ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

জঙ্গীবাদকে রুখে দাঁড়ানোর স্লোগানে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের বিজয় উৎসব শুরু

মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাঙালীর রাষ্ট্র খুঁজে নিচ্ছে ঠিকানা

প্রকাশিত: ০৫:২০, ১৪ ডিসেম্বর ২০১৫

মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাঙালীর রাষ্ট্র খুঁজে নিচ্ছে ঠিকানা

জনকণ্ঠ রিপোর্ট ॥ পেরিয়েছে বিজয়ের ৪৪ বছর। তাই এখন আর কষ্ট করে কাউকে স্বাধীনতার অর্থ খুঁজতে হয় না। মুক্তিযুদ্ধের চিরঅম্লান চেতনার পথরেখায় স্বাধীনতা খুঁজে নিচ্ছে তার সুনির্দিষ্ট ঠিকানা। ইতোমধ্যে একাত্তরের বিশ্বাসঘাতক-নরঘাতকদের অনেকেরই বিচার সম্পন্ন হয়েছে। এগিয়ে চলছে আরও অনেক মানবতাবিরোধী অপরাধীর শাস্তির প্রক্রিয়া। অজস্র প্রতিকূলতা ও ষড়যন্ত্রের বেড়াজাল ছিন্ন করে বাঙালীর রাষ্ট্র বাংলাদেশ ধাবিত হচ্ছে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যের পানে। বিশ্বদরবারে অধিষ্ঠিত হচ্ছে গৌরবের আসনে। আর এমনই স্বপ্নমাখা উচ্চারণের মধ্য দিয়ে শুরু হলো সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের বিজয় উৎসব। উৎসব প্রাঙ্গণ বায়ান্নর ভাষা শহীদদের স্মৃতির স্মারক কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বারবার বলা সেই প্রত্যয়ের কথা। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পথে জঙ্গীবাদকে দাঁড়াও রুখে স্লোগানে রবিবার হেমন্তের বিকেলে আট দিনব্যাপী এ উৎসবের সূচনা হয়। উৎসব উদ্বোধন করেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দসৈনিক ও কালজয়ী সুরস্রষ্টা সুজেয় শ্যাম। শুরুতেই এ উৎসব উদ্বোধনে আয়োজকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে তিনি বলেন, স্বাধীনতার ৪৪ বছর পর আজ যে সম্মান পেলাম তাতে নিজেকে ধন্য মনে করছি। এরপর তরুণ প্রজন্মের উদ্দেশে তিনি বলেন, স্বাধীন বাংলা বেতারে আমরা হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রীস্টান একসঙ্গে কাজ করেছি। সবাই মিলে গেয়েছি স্বাধীনতার গান। একাত্তরে আমাদের পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্তি দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তবে পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের পর দেশটা যেন দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেল। মুক্তিযুদ্ধের চার বছর পর দেশটা যেন পাল্টে গেল। মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যেও কেউ কেউ বিপথগামী হলো। তারা হয়ে গেল পাকিস্তানপন্থী। এখনও সে অংশটি ষড়যন্ত্র করছে। তাই তরুণ প্রজন্মকে সঠিকভাবে ইতিহাস পাঠ করতে হবে। আমরা এক থাকলে ওরা কিছুই করতে পারবে না। এদেশ এগিয়ে যাবে তার আপন গতিতে। উৎসবের ঘোষণাপত্র পাঠ করেন নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার। তার বক্তৃতায় উঠে