ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

কলসকাঠীর গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধের গল্প

সেদিন শহীদের রক্তে লাল হয়েছিল দুটি খালের ঘোলা জল

প্রকাশিত: ০৫:৩২, ১৫ ডিসেম্বর ২০১৫

সেদিন শহীদের রক্তে লাল হয়েছিল দুটি খালের  ঘোলা জল

খোকন আহম্মেদ হীরা দিনটি ছিল ১৯৭১ সালের ১৪ মে শুক্রবার। সকাল সাড়ে আটটার দিকেই বরিশালের বাকেরগঞ্জ উপজেলার নদীঘেরা হিন্দু অধ্যুষিত ১৩ জমিদারের বিরানভূমি কলসকাঠী গ্রামবাসীর ওপর নেমে আসে অমাবস্যার ঘোর অন্ধকার। বিভিন্ন জেলা ও উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা ওই গ্রামের আশ্রয় নিয়েছেন। স্থানীয় কিছু স্বাধীনতাবিরোধীর এমন সংবাদের ভিত্তিতে এবং প্রত্যক্ষ মদদে হানাদার পাকি সেনারা গ্রামের প্রতিটি বাড়ির দরজায় গিয়ে নির্বিচারে নিরীহ গ্রামবাসীকে পাকড়াও শুরু করে। কেউ কেউ পালিয়ে যেতে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। সবদিক থেকেই পাকিস্তানী সৈন্যরা ১০/১৫ জনের গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পুরো গ্রামটিকে ঘেরাও করে বাড়ি বাড়ি গিয়ে তা-ব চালায়। সেদিন বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত কলসকাঠীর অর্ধশতাধিক বাড়ি-ঘরে চলে অগ্নিসংযোগ এবং বাজারের দোকানপাটসহ সহস্রাধিক বাড়িতে লুটতরাজ। সেদিন কুলাঙ্গাররা অর্ধশতাধিক নারীর সম্ভ্রমহানী ছাড়াও চার শতাধিক গ্রামবাসীকে হত্যা করে। এতেও ক্ষান্ত না হয়ে হায়েনারা ১০ নারীকে তুলে নিয়ে যায় তাদের ক্যাম্পে। সেখানে ৫ দিন আটক রেখে পাশবিক নির্যাতন চালিয়ে তাদের ছেড়ে দেয়া হয়। ওইদিন ঘাতক পাকি সেনাদের বুলেটে কলসকাঠীর দুটি খালের ঘোলাজল শহীদের রক্তে লাল হয়ে গিয়েছিল। স্থানীয়রা জানান, এলাকাবাসীর দীর্ঘদিনের দাবি ছিল কলসকাঠীর প্রায় চার শ’ শহীদের স্মরণে ওই এলাকায় সরকারী উদ্যোগে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ। কিন্তু তাদের সে দাবি আলোর মুখ না দেখায় অবশেষে স্বাধীনতার ৩৪ বছর পর ২০০৫ সালে স্থানীয়দের উদ্যোগে ক্ষুদ্র পরিসরে বাজারসংলগ্ন প্রাচীনতম কলসকাঠী সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়। যা বর্তমান প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বহন করছে। আজও ওই এলাকার অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধার নাম তালিকাভুক্ত হয়নি। কোন পরিবারকেই শহীদ পরিবারের স্বীকৃতি দেয়া হয়নি। স্থানীয়রা সরকারী উদ্যোগে শহীদদের স্মরণে ওই এলাকায় এক বিশাল স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণসহ প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকাভুক্তি ও শহীদ পরিবারের স্বীকৃতি দেয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। সূত্রমতে, দীর্ঘ ৪৪ বছরের ক্ষত আজও কাটিয়ে উঠতে পারেননি ওই এলাকার অসংখ্য পরিবার। ফলে দরিদ্রতা তাদের পিছু ছাড়েনি। কলসকাঠীসহ পার্শ্ববর্তী শ্যামপুর গ্রামের সেইদিনের পাকিসেনাদের সহযোগীরা এখনও বীরদর্পে রয়েছে। তারা এখনও সেই দিনের ন্যায় একের পর এক তা-ব চালিয়ে যাচ্ছে। যে কারণে আজও অনেক পরিবার পৈত্রিক ভিটেমাটি ছেড়ে সপরিবারে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। কলসকাঠী গ্রামে ঘাতকদের নির্মম বুলেটে সেদিন শহীদ হয়েছিলেন মুকুন্দ কুমার সেন ও তার পুত্র