ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মিলু শামস

সাহিত্য ও রাজনীতির গতিশীল ভূমি

প্রকাশিত: ০৪:০২, ২ ডিসেম্বর ২০১৫

সাহিত্য ও রাজনীতির গতিশীল ভূমি

ঔপনিবেশিক স্পেনের ক্ষয়িষ্ণু অভিজাতদের অন্তঃসারশূন্যতাকে অসাধারণ দক্ষতায় তুলে ধরার অপরাধে লাতিন আমেরিকার স্প্যানিশ উপনিবেশগুলোয় দু’ শ’ বছর নিষিদ্ধ ছিল সের্ভান্তেসের দন কিহোতে। তারপরও স্প্যানিশ ভাষার সবচেয়ে বেশি পঠিত লেখক সের্ভান্তেস, পরের আসনটি অনিবার্যভাবেই মার্কেজের। ‘সিয়েন আনিয়োস দে সোলেদাদ’ বা ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ার্স অব সলিটিউড (নিঃসঙ্গতার এক শ’ বছর)-এর সঙ্গে পরিচয়ের বহু আগে এদেশের পাঠকের সঙ্গে ‘দন কিহোতে’ বা ডন কুইক্সোট-এর পরিচয় হলেও মিগেল দে সের্ভান্তেসের (১৫৬৪-১৬১৬) তুলনায় গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের (১৯২৭-২০১৪) সঙ্গে তাদের সম্পর্ক অনেক বেশি নিবিড়। সব কটি প্রধান ভাষায় অনূদিত হওয়ার সুবাদে অনুবাদ সাহিত্যেও বিশ্বের সবচেয়ে বেশি পঠিত লেখক মার্কেজ। সময়ের হিসেবে সের্ভান্তেস ও মার্কেজের মধ্যে তিন শ’ বছরের ব্যবধান হলেও ঔপনিবেশিক আধিপত্য ও এর বিরুদ্ধে জনগণের মুক্তি সংগ্রামের আকাক্সক্ষার অন্তর্নিহিত রূপের বিশ্বস্ত দলিল তারা নিজের মতো করে রেখে গেছেন ‘সভ্য’ দুনিয়ার কাছে। ব্যবধানের তিন শ’ বছরে লাতিন আমেরিকার জাতীয় মুক্তির ইতিহাস রচিত হয়েছে সিমন বলিভারের নেতৃত্বে। স্পেনের ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে সমগ্র লাতিন আমেরিকাকে জাগিয়ে সশস্ত্র লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে বলিভার স্পেনের অধীনতা থেকে মুক্ত করেছিলেন বলিভিয়া, পানামা, কলম্বিয়া, ইকুয়েডর, পেরু ও ভেনিজুয়েলাকে। প্রতিষ্ঠিত হয় বেশ কিছু জাতীয় প্রজাতন্ত্র। তবে বলিভার ঔপনিবেশিক শাসন থেকে লাতিন আমেরিকাকে রাজনৈতিক মুক্তি দিলেও দীর্ঘদিনের শোষণ-বঞ্চনায় জর্জরিত দেশগুলোর স্বাভাবিক বিকাশ স্তব্ধ হয়ে থাকে আরও প্রায় এক শ’ বছর। বিশ শতকে এসে জাতীয় মুক্তির দ্বিতীয় পর্বের যুদ্ধে অবরুদ্ধ লাতিন আমেরিকা, পাবলো নেরুদার ভাষায় ‘বোবা মহাদেশ’টি ভাষা পায় তার শ্রেষ্ঠ সন্তানদের কলমে। আর বলিভারের রাজনৈতিক সংগ্রামের রিলে হাতে এগিয়ে চলেন ফিদেল ক্যাস্ট্রো, চে গুয়েভারা, আগাস্তো সান্ডিনোরা। সের্ভান্তেসের উত্তরসূরিদের কলমে ভর করে পাহাড়-অরণ্যঘেরা মিথ আর লৌকিক-অলৌকিক বিশ্বাসের লাতিন আমেরিকা তার সব রহস্যময়তা নিয়ে হাজির হয় এদেশের পাঠকের দরবারেও। কেমন যেন চেনা মনে হয় তাকে। চেনা শোষণ। আধিপত্যবাদের নিগড়ে বৃত্তাবদ্ধ চেনা জীবন। চেনা সংগ্রাম, চেনা লড়াই। সব কিছু চেনা