ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সাক্ষী সুরক্ষা আইন করতে হাইকোর্টের নির্দেশ

প্রকাশিত: ০৫:১৩, ১৪ ডিসেম্বর ২০১৫

সাক্ষী সুরক্ষা আইন করতে হাইকোর্টের নির্দেশ

বিকাশ দত্ত ॥ সাক্ষী সুরক্ষা আইন করতে যখন স্বরাষ্ট্র ও আইন মন্ত্রণালয় উদ্যোগ নিতে দেরি করছে, ঠিক তখনই হাইকোর্ট থেকে এই আইন করতে দুই মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এই নির্দেশকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা এবং প্রসিকিউশন শাখা সাধুবাদ জানিয়ে বলেছে, এটা একটা মাইলফলক নির্দেশ। শুধু মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্যই নয় মামলার ক্ষেত্রেই এ আইনটি হতে হবে। তা হলেই জনগণ সুবিচার পাবে সাক্ষীরা কোন প্রকার নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবে না। নির্বিঘেœ সাক্ষীরা তাদের সাক্ষ্য প্রদান করতে পারবেন। মামলাগুলোও দ্রুত নিষ্পত্তি হবে। স্বাধীনতার দীর্ঘদিন পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে। এই বিচারে যারা মুখ্য ভূমিকা পালন করেছেন সেই সাক্ষীদের জন্য এখনও সাক্ষী সুরক্ষা আইন হয়নি। ফলে যারা সাক্ষ্য দিয়েছেন বা দিবেন তাদের জন্য জীবন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে। ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর এ পর্যন্ত ২১টি মামলায় ২৪ জনকে দ- দেয়া হয়েছে। বর্তমানে ট্রাইব্যুনালে আরও অর্ধডজন মামলা এসেছে। এতে ৬ শতাধিক সাক্ষী তাদের সাক্ষ্য প্রদান করেছেন। সাক্ষী সুরক্ষার জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা ও প্রসিকিউশন শাখা পৃথক পৃথকভাবে সাক্ষী সুরক্ষা আইনের জন্য প্রস্তাব পাঠালে এখন পর্যন্ত কোন অগ্রগতি নেই। যখন দুই মন্ত্রণালয় একে অপরের কথা বলছে ঠিক তখন সাক্ষী সুরক্ষা আইন করার উদ্যোগ নিতে স্বরাষ্ট্র ও আইন মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য এবং নির্ধারিত তারিখে সাক্ষীর উপস্থিতি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এই আইন করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। একটি হত্যা মামলার আসামির জামিন শুনানির সময় বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি আমীর হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট দ্বৈত বেঞ্চ এই ঐতিহাসিক আদেশটি প্রদান করেছেন। স্বরাষ্ট্র সচিব ও আইন সচিবকে এই আদেশ পালনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তদন্ত সংস্থার সমন্বয়ক সানাউল হক জনকণ্ঠকে বলেছেন, সাক্ষী সুরক্ষা আইন করতে আমরা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এবং আইন মন্ত্রণালয়ে যে আবেদন করি তার কোন অগ্রগতি নেই। এরই মধ্যে হাইকোর্ট থেকে এ আইন করতে একটি দিকনির্দেশনা দেয়া হয়েছে। আমি মনে করি এটি খুবই পজেটিভ দিক। কারণ বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে চেয়ারম্যান ছিলেন। তখন তিনি দেখেছেন সাক্ষীর অভাবে অনেক ক্ষেত্রে প্রসিকিউশনদের ফরমাল চার্জ দিতে দেরি হয়েছে। এ ছাড়া শুধু মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলাই নয় সমস্ত মামলাতেই সাক্ষীদের জন্য এই আইনটা থাকা প্রয়োজন। বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ বিষয়টি অনুধাবন করেই এমন আদেশ প্রদান করেছেন। সব মামলাতেই সাক্ষীদের জন্য সুরক্ষা না দিলে সুবিচার পাওয়া যাবে না। সানাউল হক আরও বলেন, জেলা পর্যায়ে কমিটির পাশাপাশি কেন্দ্রীয় কমিটিও রয়েছে। কেন্দ্রীয় কমিটিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবকে (রাজনৈতিক) প্রধান করে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। সেই কমিটিতে পুলিশ, র‌্যাব, ডিজিএফআই, এনএসআই, এসবি, তদন্ত সংস্থার প্রতিনিধি রয়েছেন। তিনি আরও বলেন, কেন্দ্রীয় কমিটির পাশাপাশি জেলা কমিটি রয়েছে। সাক্ষীদের কল্যাণে যা যা করা প্রয়োজন এ কমিটি তা করবে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে