ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

একে মোহাম্মাদ আলী শিকদার

৪৪ বছর পর আরেকটি বিজয়ের স্বাদ

প্রকাশিত: ০৩:৫৭, ২৯ নভেম্বর ২০১৫

৪৪ বছর পর আরেকটি বিজয়ের স্বাদ

২১ নবেম্বর রাত ১২টা ৫৫ মিনিটে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের অভ্যন্তরে একাত্তরের দু’জন যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসির দ- কার্যকর করা হয়। একজনের নাম সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ওরফে সাকা চৌধুরী এবং অপরজন আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ। এর মাধ্যমে পঁচাত্তরে হারানো মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পথে নির্মিত হলো আরেকটি বিজয়ফলক। একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের মাধ্যমে আমরা স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ পেলাম, যে বাংলাদেশ ছিল মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ, যার সর্বাঙ্গ রূপায়িত হয় বিজয়ের অলঙ্কারে, যেটি আমরা অর্জন করি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ২৩ বছরের সংগ্রাম ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট শত্রুপক্ষের প্রতি-আক্রমণে আমরা সেই বাংলাদেশ হারালাম। তারপর আবার সংগ্রাম, আবার যুদ্ধ। চলমান সংগ্রামের বাঁকে বাঁকে চূড়ান্ত বিজয়ের পথে আমরা ছোট-বড় একেকটি বিজয় অর্জন করে চলেছি, যার সর্বশেষ মাইলফলক নির্মিত হলো ২১ নবেম্বর রাতে। পঁচাত্তরে হারানো বাংলাদেশকে ফিরে পাওয়ার পথে ২১ নবেম্বর রাতে অর্জিত বিজয় ফলকের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অনেক। এক ধাক্কায় অনেক দূর এগিয়ে গেলাম। বাংলাদেশের দুই শত্রুর একসঙ্গে ফাঁসি। ক’দিন আগেও যা কেউ ভাবতে পারেনি। সংশয়, সন্দেহ, অনিশ্চয়তা কাজ করেছে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত। এ কারণেই যত উত্তেজনা, কাঁপছে শিরা-উপশিরা। আর এ কারণেই ২১ নবেম্বর সারারাত রোমাঞ্চকর অনুভূতিতে সিক্ত হয়েছে বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ, বিশেষ করে একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধারা, যাদের হৃদয়ে প্রোথিত আছে ১৬ ডিসেম্বরের বিজয়গাথার অনুভূতি, আবেগ আর উত্তেজনা। আজকের লেখায় সে কথাই বলব, তবে একটু পরে। স্মৃতিকাতর বাঙালী, তারপর কিশোর বয়সে যুদ্ধ বিজয়ের স্মৃতি, সেটি আবার নিজ মাতৃভূমির মুক্তিযুদ্ধ, সেসব ভাবনায় এলেই সবকিছু কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যায়। এত এলোমেলো হতো না, যদি পঁচাত্তরের আঘাতে সবকিছু চুরমার না হয়ে যেত। কী চেয়েছিলাম, কী পেলাম? স্বাধীনতা অর্জনের মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় পঁচাত্তরের পর ক্ষমতায় আরোহণকারী ও তাদের প্রতিভূদের মুখে কী শুনছি আর কী দেখছি। যুদ্ধাপরাধীরা হয় মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী আর মুক্তিযোদ্ধাদের হয় ফাঁসি, ঠা-া মাথায় হত্যা করা হয় সেক্টর কমান্ডারদের। মুক্তিযোদ্ধারা দুষ্কৃতকারী আর রাজাকার-আলবদর হয়ে যায় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষাকারী। আজও বিএনপির মুখপাত্র রিপন সাহেবরা বলতে পারেন সাকা চৌধুরীর স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের জন্য অবদান আছে। এ জন্যই মুক্তিযোদ্ধারা আজও উত্তেজিত এবং স্মৃতিকাতর। