ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

মূল্য নিয়ে শঙ্কা ॥ আমন ফলনে তৃপ্ত কৃষক

প্রকাশিত: ০৫:১৯, ২৮ নভেম্বর ২০১৫

মূল্য নিয়ে শঙ্কা ॥ আমন ফলনে তৃপ্ত  কৃষক

এমদাদুল হক তুহিন ॥ ফসলের মাঠে এখন পাকা আমনের গন্ধ। ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। আমন কাটা শুরু হয়েছে কয়েক দিন আগে। এখন চলছে পুরোদমে। ধান কাটা ও মাড়াই কাজে কৃষকরা পার করছেন মহাব্যস্ত সময়। সর্বশেষ তথ্যানুসারে সারাদেশে ৪০ শতাংশ আমন কাটা সম্পন্ন হয়েছে। এ পরিমাণ জমিতে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে উৎপাদন হয়েছে বেশি। ফলন ভাল হওয়ায় কৃষকের মুখে তৃপ্তির হাসি। তবে একই সঙ্গে ধানের উপযুক্ত মূল্য পাওয়া নিয়ে রয়েছে শঙ্কা। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্যানুসারে, চলতি মৌসুমে সারাদেশে ৫৬ লাখ ৪৫ হাজার হেক্টর জমিতে ১ কোটি ৩৫ লাখ ৫৫ হাজার মেট্রিক টন আমন চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। তবে আবাদ হয়েছে ৫৫ লাখ ৪৪ হাজার হেক্টর জমিতে। মৌসুমে ১ লাখ ১ হেক্টর পরিমাণ কম জমিতে আবাদ হয়েছে। গত মৌসুমে একই সময়ে ৫৫ লাখ ৩০ হাজার হেক্টর জমিতে ১ কোটি ৩১ লাখ ৯০ হাজার মেট্রিক টন ধান উৎপাদন হয়। গত বছরের তুলনায় ১৪ হাজার হেক্টর অধিক জমিতে আমনের আবাদ হওয়ায় উৎপাদন ক্ষেত্রে পূর্বের রেকর্ড ছাড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। চলতি মৌসুমেও সম্ভাবনা রয়েছে বাম্পার ফলনের। মাঠপর্যায়ের একাধিক কৃষকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মৌসুমের শুরুতে প্রাকৃতিক বিপর্যয় হানা দিলেও ফলনে কোন নেতিবাচক প্রভাব পড়েনি। বরং ভাল ফসল হওয়ায় কৃষকের মুখে ফুটে উঠেছে তৃপ্তির হাসি। কিন্তু একই সঙ্গে রয়েছে শঙ্কাও। উৎপাদন খরচের চেয়ে ধানের দাম কম হওয়ায় কেউ কেউ প্রকাশ করেছেন ক্ষোভ। বাকিদের দাবি, কোনক্রমেই এবার যেন উৎপাদন খরচের চেয়ে ধানের বাজারমূল্য কম না হয়। সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, দেশের প্রতিটি বাজারে আমনের বিক্রি শুরু না হলেও বেশকিছু জেলায় শুরু হয়েছে আমনের বিক্রি। নাটোর, রাজশাহী, রংপুর, দিনাজপুরসহ কয়েকটি জেলায় মাঝারি মানের আমন ধান বিক্রি হচ্ছে ৫২০ থেকে ৫৪০ টাকায়। তবে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোয় ধানের দাম কিছুটা বেশি। যশোর, ঝিনাইদহ ও কুষ্টিয়ায় প্রতি মণ ধান বিক্রি হচ্ছে ৫৪০ থেকে ৫৬০ টাকায়। এছাড়া দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোর বাজারে ধান বিক্রি এখনও পুরোপুরি শুরু হয়নি। অন্যদিকে চলতি মৌসুমে সরকার কর্তৃক নির্ধারিত চালের সংগ্রহের পরিমাণ ও মূল্য দুটোই কম। তথ্যমতে, চলতি মৌসুমে প্রতি কেজি ধান ও চাল উৎপাদনে কৃষকের খরচ ৫০ পয়সা বাড়লেও সরকারের সংগ্রহমূল্য কমানো হয়েছে। চালের দাম গতবছরের তুলনায় ১ টাকা কমানোর পাশাপাশি সংগ্রহের পরিমাণও কমানো হয়েছে। চলতি আমন মৌসুমে সরকার প্রতি কেজি ৩১ টাকা ধরে ২ লাখ টন আমন চাল সংগ্রহ করবে। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন খাদ্য অধিদফতর ১৫ ডিসেম্বর থেকে শুরু করে আগামী বছরের ১৫ মার্চ পর্যন্ত চলবে এ সংগ্রহ। তবে গত বছর একই মৌসুমে প্রতি কেজি ৩২ টাকা দরে ৩ লাখ ২০ হাজার টন চাল সংগ্রহ করেছিল সরকার। ফলে সংগ্রহের পরিমাণ ও মূল্য দুটোই কমে যাওয়ায় কৃষকের মধ্যে রয়েছে চাপা ক্ষোভ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকার কর্তৃক ধানের সংগ্রহ মূল্য কমানোর ফলে মধ্যস্বত্বভোগীরা আরও বেশি মুনাফার সুযোগ পাবে। ফলে এর প্রভাবে আগামী বোরো মৌসুমে কৃষকের ধান আবাদে আগ্রহ কমে যাওয়ার শঙ্কাও রয়েছে। ফলন ভাল হওয়ায় কৃষকের মুখে তৃপ্তির হাসি। নরসিংদী জেলার মনোহরদী উপজেলার চন্দনপুর গ্রামের কৃষক মোঃ শহীদুল্লাহ অনেকটা উচ্ছ্বাস ভরা কণ্ঠে জনকণ্ঠকে বলেন, এবার ফলন খুব ভাল হয়েছে। ফসলের কোন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। এলাকায় ধান কাটা শুরু হয়েছে। তবে তিনি শঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, গত বছর ফলন ভাল হলেও ধানের দাম পায়নি। এবার যেন ঠিকমতো দাম পাওয়া যায়Ñ সেটাই এখন আমাদের প্রত্যাশা। একই রকম কথা বলেন কিশোরগঞ্জ জেলার পাকুন্দিয়া উপজেলার হরশী গ্রামের কৃষক হিমেল। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, কয়েক দিন আগে থেকেই শুরু হয়েছে ধান কাটা। মৌসুমের শুরুতে পাতা লাল হয়ে যাওয়া রোগে আক্রান্ত হলেও উৎপাদন খারাপ হয়নি। ধানের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি নিয়ে তিনিও শঙ্কা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, এখনও বাজারে ধান উঠতে শুরু করেনি। মৌসুমের প্রথমদিকে প্রতিবারই ধানের দাম কম থাকে। মৌসুম শেষে ধানের দাম বাড়লেও অধিকাংশ সময় কমে যায়। শ্রমিকের মূল্য বেড়েছে। প্রত্যাশার সঙ্গে তিনি বলেন, এবার যেন ধানের সঠিক মূল্য পাওয়া যায়। ময়মনসিংহ জেলার বেশ কয়েকজন কৃষকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ওই এলাকায় আমন ধান কাটা পুরোদমে চলছে। তবে ফসল এখনও মাঠে থাকায় ধানের দাম নিয়ে এখনই কিছু ভাবছেন না তারা। ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলায় কৃষির সঙ্গে জড়িত মোঃ মোস্তফা জনকণ্ঠকে বলেন, কয়েক দিন হলো ধান কাটা শুরু হয়েছে। প্রায় ৫০ ভাগ জমির ধান কাটা শেষ। তবে ফসল মাঠে। ঘরে তুলতে আরও ১০ থেকে ১৫ দিন লাগবে। ফলে বাজারেও ধানের বিক্রি শুরু হয়নি। তাই দাম নিয়ে এখনই কিছু ভাবছি না। জানা গেছে, নাটোর এলাকার কৃষকরা ধানের উপযুক্ত মূল্য পাচ্ছেন