চেনা। তবে এত চেনার মধ্যেও গভীরতর অচেনা কিছুও নিশ্চয়ই ছিল। তাই দু’বার ঔপনিবেশিক শোষণ-শাসন থেকে মুক্ত আমাদের এ অঞ্চল লাতিন আমেরিকার চরিত্রের দিক হতে আলাদা। অনন্য। নয়া উদারবাদী অর্থনীতি বা একচেটিয়া পুঁজিতন্ত্রের বিশ্বায়নে হাত-পা গুটিয়ে আত্মসর্মপণকে আমাদের মতো দেশগুলো যখন অনিবার্য বাস্তবতা বলে মেনে নিয়েছে তখন পুঁজিবাদী কেন্দ্রের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশটির নিকটতম প্রতিবেশী লাতিন আমেরিকার অনেক দেশই পুঁজিবাদকে প্রত্যক্ষ চ্যালেঞ্জ করে টিকে আছে। বেশ প্রতাপেই টিকে আছে বলা যায়। নয়া উদারবাদী অর্থনীতি জনকল্যাণমুখী কাজে রাষ্ট্রীয় ব্যয় কমানোর পরামর্শ দিয়ে লাভজনক রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যক্তি খাতে ছেড়ে দিয়ে ব্যাপক বেসরকারীকরণের কথা বলে। শিক্ষা চিকিৎসা খাদ্য বাসস্থান ইত্যাদি জনগণের মৌলিক প্রয়োজনীয় খাতগুলোতে ভর্তুকি বন্ধের কথা বলে। পুঁজিবাদী বিশ্বায়নের এ চক্রে পড়ে আমাদের মতো দেশগুলোর সাধারণ মানুষের জীবনে নাভিশ্বাস ওঠে। আর সিমন বলিভার ফিদেল ক্যাস্ট্রোর লাতিন আমেরিকায় প্রাকৃতিক সম্পদ জাতীয়করণের অর্থ জনকল্যাণে ব্যয় হয়। জনগণের শিক্ষা স্বাস্থ্য আবাসন সমস্যার সমাধানকে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব মনে করা হয়। যেসব কর্পোরেশনের দাপটে মুক্ত পুঁজির দুনিয়া থরথর করে কাঁপে সেসব কোম্পানির স্থানীয় প্রতিনিধিদের পরিষ্কার বলে দেয়া হয় ও দেশে ব্যবসা করতে হলে তাদের শর্ত মেনেই করতে হবে। নইলে পাততাড়ি গুটিয়ে কোম্পানিগুলো নিজ নিজ দেশে চলে যেতে পারে। তবে দক্ষিণ আমেরিকার সাম্প্রতিক প্রতিবাদী ভূমিকার ফ্ল্যাশব্যাকে রয়েছে সাম্রাজ্যবাদ নখরের দগদগে ঘা। শোষণের পর শোষণে নিঃস্ব ও একাকী হওয়ার আখ্যান। সের্ভান্তেস যে গল্প বলেছেন তা থেকে এ সম্পূর্ণ আলাদা। আগ্রাসি ও আধিপত্যবাদী। লাতিন আমেরিকার স্বকীয়তা ধ্বংস করার অবিরাম প্রচেষ্টা তাকে মানসিকভাবেও পরনির্ভর করতে চায়। একজন দায়িত্বশীল দেশপ্রেমিকের কর্তব্য এই স্বকীয়তা রক্ষা করা। স্বকীয়তা রক্ষার বৈপ্লবিক দায় থেকেই হয়ত জন্ম নেয় ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ার্স অব সলিটিউড-এর মতো উপন্যাস। গণমানুষের সংস্কার বিশ্বাস-অবিশ্বাস, লৌকিক-অলৌকিকের গল্প শুনিয়ে বিশ্বসাহিত্য তোলপাড় তুলে লাতিন আমেরিকাকে এক টানে মার্কেজ নিয়ে আসেন উজ্জ্বল আলোর আসরে। শুধু নোবেলজয়ী উপন্যাসেই নয়, তাঁর গোটা সাহিত্যকর্মই নিপীড়িত সাধারণ মানুষের জীবন ও সংগ্রাম তাদের হাসি কান্না স্বপ্ন কল্পনার অসামান্য চিত্রায়ন। ঔপনিবেশিক শাসনের কৃত্রিম সমাজের কৃত্রিম ব্যক্তি মার্কেজের মনোযোগ কাড়তে