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ থেকে ২১ নবেম্বর ২০১৫। সময়ের ব্যবধান প্রায় ৪৪ বছর। কিন্তু দুই দিনের উত্তেজনা ও আবেগের জায়গায় কোন পার্থক্য নেই। একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর দুপুর থেকেই আকাশবাণী ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বার বার ঘোষণা আসতে থাকে আজ বিকেলের মধ্যেই আত্মসমর্পণ করতে যাচ্ছে পাকিস্তান সেনাবাহিনী। অনেক অপেক্ষার পর এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। পশ্চিম আকাশে সূর্যের লাল আভাটি তখনও বিদ্যমান। বাংলাদেশ সময় আনুমানিক পাঁচটা। আকাশবাণী থেকে ঘোষণা করা হলোÑ এইমাত্র ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বাংলাদেশ-ভারত যৌথবাহিনীর কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করল পাকিস্তান সেনাবাহিনী। আত্মসমর্পণ দলিলে স্বাক্ষর করেছেন পাকিস্তানী সেনা কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজী। এই খবর শোনার মুহূর্তের মধ্যে নিভৃত মুক্তিযোদ্ধাদের সেই ক্যাম্পটির দৃশ্যপট সম্পূর্ণ পাল্টে যায়। একসঙ্গে সবাই লাফিয়ে ওঠে জয়বাংলা চিৎকারে। আকাশ-বাতাস হয় প্রকম্পিত। সে কী মুহূর্ত, কী উত্তেজনা, আজ আর তা ভাবা যায় না। সে কথা মনে হলে অজান্তেই আনন্দ অশ্রুতে চোখ-মুখ ভাসতে থাকে। জয়ের আনন্দ আর স্বজন হারানোর বেদনায় সেদিন একে অপরকে জড়িয়ে ধরে আপ্লুত হৃদয়ে শুধুই উচ্চারিত হয় জয়বাংলা। সারারাত ধরে চলে একই দৃশ্যের অবতারণা। কেউ ঘুমায় না। উল্লাস-উত্তেজনায় কারও ঘুম আসে না। ৪৪ বছর পর ২১ নবেম্বর রাতে আরেকবার মুক্তিযোদ্ধারা ঘুমায়নি। মশহুর দুই যুদ্ধাপরাধী সাকা ও মুজাহিদের ফাঁসির খবর শোনার অপেক্ষার উত্তেজনায় অতিবাহিত হয় রাত একটা। তারপর দেশব্যাপী একাত্তরের মতো সারারাত চলে কোলাকুলি, আনন্দ আর উল্লাস। একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের মাধ্যমে আমরা মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ পেলাম, যে বাংলাদেশের বৈশিষ্ট্য ও স্বরূপ নির্মিত হয় সেসব উপাদানের দ্বারা, যা আমরা অর্জন করেছি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ২৩ বছরের সংগ্রাম এবং একাত্তরে ৩০ লাখ মানুষের জীবনের বিনিময়ে। পাকিস্তানের বন্দীদশা থেকে ফিরে এসে বঙ্গবন্ধু যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ নতুন করে নির্মাণের যাত্রা শুরু করলেন। এর মধ্যে একাত্তরের পরাজিত শক্তি ও তাদের সহযোগী এদেশীয় জামায়াত এবং এর নেতা গোলাম আযম লন্ডনে বসে শুরু করলেন পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার আন্দোলন। এই আন্দোলনকে সফল করার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ১৬ ডিসেম্বরের অব্যবহিত কয়েকদিন আগে তারা পরিকল্পতভাবে হত্যা করে বাঙালী বুদ্ধিজীবীদের। এই হত্যাকা- চালায় আলবদর বাহিনী, যার নেতৃত্বে ছিলেন নিজামী, মুজাহিদ, মীর কাশেম ও গং। পাকিস্তানী জেনারেল রাও ফরমান আলীর তত্ত্বাবধানে তারা বুদ্ধিজীবী হত্যাকা- চালায় এই ভেবে যে, বাঙালীর মাথা কেটে ফেললে তাদের পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার আন্দোলনে বুদ্ধিভিত্তিক বিরোধিতা করার জায়গা ও শক্তি বাঙালীর থাকবে না। তবে বঙ্গবন্ধু এগোচ্ছিলেন ঠিকই, সবকিছু প্রায় গুছিয়ে এনেছিলেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর যা ঘটল তাতে এক সময় ভেবেছিলাম, বোধ হয় সব শেষ হয়ে গেল। মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ বলতে আর কিছু থাকবে না। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার করা যাবে না এই মর্মে সংবিধানে অনুচ্ছেদ সংযোজন করলেন পঁচাত্তরের পর ক্ষমতায় আসা বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জিয়াউর রহমান। হত্যাকারীর বিচার করা যাবে না এই মর্মে সংবিধানে বিধান সংযোজন করার ঘটনা বিশ্বের কোথাও কখনও ছিল না, এখনও নেই, ভবিষ্যতেও হবে বলে মনে হয় না। একাত্তরে বুদ্ধিজীবী হত্যাকারী, গণহত্যাকারী, নারী ধর্ষণকারী জামায়াত, আলবদর, রাজাকার, মুসলিম লীগ সকলকে রাজনীতিতে ফিরিয়ে আনলেন জিয়াউর রহমান বহুদলীয় গণতন্ত্রের মুখোশে। বলা শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ নয়, একাত্তর