ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

চট্টগ্রামে অভ্যন্তরীণ সংঘাতেই শক্তিক্ষয় আওয়ামী লীগের

প্রকাশিত: ০৬:০১, ৭ নভেম্বর ২০১৫

চট্টগ্রামে অভ্যন্তরীণ সংঘাতেই শক্তিক্ষয় আওয়ামী লীগের

হাসান নাসির, চট্টগ্রাম অফিস ॥ চট্টগ্রামে শাসক দল আওয়ামী লীগের শত্রু আওয়ামী লীগ নিজেই। দলটির নেতাকর্মীরা তাদের আদর্শিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে সর্বশেষ কখন সংঘাতে জড়িয়েছিল তা চট-জলদি মনে করাও বেশ কঠিন। তবে ক্রমাগত শক্তিক্ষয় ঘটছে নিজ দলের অভ্যন্তরীণ প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে লড়াই ও মারামারি করে। বড় নেতারাও দায়সারাভাবে কিছু দিবস পালন ছাড়া মূল রাজনীতির ধারে কাছে নেই। সেখানেও চলে শোডাউন-পাল্টা শোডাউন ও পছন্দের নেতার নামে সেøাগান। নেতৃবৃন্দ সদাব্যস্ত অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে। উপদলীয় কোন্দলে জর্জরিত আওয়ামী লীগ এবং অঙ্গসংগঠন ছাত্রলীগের বিবদমান গ্রুপগুলো মাঠপর্যায়ে একে অপরের বিরুদ্ধে এমনই খ—গহস্ত যে, তাদের আর বাইরের শত্রুর প্রয়োজন নেই। আদর্শিক ও চেতনাগতভাবে আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ যে বিএনপি-জামায়াত এতে কোন দ্বিমত থাকার কথা নয়। কিন্তু রেকর্ড বলছে, বিগত প্রায় এক যুগেও প্রকৃত রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের সঙ্গে আওয়ামী লীগের উল্লেখ করবার মতো ক্লেশ হয়নি। তাই বলে দলটির নেতাকর্মীরা যে শান্ত-সুবোধ আচরণে সুনাম কুড়িয়েছেন, তাও নয়। আদর্শিক প্রতিপক্ষ মাঠে সক্রিয় না থাকলেও আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা যেন বড়ই সংঘাতপ্রিয়। মারামারি বজায় রাখতে নিজ দলের মধ্যেই রয়েছে প্রবল প্রতিপক্ষ। চট্টগ্রামের বিভিন্ন সেক্টরে আধিপত্য বিস্তার ও প্রভাব খাটিয়ে ব্যবসায়িক স্বার্থ হাসিলের লক্ষ্যে নিজেরাই লিপ্ত মরণপণ এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, সিআরবি (সেন্ট্রাল রেলওয়ে বিল্ডিং) ও নগরীর বিভিন্ন শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে অনেকটা নিয়মিতভাবে যে সংঘর্ষগুলো হয়ে থাকে তার সবই একই সূত্রে গাঁথা। চট্টগ্রামের আওয়ামী রাজনীতিতে এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী ও আ জ ম নাছির উদ্দিনের বিরোধ দীর্ঘদিনের। একজন দলের মহানগর কমিটির সভাপতি ও সাবেক মেয়র এবং অপরজন সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান মেয়র। দল ও অঙ্গসংগঠনগুলো প্রধানত বিভক্ত হয়ে আছে এই দুই নেতার ছত্রছায়ায়। এছাড়া ছোটখাটো আরও উপদল রয়েছে। চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগে গ্রুপিং এতটাই জটিল যে, কখন কোন নেতা কোনদিকে তা বোঝাও মুশকিল হয়ে দাঁড়ায়। দলের অভ্যন্তরে মূল বিভক্তি প্রধানত মহিউদ্দিন চৌধুরী ও আ জ ম নাছির সমর্থিতদের মধ্যে। এছাড়া রয়েছেন প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি, সাবেক প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী ডাঃ আফসারুল আমিন