ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

বরিশালে সাক্ষীদের অনুপস্থিতি, পুলিশের দায়সারা তদন্ত রিপোর্ট ও রাজনৈতিক নেতাদের অদৃশ্য প্রভাবে জট কমছে না

বিচারক ২৪ ॥ মামলা ৪৮ হাজার

প্রকাশিত: ০৬:২৩, ১৪ ডিসেম্বর ২০১৫

বিচারক ২৪ ॥ মামলা ৪৮ হাজার

খোকন আহম্মেদ হীরা, বরিশাল ॥ চল্লিশটি আদালতে বিচারাধীন মামলা রয়েছে ৪৮ হাজার ৬৭৬টি। এই পাহাড় সমতুল্য মামলার বিচার কাজের জন্য বর্তমানে বিচারক রয়েছেন মাত্র ২৪ জন। নতুন কোন মামলা না এলে উল্লেখিত সংখ্যক মামলার নিষ্পত্তি করতে সময় লাগবে একযুগ। তবে এর সঙ্গে প্রতিদিন গড়ে শতাধিক নতুন মামলা যুক্ত হচ্ছে। ফলে মামলার জট দিন দিন বেড়েই চলেছে। বিশেষ অনুসন্ধানে বরিশালের আদালতে মামলা জটের নেপথ্য কারণ খুঁজতে গিয়ে এ তথ্য বেরিয়ে এসেছে। বিচারপ্রার্থী ও প্রত্যাশীরা মনে করছেন, সাক্ষীদের অনুপস্থিতি, বেশিরভাগ মামলায় পুলিশের দায়সারা তদন্ত রিপোর্ট, রাজনৈতিক নেতাদের অদৃশ্য প্রভাব বিস্তারসহ আইনজীবী এবং আদালতের কর্মচারীদের আন্তরিকতার অভাবে মামলার জট কোন ক্রমেই কমছে না। সূত্রটি আরও দাবি করেছেন, শুধু আদালতের বিচারকের সংখ্যা বাড়ানো হলেই মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি হবে না। এসব সমস্যারও সমাধান করতে হবে। সূত্র জানায়, দ্রুত মামলা নিষ্পত্তির প্রথম ধাপ হচ্ছে তদন্ত সঠিকভাবে করে সময়মত রিপোর্ট জমা দেয়া। এরপর সাক্ষীদের সাক্ষ্য গ্রহণের তারিখে আদালতে উপস্থিত থাকা দরকার। যত দ্রুত সাক্ষ্য শেষ হবে তত দ্রুত মামলার নিষ্পত্তি হবে। তবে সাক্ষীদের হাজিরের জন্য আদালত থেকে নোটিস দেয়া হলেও আসামি পক্ষ অর্থের বিনিময়ে ওই নোটিসের খবর সাক্ষীদের জানতে দেয় না। পরবর্তীতে ওই সাক্ষীদের বিরুদ্ধে জারি করা হয় গ্রেফতারি পরোয়ানা। তাছাড়া নিজের সময় ও অর্থ ব্যয় করে সাক্ষ্য দিতে এসে হুমকির মধ্যেও পড়তে হয় স্বাক্ষীদের। আর এসব কারণে মামলার সাক্ষীরা নির্দিষ্ট সময় আদালতে সাক্ষী দিতে না আসায় মামলার বিচার কাজ বিলম্বিত হচ্ছে। শুধু সাক্ষীদের কারণে বরিশাল আদালতে কয়েক হাজার মামলা ঝুলে রয়েছে। একাধিক মামলার বাদী অভিযোগ করেন, মামলার তদন্তের সময় থেকেই তদন্ত কর্মকর্তাকে আসামি পক্ষ প্রভাবিত করার চেষ্টা করে। বেশিরভাগ সময় নিজেদের রক্ষা বা রিপোর্ট পক্ষে নিতে উৎকোচ দেয় তারা। এতেও কাজ না হলে তারা দ্বারস্থ হয় রাজনৈতিক নেতাদের। এসব চাপের কারণে তদন্ত কাজ ব্যাহতসহ রিপোর্টে দেখা দেয় গরমিল। এরপর শুরু হয় মামলার বিচার কাজ। অভিযোগ গঠনের পর সাক্ষীদের আদালতের ধার্য করা নির্ধারিত তারিখে হাজির হতে নির্দেশ দেয়া হয়। কোন কোন ক্ষেত্রে নির্ধারিত তারিখে সাক্ষীরা নিজ থেকে বা পুলিশ তাদের হাজির করতে না পারায় আদালত পরবর্তী তারিখ ঘোষণা করতে বাধ্য হয়। পরবর্তী তারিখেও সাক্ষীরা হাজির না হলে আদালত আবারো সমন জারি