না। ওই এলাকার কৃষক বারাকাত জানান, উৎপাদন খরচের সঙ্গে ধানের বাজার মূল্য মিলছে না। ধানের মূল্য কম হওয়া প্রসঙ্গে বেসরকারী গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) রিসার্চ ফেলো ও কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. সুবীর বৈরাগী জনকণ্ঠকে বলেন, বাজারে সরবরাহ বেশি থাকায় গত বোরো মৌসুম থেকেই ধান ও চালের দাম কমছে। আমদানির ওপর ১০ শতাংশ শুল্ক বসিয়েও বাজারে চালের মূল্য বাড়ানো সম্ভব হয়নি। বরং দেশীয় বাজারে গত এক বছরে চালের মূল্য কমেছে ১০ শতাংশ। আবার আন্তর্জাতিক বাজারেও চালের মূল্য কম। ফলে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং এ মৌসুমেও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সঠিক মূল্য না পেলে উৎপাদনের প্রতি মনোযোগ হারাবে কৃষকÑ উল্লেখ করে করণীয় সম্পর্কে তিনি আরও বলেন, ন্যয্যমূল্য না পেলে কৃষক উৎপাদনের প্রতি আগ্রহ হারাবে। সরকারের উচিত ভর্তুকি হ্রাস না করে প্রণোদনা বৃদ্ধি করা। অন্যদিকে চাল সংগ্রহ ও মূল্য মৌসুম শুরুর পূর্ববর্তী বছরই জানিয়ে দেয়া উচিত। পার্শ্ববর্তী দেশে এমনটাই হয়। আমাদের দেশেও পূর্ববর্তী মৌসুমেই পরবর্তী মৌসুমের সংগ্রহ ও সংগ্রহের পরিমাণ নির্ধারণ করা উচিত। এমনকি এখনই আগামী বোরো মৌসুমের সংগ্রহের পরিমাণ ও মূল্য নির্ধারণ করে দিলে সব দিক দিয়ে কৃষক উপকৃত হবেন। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) সিনিয়র গবেষক ড. নাজনীন আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, মৌসুমের উৎপাদনের ওপর ভিত্তি করে সরকার চাল সংগ্রহের পরিমাণ নির্ধারণ করে। সংগ্রহের পরিমাণ ও মূল্যের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে মিলারদের কাছ থেকে কৃষকরা সঠিক মূল্য পাচ্ছেন কিনা। দেখা যায়, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কৃষকরা নির্ধারিত মূল্যের চেয়েও কম মূল্য পায়। কৃষকরা যেন ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত না হন, সে লক্ষ্যে মিলারদের ওপর মনিটরিং বৃদ্ধি করতে হবে। সামগ্রিক প্রসঙ্গে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সরেজমিন উইংয়ের উপ-পরিচালক ড. মোহাম্মদ আবদুহু জনকণ্ঠকে বলেন, এখন পর্যন্ত ৪০ শতাংশ আমন ধান কাটা সম্পন্ন হয়েছে। যেসব জমিতে আমন কাটা হয়েছে সেসব জমিতে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় উৎপাদন ১ শতাংশ বেশি হয়েছে। তবে পুরো জমিতে আমন ধান কাটার আগে উৎপাদনের ব্যাপারে পূর্বাভাস দেয়া সম্ভব নয়। ক্ষয়ক্ষতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগে যে ক্ষতি হয়েছিল, তা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়েছে। কৃষকরাও এখন ভাল ফলনের প্রত্যাশায় আছেন। মাঠপর্যায়ে ফসল উৎপাদন ইতিবাচক।
×