পারেনি। কৃত্রিম ইতিহাসের আড়ালে চাপাপড়া সাধারণ মানুষের স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গ, আবার স্বপ্ন দেখার শক্তি এবং সাহস নিয়ে ঘুরে দাঁড়ানো, যা গৎবাঁধা চকচকে ইতিহাস লিখিয়েদের মনোযোগের বাইরের বিষয়, মার্কেজ তাকেই লেখার উপজীব্য করেছেন। সব কৃত্রিমতার বাইরে যেখানে বয়ে চলেছে জীবনের সত্যিকারের স্রোত সেই বহমানতাকে তার নিজস্বতা ও সমগ্রতাসহ তুলে এনেছেন নিজের বিশাল ক্যানভাসে। একটি আদিম খ্রিস্ট ধর্মীয় অতি প্রাকৃত সংস্কারের এক শ’ বছর ধরে এক পরিবারের চার প্রজন্মকে তাড়িয়ে নেয়ার গল্পের মধ্যে যে অভিনবত্ব মার্কেজের আগে তা অন্য কোন সাহিত্যিক সম্ভবত এভাবে দেখাতে পারেননি। লাতিন আমেরিকার এক স্প্যানিশ বসতির ভাইবোন সম্পর্কের দুই তরুণ-তরুণীর বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া এবং এ বিয়ের পরিণাম হিসেবে অতিপ্রাকৃত এক সংস্কার এক শ’ বছর ধরে এই পরিবারের প্রজন্মের পর প্রজন্মকে আচ্ছন্ন রাখে। সংস্কারটি হলো ভাইবোনের বিয়ের সন্তান লেজ নিয়ে জন্মাবে, এ সংস্কারে তাড়িত হয়ে ওই দম্পতি পরিচিত বসতি ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে সমাজবিহীন দুর্গম এক এলাকায়। সেখানে ঘর বাঁধে এবং সন্তানের জন্ম দেয় তারা। প্রজন্মের পর প্রজন্ম পেরোলেও কোন সন্তানই লেজ নিয়ে জন্মায় না। তবে লেজ বিষয়ক সংস্কারটি তাদের সবার জীবনেই একটি গোপন আতঙ্কের মতো থেকে যায় এবং সংস্কারটি সত্যি হয় পরিবারের শেষ প্রজন্মের শেষ সন্তানের বেলায়। এ সন্তানের জনক-জননীও ভাইবোন সম্পর্কের। লেজ নিয়ে যে শিশু জন্মায় সে আসলে মৃত। মৃত অবস্থায়ই জন্মায় সে এবং তার জন্মের সঙ্গে সঙ্গে মারা যায় তার মা। উনিশ শতকের শুরু থেকে বিশ শতকের শুরু পর্যন্ত এক শ’ বছর ধরে একটি ঘর ও তাকে ঘিরে গড়ে ওঠা জনপদের বিকশিত হওয়ার নানান দিক উন্মোচন করতে করতে ওয়ান হান্ড্র্রেড ইয়ার্স অব সলিটিউড এগোতে থাকে। এগোতে থাকেন মার্কেজ। জনমানবহীন দুর্গম এলাকায় ভাইবোনের যে সংসার শুরু হয়েছিল সেখানে এক সময় ঢুকে পড়ে রেললাইন। ঢুকে পড়ে যান্ত্রিক সরঞ্জাম। মার্কিন ধনকুবের, ইতালিয়ান বাদ্যযন্ত্রবিদ, আরব সওদাগর। দুর্গম এলাকাটি এক সময় জীবনযাপনের জটিলতায় অস্থির ও অশান্ত হয়ে ওঠে। মার্কেজ শুধু এক শ’ বছরের নীরবতার গল্প শোনান না, শতকের পর শতক নীরব থাকা, ঘুমিয়ে থাকা মহাদেশটিকে প্রচ- ঝাঁকুনিতে জাগিয়ে তোলেন। হয়ত সেজন্যই ঘুরে দাঁড়াতে পারে লাতিন আমেরিকা। মার খেতে খেতে সটান দাঁড়িয়ে আবার জানাতে পারে স্বকীয় অস্তিত্বের কথা। পাবলো নেরুদা, ফিদেল ক্যাস্ট্রো, মার্কেজের লাতিন আমেরিকা থেকেই হয়ত আবার শুরু হবে গণমানুষের জয়গানের নতুন ইতিহাস।
×