ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

এনামুল হক

হাওয়ায় ভেসে ঘুম

প্রকাশিত: ০৭:২০, ২৭ নভেম্বর ২০১৫

হাওয়ায় ভেসে ঘুম

ঘুমের রাজ্যে চলে যাওয়ার সময় শরীরে আকস্মিক ঝাঁকুনির অনুভূতি মনে হতে পারে। এমন অনুভূতি অনেকেরই হয়। আর এর সঙ্গে যদি স্বপ্ন যুক্ত হয় তাহলে মনে হবে শরীরটা সহসা পড়ে আছে বা নিচে চলে যাচ্ছে। শরীরটা বাতাসের মধ্যে দিয়ে নিচে পড়ে যাচ্ছে এমন অনুভূতি যদি স্বপ্নের অংশ হয় তাহলে সেটাকে বলা হয় স্বপ্ন সংযুক্তি। এর মধ্যে দিয়ে বিনা প্রস্তুতিতে উপস্থিত মতো কিছু করার ব্যাপারে আমাদের মনের বিস্ময়কর স্বপ্নতার পরিচয় পাওয়া যায়। এই অভিজ্ঞতা ‘হিপনিক জার্ক’ নামে পরিচিত। ঘুমিয়ে পড়ার সময় আমাদের মস্তিষ্কের ভেতর সে সংঘাত চলে এর মধ্যে দিয়ে ফুটে উঠে। হিপনিক জার্ক কেন হয়? ঘুমিয়ে পড়লে আমাদের শরীর নিশ্চল হয়ে যায় এবং আমরা বহির্জগতের ঘটনাবলী বিস্মৃত হয়ে পড়ি। তবে আমাদের মাংসপেশীর উপর নিয়ন্ত্রণ সুইটের মতো বন্ধ হয়ে যায় না। আমাদের মস্তিষ্কের ভেতর একটা জায়গা আছে যাকে বলা হয় রেটিকুলার একটি ভেটিংসিস্টেম। এটি আমাদের শ্বাসপ্রশ্বাসের মতো মৌলিক ক্রিয়াকলাপকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং আমরা সজাগ বোধ করছি কিনা জানায়। অন্যদিকে অপটিক নার্ভের কাছে ভেন্টোল্যাটারাল প্রিঅপটিক নিউক্লিয়াস নামে একটা জায়গা আছে যা আমাদের ক্লান্তি নিয়ন্ত্রণ করে। আমরা ঘুমিয়ে পড়ার সময রেটিকুলার একটিভেটিং সিস্টেমটি আমাদের শরীরের ওপর নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দেয় এবং ভেনট্রোল্যাটারাল প্রিঅপটিক নিউক্লিয়াস শরীরের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে। প্রক্রিয়াটি অপেক্ষাকৃত অনুজ্জ্বল আলোর ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে আসার মতো। তবে ব্যাপারটা সর্বদা স্বচ্ছন্দে নির্বিঘেœ ঘটে না। আমাদের জাগরণকালের অবশিষ্ট এলার্জিটুকু মাঝে মাঝে হঠাৎ করে ঝাঁকুনির আকারে সবেগে বেরিয়ে আসে। কেন বেরিয়ে আসে তা এখনও পর্যন্ত পুরোপুরি পরিষ্কার নয়। আমাদের স্বপ্ন দেখার সময় চক্ষুদয় দ্রুত নড়াচড়া করে সেটাকে ইংরেজীতে বলে র‌্যাপিড আই মুভমেন্ট বা রেম। কিন্তু ওই ঝাঁকুনির ব্যাপাটার সঙ্গে আমাদের স্বপ্ন দেখার কোন সম্পর্ক নেই। এক্সপ্লোডিং হেড সিন্ড্রোম নামে এক অদ্ভুদ ও অতি অপ্রীতিকর ব্যাপারও একই ধরনের আচরণ অনুসরণ করে। এটা ঘটে যখন আমাদের জাগরণের মন ও নিদ্রার মন পরস্পরের কাছ থেকে নিয়ন্ত্রণ দখল করে নেয়ার চেষ্টা চালায়। এই টাগ অব ওয়াবেরকালেই আলোর ঝলকানি দেখা এবং জোরে শব্দ শোনার মতো অনুভূতি সৃষ্টি হয়। কোন কোন চরম অবস্থায় এ থেকে মারাত্মক ইনসোমনিয়া বা নিদ্রাহীনতা দেখা দিতে পারে এবং মনে হতে পারে ভিনগ্রহের প্রাণী এসে অপহরণ করে নিচ্ছে। তবে সাধারণভাবে বলতে গেলে এই অনুভূতির ব্যাপারে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। এটা ঘুমিয়ে পড়ার মজাদার কাকতালীয় ব্যাপার