ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

’২০ সালে দারিদ্র্য নামবে ১৮.৬ শতাংশে

প্রকাশিত: ০৫:২৪, ২৬ নভেম্বর ২০১৫

’২০ সালে দারিদ্র্য নামবে ১৮.৬ শতাংশে

হামিদ-উজ-জামান মামুন ॥ এক দশকে ১৩ শতাংশ দারিদ্র্য কমার প্রাক্কলন করে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ (জিইডি)। সংস্থাটির প্রাক্কলন অনুযায়ী, ২০২০ সালে দেশে দারিদ্র্যের হার ১৮ দশমিক ৬ শতাংশে নেমে আসবে। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার দলিলে জিইডির প্রাক্কলনকে চূড়ান্ত করেছে ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের নেতৃত্বে গঠিত দেশের শীর্ষ অর্থনীতিবিদরা। সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) সদস্য (সিনিয়র সচিব) ড. শামসুল আলম বলেন, দারিদ্র্যবান্ধব উন্নয়ন কৌশল গ্রহণের কারণেই দারিদ্র্য হার প্রত্যাশিত মাত্রায় কমে আসছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বু্যুরোর হাউসহোল্ড ইনকাম এন্ড এক্সপেনডিচার সার্ভের (হায়েস) তথ্য অনুযায়ী ২০০০ থেকে ২০১০ সাল সময়ে দারিদ্র্য গড়ে এক দশমিক চুয়াত্তর শতাংশ হারে হ্রাস পাচ্ছে। এ প্রবণতা নিঃসন্দেহে একটি তাৎপর্যপূর্ণ অর্জন। তাই সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় যৌক্তিক পর্যায় কমিয়ে আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। পরিকল্পনা কমিশন সূত্র জানায়, গত মাসের শেষ সপ্তাহে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) সভায় সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (২০১৬-২০২০) অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রকৃত দারিদ্র্য হার চূড়ান্তসহ বেশ কয়েকটি শর্তে পরিকল্পনাটি অনুমোদন করেন। এ প্রেক্ষিতে অর্থনীতিবিদ ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের সভাপতিত্বে দেশের শীর্ষ অর্থনীতিবিদরা দারিদ্র্য হার প্রাক্কলনের বিষয়ে আলোচনা করেন। এর পর চলতি বছর ২৪ দশমিক ৮ শতাংশ এবং ২০২০ সাল নাগাদ দারিদ্র্য কমে ১৮ দশমিক ৬ শতাংশে হবে বলে প্রক্ষেপণ করা হয়। যা সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার দলিলে উল্লেখ করা হয়েছে। জিইডি দারিদ্র্যের হার প্রাক্কলনে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০০৫ এবং ২০১০ সালের খানা আয়-ব্যয় জরিপ এবং মাথাপিছু জাতীয় আয়ের তথ্য হতে প্রাপ্ত ইনকাম ইলাসটিসিটি অব পোভার্টি ব্যবহার করেছে। জিইডির প্রাক্কলনের ক্ষেত্রে অর্থনীতিবিদরা বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে এটিকে সর্বাধিক উপযোগী পদ্ধতি বলে বৈঠকে উল্লেখ করেছেন। বৈঠকে অর্থনীতিবিদ ড. ওয়াহিদউদ্দিন বলেন, হালনাগাদ পরিসংখ্যানের অভাবে সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার ভিত্তি বছরের জন্য দারিদ্র্য হার অনুমানের নির্ভর প্রাক্কলন করার বিকল্প নেই। নতুন আয়-ব্যয় জরিপের ফল পাওয়া গেলে প্রকৃত হার পাওয়া যাবে। এসব দিক বিবেচনায় দারিদ্র্যের হার প্রক্ষেপণে আপাতত কিছুটা অনিশ্চয়তা থেকে যাবে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণা পরিচালক ড. বিনায়েক সেন বলেন, নির্দিষ্ট সময়ে খানা আয় এবং ব্যয় জরিপ না হওয়ার কারণে প্রকৃত দারিদ্র্য হার নির্ণয় করা কঠিন। এ প্রেক্ষিতে নানা পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করে দারিদ্র্যের হার প্রক্ষেপণ করা হয়েছে। যা জিইডির পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা দলিলে উল্লেখিত হারের সঙ্গে মিলে গেছে। তিনি বলেন, প্রকৃত দারিদ্র্যের হার না পাওয়া গেলেও দেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ব্যাপকভাবে কমছে। মূলত কৃষিতে দক্ষতা, রেমিটেন্স, গার্মেন্টস শিল্পের উত্থান এবং কৃষি মজুরি বৃদ্ধির কারণে কমছে দারিদ্র্যের হার। সূত্র জানায়, পরিকল্পিত অর্থনৈতিক কার্যক্রমের ফলে অর্জিত প্রবৃদ্ধি ফল পৌঁছাচ্ছে সারা দেশে। যার প্রতিফলন ঘটছে দারিদ্র্য হারে। চলতি বছরের (২০১৫ সাল) সর্বশেষ প্রাথমিক হিসেব অনুযায়ী দেশে বর্তমানে দারিদ্র্যের হার ২৩ দশমিক ৬ শতাংশ, যা ২০১০ সালে ছিল ৩১ দশমিক ৫ শতাংশ। অন্যদিকে কমেছে অতি দারিদ্র্যও। এ হার দাঁড়িয়েছে ১২ দশমিক ৩ শতাংশে, যা ২০১০ সালে ছিল ১৭ দশমিক ৬ শতাংশ। পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) মূল্যায়নে দারিদ্র্য হ্রাসের এ চিত্র উঠে এসেছে। বলা হয়েছে প্রতিবছর দারিদ্র্য কমছে ১ দশমিক ৭৪ শতাংশ হারে। দারিদ্র্য কমার কারণ হিসেবে জানা গেছে, পরিকল্পিত