ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সার্কসহ বিভিন্ন বিশ্ব সংগঠন থেকে বহিষ্কার দাবি

পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদের সিদ্ধান্ত ঢাবি’র

প্রকাশিত: ০৫:৩৩, ১৫ ডিসেম্বর ২০১৫

পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদের সিদ্ধান্ত ঢাবি’র

স্টাফ রিপোর্টার ॥ মানবতাবিরোধী অপরাধের বিরুদ্ধে কোটি মানুষের আবেগ অনুভূতির মূল্যায়ন করার মতো শক্ত মাটিতে দাঁড়িয়ে এখন বাংলাদেশ। এই আবেগকে বজ্রশক্তি হিসেবে লালন ও ধারণ করে ৪৪ বছর পর পাকিস্তানকে ‘না’ বলতে চলেছে বাংলাদেশ। ইতিহাসের নিকৃষ্টতম গণহত্যা, লাখো নারীর সম্ভ্রমহানি, কোটি মানুষকে গৃহহারা করাকেও যে দেশ অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করে না সে দেশের সঙ্গে সম্পর্ক না রাখাই উপযুক্ত জবাব হওয়া উচিত বলে গণদাবি উঠেছে। আর সেই দাবিকে সম্মান দেয়ার প্রক্রিয়াটি শুরু হচ্ছে দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দেশের স্বাধীনতার লড়াইয়ের ইতিহাসের প্রতিটি মুহূর্তের সাক্ষী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। পাকিস্তানের সঙ্গে আর কোন ধরনের সম্পর্ক থাকবে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সোমবার বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সভা শেষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে আনুষ্ঠানিকভাবে এ ঘোষণা দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। সংবাদ সম্মেলনে সিন্ডিকেট সভাপতি অধ্যাপক আরেফিন সিদ্দিক বলেন, আমরা মনে করি, বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করার সময় এসেছে। কারণ তারা একাত্তরে গণহত্যা চালিয়েছে, আবার সেই গণহত্যাকে অস্বীকার করছে। এ পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন সম্পর্ক থাকÑ এটি আমরা চাই না। এর আগে বিকেল তিনটায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী এ সভা শুরু হয়। এরপর পাকিস্তানের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পর্কচ্ছেদের বিষয়টি উঠলে বিকেল সাড়ে চারটা পর্যন্ত এ বিষয়ে আলোচনা হয়। এরপর আনুষ্ঠানিকভাবে সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ত সম্পর্কে জানানো হয়। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. সহিদ আখতার হুসাইন, উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. নাসরিন আহমাদ, ঢাবি শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন, সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক এ এস এম মাকসুদ কামাল, কলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক আকতারুজ্জামান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। এ সময় উপাচার্য বলেন, ১৯৭১ সালে পাকহানাদার বাহিনী এদেশের জনসাধারণের ওপর নির্মম গণহত্যা চালিয়েছিল। এর জন্য দেশটি কখনও ক্ষমা প্রার্থনা করেনি, এর ওপরে বাংলাদেশে চলমান যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বিষয়ে নগ্নভাবে হস্তক্ষেপ করে মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের অপমান করে বক্তব্য দিয়েছে। স্বাধীনতার ৪৫ বছর পরে এসেও পাকিস্তান মুক্তিযুদ্ধ এবং সে সময়ে সংগঠিত গণহত্যা নিয়ে ক্রমাগত নির্লজ্জ মিথ্যাচার করছে। তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে পাকিস্তানের কোন বিশ্ববিদ্যালয় বা অন্য কোন প্রতিষ্ঠানের সমঝোতা স্মারক নতুন করে সই হবে না। যেগুলো আছে, সেগুলোও স্থগিত থাকবে। পাকিস্তানের কেউ এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারবে না। যদি তাদের কৃতকর্মের জন্য নিঃশর্তভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করে এবং আত্মসমর্পণকারী ১৯৫ সেনাসদস্যের বিচার করে তবেই এ সম্পর্কের বিষয়ে সিন্ডিকেট পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবে। পাকিস্তানের