মাত্র। টম স্ট্যাফোর্ড নামে এক মনোসমীক্ষক বলেছেন যে, ঘুমন্ত অবস্থায় আমাদের মনোজগতে দু’ধরনের ক্রিয়াকলাপের মধ্যে এক মনোরম সামঞ্জস্য বিরাজ করে। র‌্যাপিড আই মুভমেন্ট হলো জাগ্রত জগতে যেসব স্বপ্ন দেখা যেতে পারে তারই চিহ্নমাত্র। আর জাগ্রত জগতের যে বিষয়গুলো স্বপ্নের জগতে অনুপ্রবেশ করে হিপনিক জার্ক হলো তারই নিদর্শন বা চিহ্ন। মস্তিষ্কের রেটিকুলার ফরমেশন। যখন পেশীগুলোকে শিথিল করা এবং কোন উদ্দীপনায় সাড়া না দেয়ার জন্য স্পাইনাল কর্ড বা সুষম্মাকা- দিয়ে সিগন্যাল পাঠাতে থাকে তখন আমাদের চোখে ঘুম নেমে আসতে থাকে। জাগ্রত অবস্থায় কোথাও কোন খোঁচা লাগলে সঙ্গে সঙ্গে তা অনুভূত হবে। কিন্তু ঘুমন্ত অবস্থায় ওই খোঁচা লাগলে সঙ্গে সঙ্গে তা অনুভূত হবে। কিন্তু ঘুমন্ত অবস্থায় ওই খোঁজা জাগিয়ে তুলতে পারবে না। কারণ শরীরের নিজস্ব চেতনাবোধ তখন একেবারে মিইয়ে আসে। বিষয়টি পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা সবাই একমত। কিন্তু তারপর থেকেই তাদের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে ভিন্নমত লক্ষ্য করা যায়। ঘুমের মধ্যে পড়ে যাওয়ার অনুভূতি কেন হয় এ নিয়ে এর আগে যে ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে সেটা বিজ্ঞানীদের সাম্প্রতিকতম ব্যাখ্যা। কিন্তু সেটাকেই ধ্রুব বা চূড়ান্ত বলে মনে করার উপায় নেই। এর আগেও বিভিন্ন সময় হিপনিক জার্ক ঘটনাটির ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। যেমন ২০১২ সালে নিউরোসায়েন্স ম্যাগাজিনে প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে ইয়ান অসওয়ার্ল্ড লিখেছেন যে, কোন কোন ব্যক্তির ক্ষেত্রে রেটিকুলার ফরমেশনের সিগন্যালগুলো আস্তে করে টোকা মারে। পেশী সঙ্কোচনে বাধা দেয়া বা দমন করার পরিবর্তে সেই সঙ্কেতগুলো কোন উদ্দীপনার অস্তিত্ব একেবারে না থাকা অবস্থাতেও কখনও কখনও পেশী সঙ্কোচন বাড়িয়ে তুলে। একেই বলে হিপনিক জার্ক। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যারা পায়ে অস্থিরতার সমস্যায় ভুগে অতি সচরাচর তাদের বেলায় এটা লক্ষ্য করা যায়। এরা যখন ঝাঁকুনি দিয়ে, জেগে ওঠে তখন পাশের নিচে সরাসরি কোন সাপোর্ট না থাকার কারণে তাদের মনে হতে পারে, স্বপ্নের মধ্যে তারা পড়ে যাচ্ছিল। আবার আরেক ব্যাখ্যা হলো স্বপ্নের মধ্যে নিচে পড়ে যাওয়ার অনুভূতিটা আসে শরীর শিথিল থাকার প্রক্রিয়া থেকে। বিশেষ করে সেই ব্যক্তি যদি উদ্বিগ্ন অবস্থায় থাকে কিংবা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ না করে। শরীরের মাংসপেশীগুলো যখন শিথিল হয়ে ঘুমের জগতে চলে যেতে থাকে তখনও মস্তিষ্ক সজাগ থেকে পরিস্থিতির ওপর নজর রাখে। কিন্তু উদ্বেগ উৎকণ্ঠা ও অস্বাস্থ্যকর অবস্থায় মাংসপেশী যখন শিথিল হয়ে একটা থিঁতু অবস্থায় আসে সে সময় মস্তিষ্ক হঠাৎ ঝাঁকুনি দিয়ে সেই ব্যক্তিকে জাগিয়ে দেয় এবং তখন তার অনুভূতি হয় সে শূন্যের মধ্যে নিচের দিকে পড়ে যাচ্ছিল। সূত্র : বিবিসি ও অন্যান্য
×