বাদল কুমার সেন। সে সময়ের দশম শ্রেণীর ছাত্র মুকুন্দ সেনের পুত্র বীর মুক্তিযোদ্ধা (তালিকাভুক্ত নন) বাবু কুমার সেন (৬১) সেদিনের লোমহর্ষক ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে এখনও আঁতকে ওঠেন। বলেন, গ্রামের কোন্ পাশে, কোন্ পাড়ায়, কোন্ লোকের বাস; কে কে পাকিস্তানের শত্রু, সব তথ্যের তালিকা ছিল পাকিসেনাদের হাতে। তাহলে কারা করেছিল এসব তালিকা। বরিশালে শান্তি কমিটি গঠন হওয়ার পর আব্দুর রহমান বিশ্বাস (খালেদা জিয়া তাকে রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত করেছিলেন) হন সভাপতি। আর সম্পাদক শাহজাহান চৌধুরী। সূত্রে আরও জানা গেছে, দীর্ঘ সময়ের অপারেশনে পাকিস্তানী হানাদার সৈন্য ও তাদের দালালরা সবাই যখন ক্লান্ত তখন দালাল আব্দুস সোবহান মোল্লা সৈন্যদের বিনোদনের জন্য নিজ বাড়িতে গ্রামের হিন্দু সম্প্রদায়ের সুন্দরী নারীদের ধরে এনে বাধ্য করে দেহদানের। গ্রামের অর্ধশতাধিক মেয়েরা হন হায়েনাদের লালসার শিকার। গর্ভবতী নারীও সেদিন রক্ষা পায়নি পশুগুলোর হাত থেকে। পরবর্তীতে ১০ নারীকে নিয়ে গিয়েছিল হায়েনারা। ৫ দিন তাদের আটক রেখে পাশবিক নির্যাতন চালিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়েছিল। অপরদিকে স্বাধীনতা যুদ্ধের উত্তাল মুহূর্তে একই উপজেলার শ্যামপুর গ্রামে পাকিসেনারা স্থানীয় চিহ্নিত রাজাকারদের সহযোগিতায় হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতা কুমুধ বন্ধু রায় চৌধুরী ওরফে নাটু বাবুসহ প্রায় ৫০ মুক্তিযোদ্ধাকে নির্মমভাবে হত্যা করে। রাজাকাররা শ্যামপুর গ্রামের শত শত ঘরবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে প্রকাশ্যে লুটপাট চালিয়ে অগ্নিসংযোগ করে। ওই নরপশুদের লালসার শিকার হয়েছিলেন গ্রামের অর্ধশতাধিক নারী। স্বাধীনতা যুদ্ধের দীর্ঘদিন পর বর্তমান সরকারের সময়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কাজ শুরু হলে স্থানীয় মৃত আব্দুল বারেক মৃধার পুত্র মোঃ বশির আহমেদ শ্যামপুর গ্রামের শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের জীবনাদর্শের ইতিহাস নিয়ে প্রতিবেদন তৈরির কাজ শুরু করেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে একই গ্রামের জাকির হোসেন মালেক (বর্তমানে শ্যামপুর বিএম আলিম মাদ্রাসার শিক্ষক হিসেবে কর্মরত) নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী পক্ষ ২০১৪ সালের ১৯ এপ্রিল রাতে বশির আহমেদের বাকেরগঞ্জ পৌর শহরের বাসায় হামলা চালায়। হামলাকারী মালেক ও তার সহযোগীরা বশির আহমেদকে না পেয়ে তার দু’শিশু কন্যাকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে বশিরের স্ত্রী আছমা বেগমের কাছ থেকে জোরপূর্বক কাগজে স্বাক্ষর আদায় করে। পরবর্তীতে পরিবারের সবাইকে হত্যার হুমকি দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দিয়ে বশির আহমেদের বাড়িঘর দখল করে নেয় জাকির হোসেন মালেক। স্থানীয় প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় স্বাধীনতাবিরোধীদের তা-বের পর থেকে আজ পর্যন্ত বৃদ্ধ মা ও স্ত্রী, সন্তানদের নিয়ে পৈত্রিক ভিটা ছেড়ে বশির আহমেদ কক্সবাজারে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। এ ঘটনায় মামলা দায়েরসহ প্রধানমন্ত্রী ও প্রশাসনের বিভিন্ন দফতরে লিখিত আবেদন করা সত্ত্বেও কোন সুফল মেলেনি।
×