সঙ্গে সব ধরনের দ্বিপক্ষীয় এবং কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে উপাচার্য আরও বলেন, মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত হয়ে যে ১৯৫ পাকিসেনা আত্মসমর্পণ করেছিল, তাদের বিচার করা হবে বলে চুক্তি করা হয়েছিল। কিন্তু পাকিস্তান তাদের বিচার করেনি। এসব সেনাদের বিচার করতে হবে। পাকিস্তানকে ‘সন্ত্রাসী’ রাষ্ট্র উল্লেখ করে উপাচার্য আরও বলেন, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান এদেশের মানুষের ওপর যে বর্বর এবং নির্মম গণহত্যা চালিয়েছিল তার প্রমাণ সে সময়ের বহু পত্র-পত্রিকা এবং নথিপত্রে রয়েছে। এরপরও বার বার এ গণহত্যার ঘটনাকে অস্বীকার করে তারা আবারও গর্হিত কাজ করছে। মুক্তিযুদ্ধের একেবারে শেষ প্রান্তে এসে কী নারকীয়ভাবে এদেশের বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়েছেÑ তা বাঙালীরা কখনও ভুলবে না। এ হত্যাকা-ের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক যে শাস্তির দাবিÑ তা বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের দাবি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের দাবি ও শহীদ পরিবারের দাবি। একাত্তারে পরাজয় নিশ্চিত জেনে পাকিস্তানী বাহিনী তাদের দোসরদের সহায়তায় এ দেশের মেধাবী সন্তানদের হত্যা করে। সেই শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সোমবার গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছে জাতি। বাংলাদেশে চলমান মানবতাবিরোধী ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে মন্তব্য করায় জাতিসংঘ থেকে পাকিস্তানের সদস্যপদ বাতিলের দাবিও জানান তিনি। ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পূর্বক্ষণে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী পরিকল্পিতভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, চিকিৎসক, শিল্পী, লেখক, সাংবাদিকসহ বহু খ্যাতিমান বাঙালীকে হত্যা করে। এ হত্যাকা-ে প্রত্যক্ষ সহযোগিতা করে রাজাকার, আলবদর ও আল শামস বাহিনীর সদস্যরা। এর আগে বিজয় দিবস সামনে রেখে গত পহেলা ডিসেম্বর সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানের এক সমাবেশে পাকিস্তানের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কোন সম্পর্ক রাখবে না ঘোষণা দিয়ে আরেফিন সিদ্দিক বলেছিলেন, ঢাকা বিশ্ববিশ্ববিদ্যালয়ের কোন ছাত্র-প্রতিনিধি পাকিস্তানে যাবে না। পাকিস্তানকে বহিষ্কারের দাবি ॥ সার্কসহ যেসব আন্তর্জাতিক সংগঠনে বাংলাদেশ যুক্ত রয়েছে সেসব সংগঠন থেকে পাকিস্তানকে বহিষ্কার করার উদ্যোগ নেয়ার দাবি জানিয়েছে সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম-মুক্তিযুদ্ধ ’৭১। শীর্ষ দুই যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসির দ-াদেশ কার্যকরের পর পাকিস্তানের সাম্প্রতিক মন্তব্যের প্রতিবাদে বাংলাদেশে অবস্থিত পাকিস্তান হাইকমিশনে প্রতিবাদ লিপি পৌঁছে দিয়ে সংগঠনের পক্ষে এ দাবি জানানো হয়। ওই প্রতিবাদ লিপিতে দ্রুত সময়ে পাকিস্তানকে সকল অসত্য বক্তব্য প্রত্যাহার, ’৭১-এর গণহত্যার জন্য দায়ী পাকিস্তানের ১৯৫ সামরিক ব্যক্তির বিচার ও ক্ষতিপূরণের দাবি জানানো হয়েছে। সোবার সকাল ১১টায় প্রতিবাদ লিপি পৌঁছে দিতে সংগঠনটি মিছিল সহকারে রায়েরবাজার বধ্যভূমি থেকে গুলশানের উদ্দেশে রওনা দিলে পথিমধ্যে বনানী মাঠের কাছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের আটকে দেয়। পরে তিন সদস্যের প্রতিনিধি দল হাইকমিশনে প্রতিবাদ লিপি পৌঁছে দেয়। প্রতিনিধি দলে ছিলেন সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব) কে এম শফিউল্লাহ (বীরউত্তম), সিনিয়র সহ-সভাপতি লে. জেনারেল (অব) এম হারুন অর রশিদ (বীর প্রতীক) ও সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের সেক্রেটারি জেনারেল সাংবাদিক