অর্থনৈতিক কার্যক্রম, বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তামূলক কর্মসূচী যেমন, ভিজিডি, ভিজিএফ, জিআর, ওএমএস কর্মসূচী, টেস্ট রিলিফ, কাবিখা এবং ফেয়ার প্রাইস কার্ড ইত্যাদির কার্যকর বাস্তবায়ন। এর আগে চলতি বছরের শুরুতে বিশ্বব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট এ্যানেট ডিক্সন বলেছিলেন, দারিদ্র্য নিরসন ও মানব উন্নয়নে বাংলাদেশ অন্যান্য দেশের কাছে উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশের এই অভিজ্ঞতা থেকে অন্য দেশগুলো শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। গত ফেব্রুয়ারি মাসে পাঁচ দিনের সফর শেষে ঢাকা ত্যাগ করার আগে তিনি এসব কথা বলেছিলেন। জিইডির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) পরিচালিত খানা আয়-ব্যয় জরিপের মাধ্যমে দারিদ্র্যের পরিমাণ করা হয়। দেশে সর্বপ্রথম ১৯৭৩-৭৪ অর্থবছরে খানা আয়-ব্যয় জরিপ পরিচালিত হয় এবং পরবর্তীকালে আরও কয়েকটি জরিপ পরিচালিত হয়। সর্বশেষ খানা আয়-ব্যয় জরিপ পরিচালিত হয় ২০১০ সালে। ১৯৯১-৯২ অর্থবছর পর্যন্ত পরিচালিত খানা আয় ব্যয় জরিপে দেশের দারিদ্র্যের পরিমাণের জন্য খাদ্যশক্তি গ্রহণ এবং প্রত্যক্ষ ক্যালরি গ্রহণের পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। সেক্ষেত্রে দারিদ্র্য পরিমাপে জনপ্রতি প্রতিদিন দুই হাজার একশত বাইশ কিলো ক্যালরির নিচে খাদ্য গ্রহণকে দারিদ্র্য এবং এক হাজার আট শ’ পাঁচ কিলোক্যালরির নিচে খাদ্য গ্রহণকে চরম দারিদ্র্য হিসেবে গণ্য করা হতো। পরবর্তীতে প্রথমবারের মতো ১৯৯৫-৯৬ অর্থবছরে পরিচালিত খানা আয়-ব্যয় জরিপে মৌলিক চাহিদা ব্যয় পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। অনুরূপভাবে পরবর্তীতে দুটি জরিপ পরিচালনা করা হয়। কিন্তু ২০১০ সালে এসে পরিচালিত খানা আয়-ব্যয় জরিপে মৌলিক চাহিদা ব্যয় পদ্ধতিকেত দারিদ্র্য পরিমাপে খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত ভোগ্যপণ্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এ পদ্ধতিতে খাদ্যের ক্ষেত্রে দুই হাজার এক শ’ বাইশ কিলোক্যাররি মাত্রা ঠিক রেখে এর ক্রয় ব্যয় ও খাদ্য বহির্ভূত ভোগ্য পণ্য ক্রয় ব্যয়কে একত্রিত করে মাসিক জনপ্রতি এক হাজার ছয় শ’ টাকার নিচে আয়কে দারিদ্র্য হিসেবে এবং মাসিক জনপ্রতি এক হাজার তিন শ’ টাকার নিচে আয়কে অতি দারিদ্র্য হিসেবে গণ্য করা হয়। পরিকল্পনা কমিশন সূত্র জানায়, বর্তমান সরকার প্রথম মেয়াদে দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই দেশের জনগণের প্রত্যাশা পূরণে পরিকল্পিত উন্নয়ন ব্যবস্থা প্রবর্তনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে উন্নয়ন কার্যক্রমের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার স্বার্থে গত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে প্রণীত দারিদ্র্য নিরসন কৌশলপত্রটি বাতিল না করে সংশোধন করা হয়। এ ক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারের উন্নয়ন দর্শন ও লক্ষ্যের আলোকে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে সংসদে আলোচনার মাধ্যমে জাতীয় দারিদ্র্য নিরসন কৌশলপত্র-২ (২০০৯-২০১১) দিন বদলের পদক্ষেপ প্রণয়ন করা হয়। ওই সময় সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ মনে করেছিল স্বল্প সময়ে পরিকল্পনার মাধ্যমে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন অম্ভব। এ প্রেক্ষাপটে সরকার স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীকে সামনে রেখে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের জন্য প্রথমবারের মতো দীর্ঘমেয়াদী রূপকল্প হিসেবে বাংলাদেশ প্রেক্ষিত পরিকল্পনা (২০১০-২০২১) শীর্ষক পরিকল্পনা দলিল প্রণয়ন করে। পরিকল্পনায় দেশের কাক্সিক্ষত উন্নয়নের কৌশলগত লক্ষ্যমাত্রাসমূহ উল্লেখ করে আপামর জনসাধারণের আশা-আকাক্সক্ষাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে জাতির দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়ন দর্শন ও স্বপ্ন প্রতিফলিত করা হয়েছে। এই দীর্ঘমেয়াদী রূপকল্পের মৌলিক উদ্দেশ্য হচ্ছে উচ্চতর প্রবৃদ্ধি অর্জনের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচন এবং ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি মধ্য আয়ের দেশে পরিণত করা, যেখানে দারিদ্র সর্বনিম্ন পর্যায়ে অবস্থান করবে এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে আঞ্চলিক বৈষম্য হ্রাস পাবে।
×