একটি খসড়া আইন মন্ত্রণালয়ে গেছে, আইন মন্ত্রণালয় সেটি অনুমোদন করলেই সকল সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। তখন সাক্ষীদের নিরাপত্তার বিষয়টি সরকারের বাইন্ডিংয়ে থাকবে। প্রশাসন যাতে সাক্ষীদের সহজে চিনতে পারে সে জন্য তাদের জন্য পরিচয়পত্র দেয়া হচ্ছে। এতে তারা প্রশাসনের কাছে ত্বরিতগতিতে পৌঁছতে পারবেন। তিনি আরও বলেন, আমি ব্যক্তিগতভাবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে খোঁজ নিয়েছি। আইন মন্ত্রণালয়ে ড্রাফটিংটি থাকতে পারে। সেখানেও খোঁজ নিয়েছি কোন সন্তোষজনক জবাব পাইনি। মিসিং হয়ে গেল কিনা? আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রুলসের ৫৮(ক) ১-এ বলা হয়েছে ট্রাইব্যুনাল স্ব-উদ্যোগে বা কোন পক্ষের আবেদনের প্রেক্ষিতে সাক্ষী এবং অথবা ভিকটিমের সুরক্ষা, গোপনীয়তা এবং কল্যাণ নিশ্চিত করণার্থে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশসহ প্রয়োজনীয় আদেশ দিতে পারেন। এই প্রক্রিয়ায় গোপনীয়তা থাকবে এবং অপর পক্ষকে অবহিত করা হবে না। এদিকে প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ জনকণ্ঠকে বলেছেন, সাক্ষী সুরক্ষার জন্য হাইকোর্ট যে নির্দেশ প্রদান করেছেন তাকে আমি সাধুবাদ জানাই। এই নির্দেশটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অনেক আগেই এটি হওয়া উচিত ছিল। সাক্ষীদের অভাবে অনেক গুরুত্বপূর্ণ মামলা ড্রপ করতে হয়েছে। সাক্ষী সুরক্ষা আইনটি করলে যদি অত্যন্ত ব্যয়বহুল হয়, তা হলে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা সাক্ষীদের জন্য একটি আইন করা যেতে পারে। বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ট্রাইব্যুনালে চেয়ারম্যান থাকা অবস্থায় আমাদের সমস্যাগুলো অনুধাবন করতে পেরেছেন। এ ছাড়া অন্য যে সমস্ত মামলা আছে সেখানে সাক্ষী পাওয়া কঠিন। সেই আলোকেই বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ এমন নির্দেশ দিয়েছেন। ৭ ডিসেম্বর সাক্ষী সুরক্ষা আইন করতে স্বরাষ্ট্র ও আইন মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। মামলার নির্ধারিত তারিখে সাক্ষীর উপস্থিতি ও তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এই আইন করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সমন পাওয়ার পর নির্ধারিত তারিখে সাক্ষী উপস্থিত না হলে সংশ্লিষ্ট পিপি ও পুলিশ কর্মকর্তাকে জবাবদিহিতার আওতায় আনার বিধান যুক্ত করারও নির্দেশ দেয়া হয়েছে। একটি হত্যা মামলার আসামির জামিন শুনানির সময় বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি আমীর হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন। স্বরাষ্ট্র সচিব ও আইন সচিবকে এই আদেশ পালনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আদালত সূত্রে জানা গেছে, ২০০০ সালের ১৪ জুন রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে রিংকু নামের এক ব্যক্তিকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় হীরা ওরফে হারুন নামের এক ব্যক্তিকে একই বছরের ১০ জুলাই গ্রেফতার করে পুলিশ। এ মামলায় ঢাকার অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ-৩য় আদালতে ২০১২ সালের ৫ জুন অভিযোগ গঠন করা হয়। এরপর প্রায় ৮ থেকে ১০ বার সাক্ষীকে সমন করা হয়। কিন্তু সাক্ষীরা হাজির হননি। এর মধ্যে আসামিপক্ষ জামিনের জন্য হাইকোর্টে আবেদন করেন। এ আবেদনের পর হাইকোর্ট সংশ্লিষ্ট আদালতের অতিরিক্ত পিপিকে তলব করে। এ আদেশ অনুসারে অতিরিক্ত পিপি আসাদুজ্জামান হাইকোর্টে হাজির হয়ে বলেন, আসামি খুব ভয়ঙ্কর। তার ভয়ে কেউ সাক্ষী দিতে আসেন না। পরে হাইকোর্ট আসামির জামিন আবেদন খারিজ করে দিয়ে সাক্ষী সুরক্ষা আইন প্রণয়নে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে সরকারের দুই সচিবকে নির্দেশ দেন। এসব দিক বিবেচনা করেই সাক্ষীদের জন্য সাক্ষী সুরক্ষা আইন খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
×