হারুন হাবীব। লিপিটি পৌঁছে দিয়ে এসে দুপুর দেড়টায় বনানী মাঠের সামনের সড়কে মানববন্ধন করে সংগঠনটি। পরে প্রতিবাদ লিপি পাঠ করে শোনানো হয়। প্রতিবাদ লিপিতে বলা হয়েছে, “আমরা পাকিস্তান সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই যে, পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধকে স্বীকার করে ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে ৯ এপ্রিল ১৯৭৪ তারিখে যে ত্রিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষর করে, তাতে স্পষ্ট অক্ষরে লেখা আছে : ‘পাকিস্তান সরকারের প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্রবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, তাদের সরকার সংগঠিত অপরাধের জন্য নিন্দা ও গভীর দুঃখ প্রকাশ করছে (অনুচ্ছেদ-১৩)।’ চুক্তির অনুচ্ছেদ-১৪ এ এটিও লক্ষণীয় যে, ‘পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী আমন্ত্রণ জানালে তিনি বাংলাদেশ সফর করবেন এবং বাংলাদেশের মানুষকে আহ্বান জানাবেন ক্ষমা করতে ও যাতে আগেকার সব ভুল-ত্রুটি ভুলে পুনরায় সমঝোতায় আসা সম্ভব হয়।’ লিপিতে আরও বলা হয়, ‘পাকিস্তান সরকারের সাম্প্রতিক বিবৃতিটি সেই ত্রিপক্ষীয় চুক্তিরও অস্বীকৃতি, যদিও পাকিস্তান নিজেই এর অন্যতম স্বাক্ষরদাতা। আমরা সত্যিকার অর্থেই বুঝতে অক্ষম যে, পাকিস্তান সরকার যখন দুই দেশের মানুষের মধ্যে সুসম্পর্কের কথা বলে তখন কী করে এরকম একটি বিবৃতি প্রদান করতে পারে!’ লিপিটিতে বলা হয়, ‘বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে আপনার সরকারের হস্তক্ষেপ পরিপূর্ণ নিন্দায় প্রত্যাখান করছি। আমরা ১৯৭১ এ বাংলাদেশের নিরীহ, নিরস্ত্র জনগণের ওপর পাকিস্তান বাহিনীর বর্বরতার জন্যে পাকিস্তানের নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা এবং পাকিস্তান পরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাম্প্রতিক বিবৃতিটি প্রত্যাহারের দাবি জানাচ্ছি। লিপিতে আরও বলা হয়, পাকিস্তান সরকারের কাছে আমরা আরও দাবি জানাচ্ছি যে, ১৯৭১ সালে যে ১৯৫ পাকিস্তানী সামরিক ব্যক্তি গণহত্যার দায়ে অভিযুক্ত হয়েছিল, তাদের বিচার করতে হবে এবং বাংলাদেশের ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।’ এর আগে রায়েরবাজার বধ্যভূমি থেকে রওনা দেয়ার সময় সেক্টর কমান্ডার্স ফোরমের সিনিয়র সহ-সভাপতি লে. জেনারেল (অব) এম হারুন অর রশিদ বলেন, ১৯৭১ সালে সেই র্ববরতা সংগঠিত হয়েছিলো সেটি আন্তর্জাতিক স্বীকৃত। সেই বর্বরতার বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সরকার যুদ্ধাপরাধের বিরুদ্ধে বিচার শুরু করেছে। বাংলাদেশে বিচার ব্যবস্থার সর্বোচ্চ আদালতের মাধ্যমে বিচার কার্য সম্পন্ন হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, পাকিস্তান অত্যন্ত দুঃখজনকভাবে সর্বোচ্চ আদালতের রায়কে ভঙ্গ করেছে। যুদ্ধাপরাধের দায়ে যাদের শাস্তি হয়েছে তাদের হয়ে কাজ করছে এবং তাদের পক্ষে বক্তব্য রাখছে। এতে প্রমাণিত হয় তারা পাকিস্তানের দোসর। সেই দোসরদের বাংলাদেশে জিইয়ে রাখার জন্য পাকিস্তান সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের পক্ষ থেকে আমরা জোর দাবি জানাই, পাকিস্তান সেই অসত্য বক্তব্য দিয়েছে সেই বক্তব্য প্রত্যাহার করবে। তিনি আরও বলেন, আমাদের তালিকাভুক্ত ১৯৫ যুদ্ধাপরাধীর বিচার কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত বিচার চালিয়ে যেতে হবে। তিনি বলেন, পাকিস্তান আমাদের দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করছে। আমরা এর প্রতিবাদ জানাই এবং বাংলাদেশ সরকারকে বলতে চাইÑ যেহেতু পাকিস্তান সরকার কোন নীতি মানে না, সেজন্য কোন আন্তর্জাতিক সংগঠন পাকিস্তানের সঙ্গে আমরা থাকবো না। সার্কসহ যেসব আন্তর্জাতিক সংগঠনে বাংলাদেশ যুক্ত রয়েছে সেসব সংগঠন থেকে পাকিস্তানকে বহিষ্কার করার উদ্যোগ নেয়া হোক।
×