এমপি ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (চউক) চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম। তবে তারা কখন কোন বলয়ে তা বলা কঠিন। কারণ চট্টগ্রামের আওয়ামী রাজনীতির গ্রুপিং সমীকরণ বেশ জটিল। একদা মহিউদ্দিন চৌধুরীর খুবই ঘনিষ্ঠ ছিলেন ডাঃ আফসারুল আমিন ও আবদুচ ছালাম। কিন্তু এখন তার উল্টো। তাদের মধ্যে মুখ দেখাদেখি খুব একটা নেই। মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি নুরুল ইসলাম বিএসসির সঙ্গে মহিউদ্দিন চৌধুরীর সম্পর্ক শীতল হয় ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চট্টগ্রাম নগরীর কোতোয়ালি আসনে প্রার্থী মনোনয়নকে কেন্দ্র করে। ওই আসনে মহিউদ্দিন চৌধুরীর পছন্দের প্রার্থী ছিলেন শিল্পপতি শামসুল আলম, যিনি আওয়ামী লীগের টিকেট না পেয়ে বিএনপি প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে নুরুল ইসলাম বিএসসির কাছে পরাজিত হয়েছিলেন। এর বাইরে চট্টগ্রাম বন্দর-পতেঙ্গা আসনের এমপি এমএ লতিফ মূলত বেশি ব্যস্ত থাকেন তার নিজ নির্বাচনী এলাকা ও ট্রেডবডি পলিটিক্স নিয়ে। তবে নগর আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা মহিউদ্দিন চৌধুরীর সঙ্গে অন্য নেতাদের সম্পর্ক যে ভাল যাচ্ছে না তা পরিষ্কার। বিগত সিটি নির্বাচনেও মেয়র পদে নমিনেশনের ক্ষেত্রে বেশির ভাগ নেতাকে সাবেক মেয়রের বিরুদ্ধে একাট্টা থাকতে দেখা গেছে। এর প্রধান কারণÑ মহিউদ্দিন চৌধুরী দলীয় রাজনীতির বাইরে গিয়ে নানা অরাজনৈতিক ইস্যু নিয়ে বেশি মাথা ঘামিয়ে থাকেন বলে অভিযোগ। চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগ অভ্যন্তরে সাবেক ও বর্তমান মেয়র রীতিমতো প্রবল প্রতিপক্ষ। নগরীতে এমন কোন কলেজ নেই, যেখানে এই দুই শীর্ষ নেতার অনুসারীরা মুখোমুখি নয়। এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী সমর্থিতদের আধিপত্য ওমর গণি এমইএস কলেজে। আর সরকারী সিটি কলেজে প্রাধান্য আ জ ম নাছির উদ্দিন অনুসারীদের। এছাড়া সরকারী কমার্স কলেজ ও ইসলামিয়া কলেজে উভয়পক্ষই সমানে সমান। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বরাবরই মহিউদ্দিন চৌধুরী সমর্থিত নেতাকর্মীদের প্রভাব প্রতিপত্তি বেশি থাকলেও আ জ ম নাছির মেয়র হওয়ার পর থেকে চিত্রটা পাল্টাতে শুরু করেছে। নগরজুড়ে নানা ইস্যুতে ছাত্রলীগের বিবদমান এই দু’গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ যেন একেবারেই স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অভ্যন্তরীণ সংঘাতে শক্তিক্ষয় চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের। গ্রুপ-উপগ্রুপে বিভক্ত নেতাকর্মীরা নিজ দলের প্রতিপক্ষকে ঠ্যাঙাতেই সর্বদা মুখিয়ে থাকেন। তৃণমূল পর্যায়ে যে প্রতিপক্ষের যত বেশি মিটিং প- করতে পারলেন তিনিই যেন তত বড় নেতা। শীর্ষ নেতারা তাদের প্রভাব বলয় বাড়াতে ব্যবহার করছেন অনুগত কর্মীদের। নেতাদের কর্মকা- যতটা না রাজনৈতিক, তারচেয়েও বেশি একান্ত ব্যক্তিগতÑ এমনই অভিযোগ দলের সাধারণ সমর্থকদের। আওয়ামী লীগ লড়ছে নিজেরই বিরুদ্ধে।
×