আসে স্বদেশের নবজাগরণের কথা। তিনি বলেন, বাংলাদেশ আবার বিশ্বসভায় গৌরবের আসনের দাবিদার হয়ে উঠছে। দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে প্রাণিত নবযাত্রার পথে এগিয়ে যেতে দেশের মানুষ, বিশেষভাবে তারুণ্যের তাগিদ প্রকাশিত হচ্ছে নানাভাবে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে প্রদত্ত গণরায়ের ভিত্তিতে গঠিত হয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত। ট্রাইব্যুনাল একের পর এক যুদ্ধাপরাধের বিচার সম্পন্ন করে চলেছে। এ বিচারপ্রক্রিয়া একাত্তরের জঙ্গী মৌলবাদী গোষ্ঠী পরিচালিত নৃশংসতার স্বরূপ নানাভাবে মেলে ধরছে এবং জাতীয় চেতনায় ঐক্যবদ্ধ অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নির্মাণের গুরুত্ব পুনরায় প্রকাশ করছে। আমরা যুদ্ধাপরাধের বিচারপ্রক্রিয়া দ্রুততর করার দাবি উত্থাপন করছি। সেই সঙ্গে স্মরণ করি দীর্ঘ চার দশক পরে হলেও গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার দ্বারা বাংলাদেশ বিশ্বসমাজের সামনে উজ্জ্বল উদাহরণ মেলে ধরেছে। জাতিগত অধিকার ও বৈচিত্র্য মুছে দিয়ে সংঘাত ও ধর্মান্ধতার আবর্তে বিশ্বসমাজের তলিয়ে যাওয়ার পটভূমিকায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ আদর্শ দেখাচ্ছে মানবমুক্তির পথ। দেশের সকল শহীদের স্মরণে শহীদ মিনারের মূল বেদিতে আয়োজকসহ অতিথিদের পুষ্পাঞ্জলি অর্পণের মাধ্যমে সূচনা হয় উৎসবের। এরপর শহীদদের স্মরণে পালন করা হয় এক মিনিটের নীরবতা। নীরবতা থামতেই বাংলাদেশ গণসঙ্গীত সমন্বয় পরিষদের শিল্পীদের কণ্ঠে পরিবেশিত হয় জাতীয় সঙ্গীত। আমার সোনার বাংলার সুরটি ছড়িয়ে পড়ে উৎসব আঙিনায়। গান শেষে আকাশে উড়িয়ে দেয়া হয় একগুচ্ছ রঙিন বেলুন। সেই সঙ্গে উৎসবের উদ্বোধন ঘোষণা করা হয়। আলোচনার আগে সুজেয় শ্যামের সুরারোপিত বিজয় নিশান উড়ছে ঐ গানের তালে নৃত্য পরিবেশন করে স্পন্দনের শিল্পীরা। নাচের সঙ্গে শিল্পীদের হাতে উড়তে থাকে লাল-সবুজের জাতীয় পতাকা। আলোচনা শেষে অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্বে ছিল গান, কবিতা ও কোরিওগ্রাফিতে সাজানো দেশপ্রেমের সাক্ষ্যবহ সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। জোটের সভাপতি ও উৎসব উদ্্যাপন পরিষদের আহ্বায়ক গোলাম কুদ্দুছের সভাপতিত্বে আলোচনায় অংশ নেনÑ লেখক-গবেষক ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক, নাট্যব্যক্তিত্ব মামুনুর রশীদ, পথনাটক পরিষদের সভাপতি মান্নান হীরা, জোটের সাবেক সভাপতি এবং চলচ্চিত্র ও নাট্য নির্মাতা নাসির উদ্দিন ইউসুফ, জোটের সহসভাপতি ঝুনা চৌধুরী প্রমুখ। স্বাগত বক্তব্য রাখেন জোটের সাধারণ সম্পাদক আবৃত্তিশিল্পী হাসান আরিফ। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন আবৃত্তিশিল্পী মাসকুর-এ-সাত্তার কল্লোল। মফিদুল হক বলেন, জীবনের জয়গান গাওয়ার জন্য আজ আমরা হাজির হয়েছি এ উৎসবে। গান, কবিতা ও নাটকের মাধ্যমে প্রতিধ্বনিত হবে সেই জয়গান। নাসির উদ্দিন ইউসুফ বলেন, ২৫ বছর ধরে চলমান এ বিজয় উৎসব আজ মনে করিয়ে দিচ্ছে জঙ্গীবাদকে মোকাবেলা করে দেশে বিচার হচ্ছে যুদ্ধাপরাধীদের। মামুনুর রশীদ বলেন, মুক্তিযুদ্ধের ৪৪ বছর পর স্বাধীন বাংলা বেতারের একজন শিল্পীর এ উৎসব উদ্বোধন করার বিষয়টি বহন করে বিশেষ তাৎপর্য। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলছে তখন সম্পূর্ণ অযৌক্তিক ও অন্যায়ভাবে এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে নানা তৎপরতায় লিপ্ত হয়েছে পাকিস্তান। স্বাগত বক্তৃতায় হাসান আরিফ বলেন, জোট আয়োজিত এ বিজয় উৎসবের ২৫ বছর পূর্ণ হচ্ছে এবার। এমন মুহূর্তে স্মরণ করছি ১৯৯০ সালে এ উৎসবের নেতৃত্ব দেয়া ফয়েজ আহমদকে। প্রায় সব জেলাতেই ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে এ উৎসবকে। ঢাকা নগরীতেও বিস্তৃত পরিসরে অনুষ্ঠিত হচ্ছে এবারের আয়োজন। এ শহর যেন আজ পরিণত হয়েছে বিজয় উৎসবের শহরে। তিনি আরও বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে এখন আর কোন সংশয় নেই। কারণ এ বিষয়ে সরকার অটল। আলোচনা শেষে সন্ধ্যার পর দ্বিতীয় পর্বে শুরু হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। ততক্ষণে শহীদ মিনারে জড়ো হয়েছে দেশপ্রেমের চেতনায় উজ্জীবিত নানা শ্রেণী-পেশার মানুষ। তাদের মন রাঙিয়ে একক কণ্ঠে গান শোনান সমর বড়ুয়া ও আরিফ রহমান। কবিতার দোলায়িত ছন্দে একক কণ্ঠে আবৃত্তি পরিবেশন করেন ডালিয়া আহমেদ ও এনামুল হক বাবু। মহাকাল নাট্য সম্প্রদায় পরিবেশন করে জাগো শীর্ষক কোরিওগ্রাফি। আজ সোমবার থেকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারসহ মোট ১১টি মঞ্চে চলবে এ উৎসব। নাচ, গান, আবৃত্তি, নাটক, চলচ্চিত্র, আলোচনাসহ নানা আয়োজনে প্রতিদিন বিকেল ৪টা থেকে শুরু হয়ে রাত ৮টা পর্যন্ত চলবে অনুষ্ঠান। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত চলবে অনুষ্ঠান। আজ ১৪ ডিসেম্বর বিকেল ৪টায় রায়েরবাজার শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ মঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে বুদ্ধিজীবী হত্যা দিবসের আলোচনা। ১৬ ডিসেম্বর সকাল ১০টায় শহীদ মিনার থেকে বের করা হবে বিজয় শোভাযাত্রা। ধানম-ির রবীন্দ্র সরোবরে, রায়েরবাজার শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ, স্বোপার্জিত স্বাধীনতা চত্বর (টিএসটি), মিরপুর মুকুল ফৌজ মাঠ, মিরপুর বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ প্রাঙ্গণ, প্রভাত মাঠ, সুবল দত্ত ও টিঅ্যান্ডটি কলোনি মঞ্চে ১৪ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত চলবে অনুষ্ঠান। দনিয়া বর্ণমালা স্কুল ও কলেজ প্রাঙ্গণ মঞ্চে ১৬ থেকে ১৮ ডিসেম্বর, উত্তরা রবীন্দ্র সরণি মঞ্চে ১৭ থেকে ১৮ ডিসেম্বর, বাহাদুর শাহ্ পার্ক মঞ্চে ১৯ থেকে ২০ ডিসেম্বর পর্যন্ত অনুষ্ঠান চলবে।
×