্গে জিয়াউর রহমান বেইমানি করেছেন বলে মন্তব্য করে শেখ হাসিনা বলেন, বিজয়ের মাত্র দু’দিন আগে (১৪ ডিসেম্বর) দেশের বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে এ দেশকে অকার্যকর করতে চেয়েছিল, কিন্তু পারেনি। পরে দেশ স্বাধীন হলো। একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ যখন জাতি গড়ে তুলছিলেন, তখনই তাঁকে হত্যা করা হলো। তিনি বলেন, মীরজাফর যেমন টিকতে পারেনি, বেইমান মুশতাকও টিকতে পারেনি। হত্যা-ক্যু-ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করেন জিয়াউর রহমান। বঙ্গবন্ধু হত্যার পেছনে যে জিয়াউর রহমান মূল ব্যক্তি হিসেবে ছিলেন পরে তা সামনে আসে। তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি জিয়াউর রহমানের মাধ্যমেই প্রতিশোধ নিয়েছে। তাঁর স্ত্রী (খালেদা জিয়া) একই কাজ করে যাচ্ছেন। অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করেই জেনারেল জিয়া স্বাধীনতাবিরোধীদের বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ করে, কারাগার থেকে মুক্ত করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় বসান। মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপদেষ্টা বানিয়ে তাঁদের গাড়িতে রক্তস্নাত পতাকা তুলে দেন। লাখো শহীদের রক্তের সঙ্গে বেইমানি করেন জিয়া। একেক রাতে এক শ’-দেড় শ’ মুক্তিযোদ্ধা সামরিক অফিসারকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করে এই জিয়াউর রহমান। পরে খালেদা জিয়াও ক্ষমতায় এসে নিজামী ও মুজাহিদকে মন্ত্রী বানালেন। আসলে এসবই তাদের রাজনীতি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২১টি বছর ক্ষমতা দখলকারীরা দেশের মানুষকে ভিক্ষুকের জাতি করে রেখেছিল। এরা ক্ষমতায় থেকে শুধু নিজেদের আখের গোছাতে পারে, দেশের মানুষের জন্য কিছু করতে পারে না। কিন্তু আমরা বীরের জাতি, মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছি। আমরা আত্মনির্ভরশীল হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই, মর্যাদা নিয়ে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে চাই। সেই ভাবেই আমরা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। পরিকল্পিতভাবে আমরা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি বলেই সারাবিশ্ব আমাদের প্রশংসা করছে। আমরা বিশ্বের বুকে হারানো গৌরব আবার ফিরিয়ে এনেছি। এই গৌরবের ঝা-া আমাদের ধরে রাখতে হবে। এ ব্যাপারে দেশবাসীর সহযোগিতা কামনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, শুধু হাহাকার নয়, আমরা দেশকে যে এগিয়ে নিতে পারি সেই আত্মবিশ্বাস নিয়ে চলতে হবে। আমরা যে, যে কোন অসাধ্য সাধন করতে পারি তা প্রমাণ করেছি। বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবেই। কারোর কাছে আত্মসমর্পণ নয়, আত্মবিশ্বাস ও আত্মনির্ভরশীলতা নিয়েই আমরা বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। বিশ্বের মধ্যে ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত উন্নত-সমৃদ্ধ মর্যাদাশীল দেশ হিসেবে আমরা মাথা উঁচু করে চলবই। এ অগ্রযাত্রা কেউ রুখতে পারবে না।
×