ছিল গ-গোলের বছর। একাত্তরের যুদ্ধের কোন বর্ণনায় পাকিস্তানী বাহিনীর জায়গায় হানাদার বাহিনী বলার অঘোষিত নির্দেশ জারি হলো রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে, যাতে একাত্তরে পাকিস্তানের অপকর্মের কথা বাংলাদেশের নতুন প্রজন্ম জানতে না পারে। পঁচাত্তরের পর বাংলাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতায় বসে তারা এ কাজ করেছে, ভাবা যায়! সমাজ, সংস্কৃতি, রাষ্ট্রীয় অঙ্গন, শিক্ষা কার্যক্রম সর্বত্র বিকৃত কাহিনী আর গ-গোলের তত্ত্বে ভরপুর হয়ে যায়। এগুলো সবই ছিল পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার আন্দোলনের অংশবিশেষ। পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার আন্দোলন বাতিল ঘোষণা না করেই গোলাম আযম বাংলাদেশে এলেন ১৯৭৮ সালে, জিয়াউর রহমানের কৃপায়। তারপর থেকে দুই সামরিক শাসক ও পরবর্তী সময়ে সামরিক সংস্কৃতিতে জন্ম নেয়া রাজনৈতিক দল এবং এদের সঙ্গে মিত্র হিসেবে জামায়াত, মুসলিম লীগসহ একাত্তরের পরাজিত শক্তি মিলে আজ পর্যন্ত যা করে চলেছে তার একমাত্র উদ্দেশ্য বাংলাদেশের খোলসে সেই পূর্ব পাকিস্তান পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা। তাদের এই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় সাকা, মুজাহিদ, নিজামী মন্ত্রী হয়েছেন। এরা দেশে-বিদেশে বিশাল আর্থিক সাম্রাজ্যের মালিক হয়েছেন। সুতরাং মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পথে আরাধ্য কাজ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবে, সাকা, মুজাহিদের ফাঁসি হবেÑ এ কথা এক সময় ভাবাই যেত না। এ কারণেই এসব যুদ্ধাপরাধী এতদিন সীমাহীন ঔদ্ধত্য দেখিয়েছে। প্রবল বাধা ও অনিশ্চয়তা যেখানে থাকে সেখানেই প্রবল উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। আবেগতাড়িত অবস্থায় পুরনো স্মৃতি এসে ভর করে। সুতরাং গুরুত্ব ও তাৎপর্যের বিশাল পার্থক্য থাকলেও একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বরের বিজয়ের অনুভূতি ধারণকারী মুক্তিযোদ্ধাদের মনে একই রকম উত্তেজনা ও অনুভূতির সৃষ্টি হয় ২১ নবেম্বর রাতে। সব উত্তেজনার অবসান ঘটে ওই দিন রাত ১২টা ৫৫ মিনিটে, যার খবর দেশব্যাপী মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পৌঁছায় রাত একটার কিছুক্ষণ পর। মনের অনুভূতি থেকেই চেতনার সৃষ্টি। আর লক্ষ্য অর্জনের জন্য চেতনার চেয়ে বড় অস্ত্র আর নেই। বাংলাদেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মনে নতুন আশার সৃষ্টি হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ হয়ত তারা আবার ফিরে পাবে। তবে এখনও যেতে হবে বহুদূর। যুদ্ধ এখনও শেষ হয়নি। সব যুদ্ধাপরাধীর বিচার দ্রত সম্পন্ন ও রায় কার্যকর করা প্রয়োজন। যুদ্ধাপরাধীদের পুনর্বাসনকারী ও পৃষ্ঠপোষক বড় রাজনৈতিক পক্ষ এখন দিশাহারা, নীরব, নিস্তব্ধ। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সাকা চৌধুরীর অবদান আছে মর্মে বক্তব্য দিয়েছেন বিএনপির মুখপাত্র আসাদুজ্জামান রিপন। কোন্ সনের কোন্ তারিখে সাকা এমন পবিত্র কাজ করেছেন তা রিপন সাহেব বলতে পারেননি। তবে পাকিস্তানের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় যে সাকা চৌধুরীর অবদান আছে তা পাকিস্তান স্পষ্ট করে বলেছে। আর এ কারণেই পাকিস্তানের সিনিয়র মানবাধিকার নেতা আসমা জাহাঙ্গীর বলেছেন, পাকিস্তানের বক্তব্যে প্রমাণ হয় এতদিন সাকা-মুজাহিদ পাকিস্তানের এজেন্ট হিসেবে কাজ করেছেন। এ কথাটাই মুক্তিযোদ্ধারা বলে আসছে পঁচাত্তরের পর থেকে। সুতরাং সাকা-মুজাহিদের ফাঁসির দ- কার্যকর হওয়ার মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পথে আরেকটি বিজয়ের স্বাদ পেল বাংলাদেশের মানুষ। লেখক : ভূ-রাজনীতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক
×