করে। সাক্ষীদের আদালতে হাজিরের সমন জারি করা হলেও আসামি পক্ষের মাধ্যমে প্রভাবিত হয়ে তাদের ওই সমন জানতে দেয়া হয় না। তবে এ ক্ষেত্রে বাদী যদি বিষয়টি জানতে পারে তাহলে সে তার মামলার সুষ্ঠু বিচারের আশায় আদালত থেকে কাগজপত্র বের করে সাক্ষীদের নির্দিষ্ট তারিখে হাজির করে। আর বাদীর কোন হস্তক্ষেপ না থাকলে সাক্ষী কোনভাবে জানতে পারে না নির্দিষ্ট তারিখ। তবে ৩ থেকে ৪ বার সমন জারির পরেও সাক্ষী না এলে আদালত থেকে সাক্ষীদের বিরুদ্ধে জারি করা হয় গ্রেফতারি পরোয়ানা। তখন সাক্ষীদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির কপি নিয়ে হাজির হয় পুলিশ। সাক্ষী গ্রেফতার এড়াতে অর্থের মাধ্যমে পুলিশকে বিদায় দিয়ে নির্ধারিত তারিখে আদালতে হাজির হওয়ার অঙ্গীকার করে রক্ষা পায়। জেলা ও দায়রা জজ আদালতের নাজির জালাল আহমেদ জানান, বরিশাল জজশীপের বিচারকের ১৭টি পদের মধ্যে ৪টি পদ দীর্ঘদিন ধরে শূন্য রয়েছে। একজন বিচারক এক মাসেরও বেশি সময় ধরে রয়েছেন ছুটিতে। ফৌজদারি মামলার সেরেস্তাদার আঃ কাদের জানান, জেলা জজশীপে বিচারাধীন রয়েছে ২ হাজার ৯২৯টি ফৌজদারি মামলা। দেওয়ানী মামলার সেরেস্তাদার আবুল হোসেন জানান, জেলা জজশীপের ১৭টি আদালতে ২৪ হাজার ৫৭৫টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। অপরদিকে চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের অধীনে ১১ পদের সাতটি এবং চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের ৫টি পদের তিনটি দির্ঘদিন ধরে শূন্য আছে। চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ৮ হাজার ৫৪৪ এবং মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে বিচারাধীন মামলা রয়েছে ৫ হাজার ৫২৩টি। এছাড়া নারী ও শিশু নির্যাতন অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনালে ২ হাজার ৫২০ মামলা, ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনালে ২ হাজার ৮৮৮টি, জননিরাপত্তা বিঘœকারী অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ৪৫৬, বিভাগীয় স্পেশাল জজ আদালতে ৩১৬টি, প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালে ৩২টি, বিদ্যুত আদালতে ৬শ’, টিএ্যান্ডটি আদালতে ৩৫০টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। তবে ব্যতিক্রম চিত্র দেখা গেছে, বরিশাল দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে। এ আদালতে বিচারাধীন মামলা রয়েছে মাত্র একটি। বাকি ৮টি মামলা উচ্চ আদালতের নির্দেশে স্থগিত হয়ে রয়েছে। আইনজীবীরা জানান, অন্য আদালতগুলোতে মামলার স্তূপ জমলেও দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে মাত্র একটি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। মামলা প্রেরণে জটিল প্রক্রিয়ার কারণে আদালতের কর্মচারীরা বেশিরভাগ অলস সময় পার করছেন।
×